কলকাতা: খুব ছোটবেলা বাবা তাঁদের তিন বোনকেই পিংলায় মাসির বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন। বেসরকারি বাস চালাতেন শ্রীমন্ত নায়েক। দূরপাল্লার সফরে বেরিয়ে পড়তে হতো অহরহ। মেয়েরা যাতে ভালভাবে পড়াশোনা করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে অস্থায়ী ঠিকানা পিংলা। দারিদ্য সংসারের ছায়াসঙ্গী। মাটির বাড়ি। দুবেলা দুমুঠো অন্নসংস্থানেই কালঘাম ছোটে। আর সেই অনটনের মধ্যেই মেজো মেয়ের চোখে বড় স্বপ্ন। অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে!


সেই সময় মাটির কুঁড়েঘরে দাঁড়িয়ে দেখা যে স্বপ্নকে আকাশকুসুম মনে হতে পারত অনেকেরই। সঙ্গে অভাবের প্রতিবন্ধকতা। প্র্যাক্টিসের ফাঁকে বাকি জিমন্যাস্টরা যেখানে পুষ্টিকর ব্রেকফাস্ট খায়, সেখানে খুদের জন্য বরাদ্দ থাকত শুকনো মুড়ি। তবে তাজা দুই চোখের স্বপ্ন তাতে রং হারায়নি। বরং আরও বড়েছে সংকল্প। অভুক্ত পেট তৈরি করেছে নাছোড় জেদ। জিমন্যাস্টিক্সের মঞ্চে সে নিজেকে প্রমাণ করবেই।


সেই স্বপ্ন সফল হওয়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে প্রণতি নায়েক। ভারতের খেলাধুলোর ইতিহাসে দ্বিতীয় জিমন্যাস্ট হিসাবে অলিম্পিক্সের যোগ্যাতা অর্জন করেছে পিংলার কন্যা। দীপা কর্মকারের পর। আর বাংলা থেকে প্রথম। টোকিওতে সাফল্যের মন্ত্র নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন সল্ট লেকের সাই (স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া) কমপ্লেক্সে।


প্রণতি বলছেন, 'সকলেরই স্বপ্ন থাকে অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। আমি তখন বেশ ছোট। অলিম্পিক্স কী বুঝতাম না। আমার কোচ মিনারা বেগম বলেছিলেন যে, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তোর স্বপ্ন কী, বলবি অলিম্পিক্সে খেলা। সেরকম বলতে বলতে না জানি কখন সত্যিই সেই স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরেছি। পরে সিনিয়র পর্যায়ে খেলার সময় বুঝতে পারলাম কতটা কঠিন অলিম্পিক্সের যোগ্যতা পাওয়া।'


পিংলা গ্রামেই জিমন্যাস্টিক্স শুরু। স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলে শুভাশিষ চক্রবর্তীর কাছে জিমন্যাস্টিক্সে হাতেখড়ি। প্রণতির কথায়, 'তখন জানতামও না ওটা জিমন্যাস্টিক্স। ভাবতাম যোগাসন করছি।' যোগ করলেন, 'জেলাস্তরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর রাজ্য পর্যায়ে খেলতে কলকাতায় আসি। আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জানতে চান, কীভাবে সাইয়ে সুযোগ পেতে পারি। সাইয়ের কোচেরা বলেছিলেন, ঠিক আছে, কলকাতায় এনে দেখা হোক। কিন্তু কলকাতায় আসার পর আমাকে সম্ভবত অত বাচ্চাদের ভিড়ে চিনতে পারেননি। আমি ভীষণ ছোট ছিলাম। তখন আমার ৮ বছর বয়স। কোচেরা বলেছিলেন, জিমন্যাস্টিক্সে ভর্তি হবে না। এই মুহূর্তে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না কাউকে। বাবা কাঁদতে কাঁদতে হাত ধরে নিয়ে চলে আসছিলেন। তারপরই জিমের এক কাকু, দিলীপ বিশ্বাস আমাদের ডাইরেক্টর সুস্মিতা ম্যাডামের কাছে নিয়ে যান। সুস্মিতা ম্যাডামই আমাকে মিনারা বেগমের কাছে ভর্তি হতে সাহায্য করেন।'


তবে লড়াইয়ের সেখানেই শেষ নয়। কলকাতায় কোনও হস্টেল পাননি প্রণতি। বাইরে ভাড়া থাকতে হতো। যদিও কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা, খাওয়ার খরচ চালানো নায়েক পরিবারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। একরত্তি মেয়ের সঙ্গে এক সপ্তাহ বাবা আর পরের সপ্তাহ মা এসে থাকতেন। স্টেডিয়াম লাগোয়া এক পরিচিতের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ওই বাড়িতে প্রণতিকে তিন মাস রাখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন তাঁর বাবা-মা। তবে- প্র্যাক্টিসের পাশাপাশি প্রণতিকে ঘর মোছা-সহ বাড়ির কাজ করতে হতো। তাঁর মা প্রতিমা নায়েক কলকাতায় এসে যা জানতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখনই মিনারা বেগম এগিয়ে এসে প্রণতিকে তাঁর বাড়িতে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। পরের এক বছর প্রণতির ঠিকানা হয় মিনারার বাড়িতেই। তারপর জাতীয় মিটে সোনা। হস্টেল পান প্রণতি। লড়াইয়ের পথ কিছুটা সুগম হয়।




প্রণতি বলছেন, 'বাবা-মায়ের মতোই আমার সমস্ত দায়িত্ব মিনারা ম্যাডামই নিয়েছিলেন। অভিভাকদের ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। সকালে তিন ঘণ্টা ও বিকেলে তিন ঘণ্টা, মোট ছ'ঘণ্টা প্র্যাক্টিস করতাম ম্যাডামের কাছেই। তারপর প্রথমবার জাতীয় মিটে নেমে সোনা জেতার পর হস্টেল পেয়ে যাই। ১৮-১৯ বছর ধরে পারফর্ম করছি, হস্টেলেই আছি।' মা-বাবাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হতো না? প্রণতি বলছেন, 'ছোটবেলা বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেই সকলেই পছন্দ করে। বাবা-মাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হতো। তবে জিমন্যাস্টিক্সকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। সমস্ত মন খারাপকে জিমন্যাস্টিক্সে আরও ভাল পারফরম্যান্সে রূপান্তরিত করতাম।' যোগ করলেন, 'বাবা বেসরকারি বাস চালাতেন। অভাব অনটন নিত্য সঙ্গী ছিল। প্র্যাক্টিসের ফাঁকে সকলে ব্রেকফাস্টে পাঁউরুটি, কলা, ডিমসিদ্ধর মতো পুষ্টিকর খাবার খেত। আমি শুকনো মুড়ি খেয়ে থাকতাম। তখন হয়তো অত বুঝতাম না। তবে এই ছোটখাট ঘটনাগুলি আমার জেদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঠিক করে নিয়েছিলাম জিমন্যাস্টিক্সের পারফরম্যান্স দিয়েই প্রমাণ করব। আমি উপলব্ধি করেছিলাম, আমার সামনে আর কোনও রাস্তা নেই। খেলাধুলোতেই নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। সফল হতে হবে।' 


তিন বোনের মধ্যে প্রণতি মেজো। জিমন্যাস্টিক্সে সাফল্যের সুবাদে রেলে চাকরি পেয়েছেন। দিদি ও বোনের বিয়ে দিয়েছেন। পিংলায় নিজেদের বাড়ি ছিল না। প্রণতি বলছেন, 'মাসির বাড়িতে থাকতাম। মাটির বাড়ি। পরে মেদিনীপুরে জমি কিনে নিজে বাড়ি করেছি। আমি আজ যা, তা জিমন্যাস্টিক্সের জন্যই। যা পেয়েছি, সবই জিমন্যাস্টিক্স থেকে।'


ভল্টে দীপা কর্মকার, অরুণা রেড্ডির সঙ্গে তৃতীয় ভারতীয় কন্যা হিসাবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পদক রয়েছে প্রণতির। দীপার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। প্রণতি বলছেন, 'অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জনের পর সকলের আগে ফোনে শুভেচ্ছা জানায় দীপাদি। আমাকে বলেছে, নিজেকে বাঁচিয়ে প্র্যাক্টিস কর। এই মুহূর্তে যেন কোনও চোট আঘাত না লেগে যায়। মিউজ়িক নিয়ে সতর্ক করেছে। আমাকে পরামর্শ দিয়েছে, গানের ডাইরেক্টর, প্রোডিউসার ও কার গাওয়া সেসব আগে থেকে জেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে। দিদি বলেছে, মিউজ়িক নিয়ে রিও অলিম্পিক্সে ও নিজে সমস্যায় পড়েছিল। তাই আগাম সতর্ক করে দিয়েছে।' দীপার সেরা অস্ত্র ছিল প্রোদুনোভা ভল্ট। তবে প্রণতি প্রচলিত সামনে ৩৬০ ডিগ্রি ও পিছনে ৩৬০ ডিগ্রি ভল্টই করেন।




২০১৯ সালে এশীয় আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সে ব্রোঞ্জ। যা টোকিওর টিকিট দিয়েছে প্রণতিকে। 'খুব ভাল প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তবে চারটে অ্যাপারেটাসের মধ্যে প্রথমটিতে পড়ে যাই। তাই অলিম্পিক্সের যোগ্যতা পাইনি তখন। অনেক নম্বর কাটা যায়। ৪৮ নম্বর দরকার ছিল। শুরুতেই দু-এক নম্বর চলে যাওয়া মানে মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে যে কেউই। তবে আমি দমে না গিয়ে পুরোটা শেষ করেছিলাম। সেটাই আমাকে যোগ্যতা অর্জন করতে প্রধান ভূমিকা নিল। মে মাসে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সেটা বাতিল হয়ে যায়। তাতেই এশিয়া কোটায় আমি সুযোগ পাই,' বলছিলেন ২৬ বছরের জিমন্যাস্ট।


সাই থেকে মিনারা বেগম অবসর নিয়েছেন। এখন সাইয়ের কোচ লক্ষণ শর্মার কাছে প্র্যাক্টিস করেন প্রণতি। বলছেন, 'মিনারা ম্যাডামের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। ম্যাডাম বলেছেন, নিজেকে বাঁচিয়ে প্র্যাক্টিস কর।'


তবে তাঁকে চিন্তায় রাখছে সঠিক প্রস্তুতির অভাব। প্রণতি বলছেন, 'লকডাউনে একমাস বসে ছিলাম। ফিটনেস কমে গিয়েছিল। মাত্র ২ মাস ট্রেনিংয়ের সুযোগ পেয়েছি। যতটা সম্ভব করছি। তবে খেলাটা তো জিমন্যাস্টিক্স। অতিরিক্ত চেষ্টা করতে গিয়ে চোট লেগে গেলে সমস্যায় পড়ে যাব। ২০২২ সালের কমনওয়েলথ ও এশিয়ান গেমসের কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে। যে কোনও জিনিস সঠিকভাবে অনুশীলন না থাকলে সমস্যা তো হয়ই। দীর্ঘদিন প্র্যাক্টিস করতে পারিনি। ছন্দ পেতে ৪-৫ মাস সময় তো লাগেই। আমি সেখানে মাস দুয়েক পেলাম। নিজের সেরাটা দিয়েছি। দেখা যাক।


প্রত্যেক দিন করোনা পরীক্ষা চলছে। শনিবার করোনা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ় সম্পূর্ণ হয়েছে প্রণতির। জৈব সুরক্ষা বলয়ে সময় পেলে ঘরের মধ্যেই টিভিতে সিনেমা দেখেন। গান শোনেন। তবে ছুটির দিন নিজের পরিচর্যা করতেই সময় কেটে যায়। আইসিং, স্টিম বাথ করেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। সকালে ৮.৪০ থেকে অনুশীলন শুরু হয়। শেষ হয় বেলা পৌনে বারোটা নাগাদ। তারপর বিকেলে আবার প্র্যাক্টিস। প্রণতি বলছেন, 'প্র্যাক্টিস থেকে ফিরে কতক্ষণে ফ্রেশ হব, আইস বাথ নেব, খাব আর ঘুমোব, সেই অপেক্ষা করি। এতটাই ক্লান্ত থাকি।'


ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কিটব্যাগে আরাধ্য দেবতার ছবি রাখেন। লোকনাথ বাবার ছবি রয়েছে মোবাইল ফোনে। আর পয়মন্ত মনে করেন বোনঝি আরাধ্যাকে। প্রণতি বলছেন, 'আরাধ্যার ছবি ফোনে সেভ করা আছে। ঘুম থেকে উঠেই দেখি। ও ভীষণ পয়মন্ত।' যোগ করছেন, 'অলিম্পিক্সে নিজের সেরাটা দেব। তারপর ফলাফল যা হওয়ার হবে।'


অলিম্পিক্স থেকে সরে দাঁড়ালেন সেরিনা