কলকাতা: দুজনেই ভারতের হয়ে লক্ষ্যভেদ করে অসংখ্য গর্বের মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন বেসামাল বাংলা-সহ গোটা দেশ, তখন অতিমারি মোকাবিলায় এগিয়ে এলেন তিরন্দাজ ভাই-বোন রাহুল ও দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলায় বিভিন্ন খেলাধুলোর সঙ্গে জড়িত দুঃস্থদের সম্পূর্ণ নিখরচায় করোনার টিকাকরণের বন্দোবস্ত করেছেন রাহুল ও দোলা। খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ক্রীড়া প্রশাসক, কোচ হোক বা মালি, যাঁদের করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা নেই, শুক্রবার তাঁদের বিনামূল্যে করোনার টিকা দেওয়া হবে তিরন্দাজ ভাই-বোনের ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে। এ ব্যাপারে কলকাতার একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেছেন রাহুল ও দোলা। সেখান থেকেই টিকাকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোট চারশোজনের টিকাকরণের ব্যবস্থা হয়েছে। যাঁদের মধ্যে প্রায় দেড়শোজন আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের। তাঁদের জন্য নিখরচায় টিকাকরণের আয়োজন করা হয়েছে। বাকি আরও প্রায় আড়াইশোজন টিকা নেবেন খরচ দিয়েই। তাঁদের অনেকেরই নাম নথিভুক্ত করা থাকলেও বিভিন্ন কারণে ভ্যাকসিনেশন আটকে রয়েছে। সকলের জন্যই করোনা ভ্যাকসিনের জোগান দিচ্ছেন রাহুল ও দোলা।
বৃহস্পতিবার এবিপি লাইভকে রাহুল বললেন, 'বিভিন্ন খেলাধুলোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত রয়েছেন, অথচ যাঁদের ভ্য়াকসিন নেওয়ার সঙ্গতি নেই, তাঁদের জন্য বিনামূল্যে টিকাকরণের ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি যাঁরা নাম নথিভুক্ত করিয়েও টিকা পাচ্ছেন না, তাঁদের জন্যও টিকাকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকলেই ক্রীড়া জগতের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কোচ, কেউ খেলোয়াড়, কেউ ক্রীড়া প্রশাসক, কেউ হয়তো আবার মাঠকর্মী। এরকম মোট চারশোজনের টিকাকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে আমাদের ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে।'
গোটা উদ্যোগ নিয়ে আশাবাদী অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা তিরন্দাজ দোলা। এবিপি লাইভকে তিনি বললেন, 'পরিস্থিতি বেশ ভয়াবহ। করোনা অতিমারিকে ঠেকাতে ভ্যাকসিনেশন ভীষণ জরুরি। যত দ্রুত সম্ভব সকলকে করোনার টিকা দিতে হবে। একমাত্র তাহলেই সংক্রমণের হার কমবে। সেই জন্যই আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। এখন অনেকেই করোনার টিকা পাচ্ছেন না। দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছেন। গোটা বিশ্বেই খেলাধুলো থমকে। আমরা সাধ্যমতো বাংলার ময়দানের সঙ্গে যুক্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।'
কমনওয়েলথ গেমসে সোনাজয়ী তিরন্দাজ রাহুল জানালেন, তিরন্দাজি ছাড়াও অ্যাথলেটিক্স, কবাডি, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, খো খো, বাস্কেটবল, এরকম বিভিন্ন খেলার সঙ্গে জড়িতরা করোনার টিকা নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। শুক্রবার রাজারহাটে গ্লোবসিন ক্রিস্টালে টিকাকরণের শিবির আয়োজিত হচ্ছে। অ্যাপোলো হাসপাতালের সঙ্গে টিকারণের জন্য চুক্তি হয়েছে। পাশাপাশি ক্যালকাটা আলিপুর রাউন্ড টেবিল ১২, ক্যালকাটা আলিপুর লেডিজ় সার্কেল থ্রি এই উদ্যোগে সামিল হয়েছে। রাহুল বলছেন, 'আমাদের ক্যাম্পে সকলকে কোভিশিল্ড দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি যা, যাতে দ্রুত সকলকে ভ্যাকসিন দিতে হবে। তবেই হয়তো করোনার প্রকোপ কিছুটা কমবে।'
রাহুল জানালেন, নামী মুখেদের মধ্যে এশীয় গেমসে তিরন্দাজিতে পদকজয়ী তৃষা দেব তাঁদের শিবিরেই করোনার টিকা নেবেন। টেবিল টেনিসের পৌলমী ঘটক, শ্যুটিংয়ের জয়দীপ কর্মকার, অ্যাথলেটিক্সের সোমা বিশ্বাস, বিভিন্ন খেলার এরকম কয়েকজন কৃতী তাঁদের চেনাশোনাদের নাম জানিয়েছেন। খেলাধুলোর জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই সমস্ত মানুষকে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে।
তবে দোলার আক্ষেপ, লকডাউন চলায় অনেক অভাবী ক্রীড়াবিদ, যাঁরা ভ্যাকসিন নিতে পারেননি, তাঁরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দোলা বললেন, 'বিভিন্ন জেলার অনেকে রয়েছে যারা এখনও করোনার টিকা নেয়নি। কিন্তু জেলা থেকে তাদের কলকাতায় নিয়ে এসে ভ্যাকসিনেশন করানোটা কঠিন। তা নাহলে আমাদের শিবিরে আরও বেশি মানুষ ভ্যাকসিন পেতেন হয়তো।'
করোনা আবহে অবশ্য আগেও মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা গিয়েছে দোলা-রাহুলকে। গত বছর করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের সময় ঘূর্ণিঝড় আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় তিন হাজার পরিবারকে ত্রিপল ও শুকনো খাবারের মতো ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছিলেন রাহুল ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু। রাহুল বলছেন, 'করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছিলেন না যাঁরা, খবর পেলেই তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেছি। অন কল ডাক্তারের ব্যবস্থা করেছিলাম।' তিনি যোগ করলেন, 'অনেকে মনে করেন ক্রীড়াবিদদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব বেশি। কিন্তু নিজের চোখে দেখলাম, সকলেই অতিমারির শিকার হতে পারে। তিরন্দাজ জয়ন্ত তালুকদার করোনা আক্রান্ত হয়েছিল। ওর অবস্থা বেশ গুরুতর হয়েছিল। আইসিইউতে ভর্তি থাকতে হয়েছিল। অলিম্পিক্স ট্রায়ালে গিয়েছিল। চার নম্বরে শেষ করেছিল ও। অসমের বাড়িতে ফিরেই ও কোভিড পজিটিভ হয়। বেশ সিরিয়াস ছিল ওর অবস্থা। তারপর দেখলাম মঙ্গল সিংহ চাম্পিয়া করোনা আক্রান্ত হল। পঞ্জাব, হরিয়ানার অনেক ক্রীড়াবিদ ভ্যাকসিন নিতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। ভ্যাকসিন সকলেরই নেওয়া উচিত।'
করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতায় তাঁদের তিরন্দাজি অ্যাকাডেমি এখন বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন রাহুল। তবে মানবসেবা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর তাঁরা। রাহুল বলছেন, 'ভ্যাকসিনেশন হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ইয়াস বিধ্বস্ত এলাকায় পাঁচশো খাবারের প্যাকেট পাঠাব। আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।'