কলকাতা: একজন বাইশ গজের মহাতারকা। অন্যজন টেবিল টেনিস গ্রহে সবে নিজের ছাপ ফেলতে শুরু করেছেন। প্রতিশ্রুতিমান। কিন্তু শুরু থেকেই সামলাতে হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জ। প্রতিবন্ধকতার আঁধারে তাঁকে পথ দেখাচ্ছে ক্রিকেট মাঠের নক্ষত্রের দ্যুতি।


বিরাট কোহলির পৃষ্ঠপোষকতায় পথ চলার রসদ পাচ্ছেন বাঙালি কন্যা স্বস্তিকা ঘোষ। যে পাথেয়কে সম্বল করে টেবিল টেনিসে ঝড় তুলেছেন অষ্টাদশী। সদ্য প্রকাশিত বিশ্ব যুব র‌্যাঙ্কিংয়ে (আইটিটিএফ অনূর্ধ্ব ১৯) ডাবলসে দুই এবং সিঙ্গলসে চার নম্বরে উঠে এসেছেন। বাংলার টেবিল টেনিসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কর্তা দেবাশিষ চক্রবর্তীর কথায় যা বিরল নজির।


তবে বাংলা নয়, জাতীয় টেবিল টেনিসে স্বস্তিকা মহারাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর বাবা তথা ব্যক্তিগত কোচ সন্দীপ ঘোষ প্রাক্তন ফুটবলারও। এক সময় তালতলা একতা, কালীঘাট ক্লাব, জর্জ টেলিগ্রাফের হয়ে প্রথম ডিভিশন খেলেছেন। ১৯৯১ সালে মুম্বইয়ে ওরকে মিলস টিমে সুযোগ পেয়ে বাণিজ্যনগরীতে পাড়ি দেন। সেই দলেই খেলা শুরু করেন। সতীর্থদের মধ্যে ছিলেন ভারতের জাতীয় দলের গোলকিপার ইউসুফ খান। তবে ১৯৯৪ সালে রোভার্স কাপে হাঁটুর চোট আর কেরিয়ারকে দীর্ঘায়িত হতে দেয়নি। এখন মেয়ের কেরিয়ারই ধ্যানজ্ঞান সন্দীপের।


মুম্বই থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি লাইভকে সন্দীপ বললেন, '২০০০ সাল থেকে এপিজে স্কুলে ফুটবল দলের কোচিং শুরু করি। কোচ হিসাবে সাফল্য পাই। ভিপিএড সম্পূর্ণ করে পরে টেবিল টেনিসের কোচিং শুরু করি। খাড়গাড়ে কোনও মাঠ ছিল না। চারদিকে পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। বাংলায় এক সময়ে গোপাল চক্রবর্তীর কাছে টেবিল টেনিসের তালিম নিয়েছিলাম। সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে টেবিল টেনিস কোচিং শুরু।'




স্বস্তিকাদের আদি বাড়ি হাওড়ার উলুবেড়িয়ায়। ২০০৩ সালে জন্ম তাঁর। বাগনানে মামার বাড়িতে কয়েক মাস কাটিয়ে মায়ের সঙ্গে মুম্বই পাড়ি। সোমবার ১৮ বছরের জন্মদিন ছিল স্বস্তিকার। বার্থ ডে গার্ল বললেন, 'নবি মুম্বইয়ের খাড়গড়ে এপিজে স্কুলে বাবা স্পোর্টস টিচার ছিলেন। সেখানে সাড়ে তিন বছর বয়সে টেবিল টেনিসে হাতেখড়ি হয় আমার। দেওয়ালে খেলে শুরু করি। তারপর মুম্বইয়ে রায়গড়ের হয়ে জেলা স্তরে খেলা শুরু। ৫ ও ৬ বছর বয়সে পরপর দুবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। মাত্র ৮ বছর বয়সে জেলার একটা টুর্নামেন্টে ছক ভেঙে পুরুষদের অনূর্ধ্ব ২১ বিভাগে খেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সেই টুর্নামেন্টেও চ্যাম্পিয়ন হই। ২০১৩ সালে মাত্র সাড়ে ন'বছর বয়সে আজমেঢ়ে জাতীয় ক্যাডেট ও সাব জুনিয়র প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হই।'


মেয়ের কোচিংয়ে আরও সময় দেবেন বলে স্কুলের স্থায়ী চাকরি ছেড়েছেন সন্দীপ। আপাতত পার্টটাইম ভিত্তিতে স্কুলেরই কোচিং করান। তবে লকডাউনে স্কুলের পাশাপাশি কোচিংও বন্ধ হয়ে যায়। উপার্জনও কার্যত শূন্য। সেই প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে ঘোষ পরিবারকে লড়াই করতে হয়েছে। সন্দীপ বলছেন, 'খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে তো সকলকেই যেতে হয়। তবে মেয়ের খেলায় কোনওরকম আঁচ পড়ুক, চাইনি।' 




সেই সময়ই মসিহা হয়ে উদয় হয় বিরাট কোহলির ফাউন্ডেশন। ২০১৮ সালে ট্রায়াল নেওয়ার পর বিরাটের ফাউন্ডেশন স্বস্তিকার খেলাধুলোর যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নেয়। সন্দীপের গলায় স্বস্তির সুর। বলছেন, 'তার আগের বছরই অনূর্ধ্ব ১৫ ভারতীয় দলের হয়ে সাফ গেমসে পদক জিতে ফিরেছিল স্বস্তিকা। বিরাটের ফাউন্ডেশন ওর সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি করে। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে সমস্ত টুর্নামেন্টে খেলার খরচ বহন করেন বিরাটই। তাইওয়ান, চিন, সব জায়গায় প্র্যাক্টিসের খরচ বহন করেন। আন্তর্জাতিক মানের টেবিল কিনে দিয়েছে। যে টেবিল আর কারও কাছে নেই। ওঁর অবদান আমরা কোনওদিন ভুলব না।'


ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের সঙ্গে তিনবার দেখা করার ও কথা বলার সুযোগ হয়েছে স্বস্তিকার। কী পরামর্শ দিয়েছেন কোহলি? 'বিরাট স্যার বলেছিলেন, কঠিন পরিশ্রম করো। পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে বলেছিলেন, লক্ষ্যে অবিচল থাকো। ওঁর কথা মেনে চলি। সব সময় উৎসাহ দেন,' ফোনে বলছিলেন স্বস্তিকা।


টেবিল টেনিসে তাঁর আদর্শ চিনের প্লেয়ার, বিশ্বের এক নম্বর ডিং লিং। প্রতিনিয়ত নিজেকে ঘষামাজা করে চলেছেন। স্বস্তিকা বলছেন, 'মনঃসংযোগ বাড়াতে ধ্যান করি। এবার স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট নুপূর করের কাছে ক্লাস শুরু করেছি।' তাঁর খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে সব ব্য়াপারে খেয়াল রাখেন মা শাশ্বতীও।




ভারতের মাটিতে আয়োজিত ইন্ডিয়ান ওপেন স্বস্তিকার খেলা প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। সেই টুর্নামেন্টে সিঙ্গলসে রুপোর পাশাপাশি ডাবলসেও পদক জিতেছিলেন। তবে সিঙ্গলসকেই প্রাধান্য দেন অষ্টাদশী টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। সিনিয়র বিভাগে স্প্যানিশ ওপেন, তাইল্যান্ড ওপেন, পোলিশ ওপেন খেলেছেন স্বস্তিকা। তবে এখনও সাফল্য আসেনি। সদ্য পর্তুগাল ওপেন ও তিউনিশিয়া ওপেনে পরপর পদক জিতেছেন। স্বস্তিকার স্বপ্ন অলিম্পিক্স থেকে পদক জয়। বলছেন, 'অলিম্পিক্সের দেশকে পদক দেওয়াই আমার স্বপ্ন। ২০২৪ সালে অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জনই প্রথম লক্ষ্য। তার জন্য সিনিয়র বিভাগে নিয়মিতভাবে খেলতে চাই।' তাঁর বাবা তথা কোচ সন্দীপ বলছেন, 'এখন একটা-দুটো বল বেরিয়ে যাচ্ছে। সেগুলি বন্ধ করতে হবে। ফিটনেস, গতি আরও বাড়াতে হবে ওকে।'


আপাতত তাঁদের চিন্তা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। করোনা আবহে ভিসা সমস্যায় আটকে যাচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ। স্বস্তিকা বলছেন, 'চেক প্রজাতন্ত্র ওপেন বা স্লোভেনিয়া ওপেনে অংশ নিতে পারলাম না। দূতাবাসই বন্ধ। ফলে ভিসা পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতে করোনা পরিস্থিতির জন্য অনেক দেশ ভিসা দিতে চাইছে না। অগাস্টে কয়েকটি ভাল টুর্নামেন্ট রয়েছে। সেগুলি খেলাই আপাতত লক্ষ্য।'


রামশেঠ ঠাকুর পাবলিক স্কুলে প্র্যাক্টিস করেন। সেখানেই নিখরচায় পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রী স্বস্তিকা। ক্লাস টুয়েলভ উত্তীর্ণ। এবার স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করবেন।


পাঁচবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন স্বস্তিকা। ব্যক্তিগত বিভাগে একবার ক্যাডেটে আর একবার জুনিয়র সিঙ্গলসে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। সাব জুনিয়র ও ইয়ুথ মিলিয়ে তিনবার ডাবলসে চ্যাম্পিয়ন। বাংলার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেলে ফিরবেন? স্বস্তিকা ও তাঁর বাবা সন্দীপ প্রায় একই সুরে বললেন, 'এখনও সেরকম কোনও প্রস্তাব পাইনি। ভাল প্রস্তাব পেলে বাংলাতে ফিরতেই পারি। স্বস্তিকার সামনে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করার প্রস্তাব এলে অবশ্যই ভেবে দেখব।'