কলকাতা: টোকিও অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করার পর থেকেই তাঁকে বহুবার একটা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। আপনি কি বাঙালি? প্রিয়ঙ্কা গোস্বামী হেসে সকলকেই উত্তর দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, 'না, আমি উত্তরপ্রদেশের মেয়ে। মেরঠে বাড়ি। বাংলার সঙ্গে সেই অর্থে কোনও যোগ নেই।'


বৃহস্পতিবার বিকেলে আলাপচারিতার শুরুতেই বেঙ্গালুরু থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি লাইভকে হাসতে হাসতে প্রিয়ঙ্কা বললেন, 'শুনেছি বাংলায় অনেকেরই পদবি গোস্বামী। তাই প্রিয়ঙ্কা গোস্বামী শুনলে অনেকেই ধরে নেন আমি বাঙালি।'


কে এই প্রিয়ঙ্কা গোস্বামী? কেনই বা তাঁকে নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল?


আসুন আলাপ করিয়ে দেওয়া যাক। প্রিয়ঙ্কা উত্তরপ্রদেশের মেরঠের বাসিন্দা বছর চব্বিশের অ্যাথলিট। রেস ওয়াকিংয়ে দেশের সেরা। ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় রেকর্ড গড়ে অলিম্পিক্সের টিকিট কনফার্ম করে ফেলেছেন। রেস ওয়াকিং করে ২০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছেন এক ঘণ্টা ২৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে। আগের এক ঘণ্টা ২৯ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডের জাতীয় রেকর্ড ভেঙে। আপাতত বেঙ্গালুরুর স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (সাই)-এর ক্যাম্পাসে প্রস্তুতিতে মগ্ন। সেখান থেকেই ফোনে প্রিয়ঙ্কা বললেন, 'জাতীয় রেকর্ড গড়তে পেরে খুব খুশি। করোনা আবহে অলিম্পিক্স হবে কি না সেটা তো বুঝতে পারছি না। অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা সব খেলোয়াড়ের স্বপ্ন থাকে। আমি কঠোর পরিশ্রম করছি। প্রস্তুতিতে কোনও খামতি রাখছি না।'



রেস ওয়াকিং শুরু কীভাবে? প্রিয়ঙ্কা বলছেন, 'তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। জিমন্যাস্টিক্স করতাম। লক্ষ্ণৌতে কে ডি সিংহ হস্টেলে থাকতাম। সেখানে প্রত্যেক মাসে ফিজিক্যাল ট্রায়াল হতো। তাতে ৮০০ মিটার দৌড়ে আমি প্রথম হতাম। সেই থেকে অ্যাথলেটিক্সের প্রতি টান। জিমন্যাস্টিক্স ছেড়ে দিই। ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় মেরঠের স্টেডিয়ামে ফিজিক্যাল ট্রেনিং শুরু করি। তখন আমাদের জেলাস্তরে একটা প্রতিযোগিতা হতো। যারা জিতত, তাদের সুন্দর একটা ব্যাগ দেওয়া হতো। সেই ব্যাগ পাওয়া আমার স্বপ্ন ছিল। একাধিক ইভেন্টে নাম দিয়েছিলাম। কিন্তু পদক জিততে পারিনি। কখনও চতুর্থ স্থানে শেষ করেছি তো কখনও হয়তো সিক্সথ হয়েছি। শেষে হাতে ছিল রেস ওয়াকিং। কোচ বলেছিলেন, এটাতে চেষ্টা কর, পারবি। তখন রেস ওয়াকিংয়ে নাম দিই। জিমন্যাস্টিক্স করতাম বলে শরীর নমনীয় ছিল। রেস ওয়াকিংয়ে নেমেই তৃতীয় হই। স্বপ্নের সেই ব্যাগ পুরস্কারের সঙ্গে পাই। ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। সেই থেকে রেস ওয়াকিং শুরু।'



২০ কিলোমিটার পথ হাঁটেন কীভাবে? ক্লান্তি আসে না? 'আমাকে যদি কেউ বলে ২ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে এই জিনিসটা কিনে আনো, আমি হয়তো ক্য়াব নিয়ে নেব। তবে রেস ওয়াকিং একটা পদ্ধতি। কষ্টসাধ্য। ২০ কিলোমিটার হাঁটতে কেউই চাইবে না। তবে আমাদের টেকনিক মেনে চলতে হয়। যথেষ্ট জোরে হাঁটতে হয়। অনেকে হয়তো এতটা জোরে দৌড়ন না। আমার কাছে এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে', বলছিলেন প্রিয়ঙ্কা।


অলিম্পিক্সে তাঁর যোগ্যতা পাওয়ার আগে পর্যন্ত অনেকেই রেস ওয়াকিং কথাটাই শোনেননি। ক্রিকেট-ফুটবলের দেশে এরকম একটি স্বল্পপরিচিত খেলায় সাফল্য পাওয়া কতটা কঠিন? প্রিয়ঙ্কা বলছেন, 'সত্যিই ক্রিকেট বা ফুটবলের তুলনায় অ্যাথলেটিক্স অনেকটা পিছিয়ে। অনেকে তো জানেনই না রেস ওয়াকিং ঠিক কী! অ্যাথলেটিক্স এমন খেলা যেখানে যতটা পরিশ্রম করব, তত ভাল করব। টিমগেম নয়, ব্যক্তিগত স্তরে কে কত ভাল পরিশ্রম করল বা কতটা প্রস্তুতি নিল, তার ওপর নির্ভর করে সব।'



আপাতত দুবেলা প্র্যাক্টিস আর ট্রেনিং মিলিয়ে ৭-৮ ঘণ্টা অনুশীলন চলছে প্রিয়ঙ্কার। তার মাঝেই শরীরে বাসা বেঁধেছিল করোনা ভাইরাস। 'করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। মৃদু উপসর্গ ছিল। ১০ দিন কোয়ারেন্টিনে ছিলাম। মানসিকভাবে চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, সকলে তখন অলিম্পিক্সের প্রস্তুতি নিচ্ছে আর আমি ঘরে বসে দিন গুনছি। মন খারাপ হতো। হয়তো আরও ভাল প্রস্তুত হতে পারতাম ওই দু'সপ্তাহ প্র্যাক্টিস করতে পারলে। ট্র্যাকে ফিরেও প্রথমদিকে দুর্বলতা ছিল,' বলছিলেন মেরঠের অ্যাথলিট। নিজের ইভেন্ট নিয়ে যিনি বললেন, 'রেস ওয়াকিং দুরকম হয়, রাস্তায় বা ট্র্যাকে। ট্র্যাকে ৫০০ মিটারের ল্যাপ হয়। ৫০০ মিটার যাওয়া ও ৫০০ মিটার আসা। ২০ কিলোমিটার রেস ওয়াকিং মানে বহু দূরে চলে গেলাম, তা কিন্তু নয়। একটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই গোটা ব্য়াপারটা হয়। অলিম্পিক্স রাস্তায় হয়। আবার ট্র্যাক থেকে শুরু করে রাস্তায় শেষ হচ্ছে, সেরকমও হয়।


মেরঠের বাড়িতে মা, বাবা ও ভাই রয়েছেন। ঈশ্বরে বিশ্বাসী প্রিয়ঙ্কা। নিয়মিত পুজোপাঠ করেন। শখ মডেলিং। বলছেন, 'ফটোশ্যুট করতে ভালবাসি। সময় পেলেই পোজ় দিই। তবে গত দু'বছরে অলিম্পিক্স ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি। মাকে বলে রেখেছি, একদিন না একদিন মডেলিং করবই।ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ার কথা ভেবেছিলাম। তবে মা বলেছিল আগে পড়াশোনা। পাতিয়ালার পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হই। এখন রেলের চাকরি করি।'


বাড়ি থেকে সবসময় সমর্থন পেয়েছেন। ডাবল অলিম্পিয়ান গুরমিত সিংহের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আপনার প্রেরণা কে? প্রিয়ঙ্কার সপ্রতিভ জবাব, 'আমি নিজেই নিজের অনুপ্রেরণা। নিজের খেলার বিশ্লেষণ নিজেই করি, কোথায় দুর্বলতা রয়েছে, কোথায় আরও উন্নতি করতে হবে সেটা ঠিক করে নিই।' ট্যুইটার হ্যান্ডলে কভার ফটো অলিম্পিক্সের তিনটি পদকের ছবি। টোকিও থেকে পদক জিতে ইতিহাস গড়ে দেশে ফেরার লক্ষ্যে এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রিয়ঙ্কা।