সোমনাথ দাস, পশ্চিম মেদিনীপুর: বছর ছয়েক আগের ঘটনা। বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন। চোট এতটাই মারাত্মক ছিল যে, বাইকের হ্যান্ডেল কোমরের হাড় ভেঙে কার্যত বিঁধে গিয়েছিল শরীরে।
চলৎশক্তিহীন অপূর্ব সামন্তর (Apurba Samanta) বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। হতাশায় দু-দুবার আত্মহননের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কথায় আছে না, রাখে হরি তো মারে কে!
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল শহর থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরের দাসপুরের দুবরাজপুর গ্রামের অপূর্ব জীবন সংগ্রামে হার মানতেও মানতেও যেন জিতে গিয়েছেন। মৃত্যুভয় নয়, অবসাদযন্ত্রণা নয়, এখন তাঁর চোখে দেশকে গর্বিত করার স্বপ্ন।
চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ার পর হতাশায়, অবসাদে দু-দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। সফল হননি। তারপর ওড়িশায় গিয়ে চিকিৎসা করান। সেই থেকে সঙ্গী হুইলচেয়ার।
অপূর্বের চাকরিটাও হুইলচেয়ারের সঙ্গে জড়িত। শিলিগুড়ির একটি হাসপাতালে তিনি ‘হুইলচেয়ার ট্রেনার’ হিসাবে কাজ করেন। সেই থেকেই ‘হুইলচেয়ার গেম’-এ অংশ নেওয়া শুরু হয়। আগে হুইলচেয়ার ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন। বাস্কেটবল, ভলিবলও খেলেছেন। এখন ড্রাগন বোট তাঁর ভরসা।
হাঁটাচলা করতে পারেন না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে ভরসা শুধু হুইলচেয়ার। আর তাতে চড়েই স্বপ্নপূরণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন অপূর্ব। তাইল্যান্ডে গিয়েছেন ড্রাগন বোট বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে। তাইল্যান্ডে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি নিয়েছেন ইকো পার্কে। অপূর্ব বলেছেন, 'সম্প্রতি জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা হয় বিহারে। সেখানে বাংলার প্যারা দল চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই দলে আমি ছিলাম। এ বার ভারতীয় প্যারা দলে রয়েছে পাঁচ জন। তবে আমিই একমাত্র হুইলচেয়ারে বসা অ্যাথলিট।'
ছেলেকে নিয়ে এক সময় গভীর উদ্বেগে ছিলেন। অপূর্বর মা অসীমা সামন্তর মুখে অবশ্য এখন স্বস্তির হাসি। বলছেন, 'ওর লড়াই সকলের কাছে প্রেরণা হতে পারে। সব মা-ই চায় সন্তানের সাফল্য। আশা করছি তাইল্যান্ড থেকে পদক জিতে ফিরবে অপূর্ব। দেশের নাম উজ্জ্বল করবে।'
গোটা এলাকায় এখন সংকল্পের সেরা উদাহরণ অপূর্ব। তাঁর প্রতিবেশী শীর্ষেন্দু মিশ্র বলছেন, 'ও গোটা গ্রামের গর্ব। বিশ্বমানের একটা প্রতিযোগিতায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন ভেবেই ভাল লাগছে। ওর সাফল্য কামনা করি।'
গ্রামবাসী সমীর বেরা বলছেন, 'দুর্ঘটনা ওকে শারীরিকভাবে ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু মনের জোর কেড়ে নিতে পারেনি।' আরেক প্রতিবেশী দেবরাজ সামন্ত বলছেন, 'আমার পাশের বাড়ির ছেলে অপূর্বদা। ওর লড়াই সকলের প্রেরণা। চাইব তাইল্যান্ড থেকে জিতে ফিরুক।'
অপূর্ব নিজে সাফল্যের ব্যাপারে আশাবাদী। বলছেন, 'আমি হুইলচেয়ারে বসে হুইলচেয়ারের প্রশিক্ষণ দিই। এটা বাড়তি প্রেরণা জোগায়। আমায় দেখে অনেকে বুঝতে পারে যে, সবই ‘সম্ভব’। আমায় তাই আরও সফল হতে হবে। সেটা বাকিদেরও প্রেরণা দেবে।'