সন্দীপ সরকার, কলকাতা: লাহৌরে নিজের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে প্রথম দর্শনেই ছেলেটিকে ভাল লেগে গিয়েছিল রানা সাদিক আলির (Rana Sadiq Ali)। ছোটখাট চেহারা। সদাহাস্যময়। ভীষণ নরম স্বভাব।


কিন্তু হাতে ব্যাট তুলে নিলেই অন্য রূপ। বয়সে অনেক বড় বোলারদেরও ভয় পাচ্ছে না। সব বল সোজা ব্যাটে খেলার চেষ্টা করছে খুদে ক্রিকেটার। যা দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলেন সাদিক। অভিজ্ঞ কোচ সেদিনই বুঝে গিয়েছিলেন, এই ছেলে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া।


লাহৌরের মুসলিম মডেল হাইস্কুলের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়া সেদিনের সেই খুদে ক্রিকেটারকে আজ বিশ্ব চেনে বাবর আজম (Babar Azam) নামে। আইসিসি (ICC) ব়্যাঙ্কিংয়ে ওয়ান ডে ক্রিকেটে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটার। টেস্টে রয়েছেন চার নম্বরে। টি-টোয়েন্টিতে তিনে। ব়্যাঙ্কিংয়েই স্পষ্ট, ক্রিকেটের সব ফর্ম্যাটে কীরকম দাপট দেখিয়ে চলেছেন বাবর। ছাত্রের ধারাবাহিকতায় উচ্ছ্বসিত সাদিক আলি। যাঁর হাত ধরে বাবরের উত্থান।


লাহৌর থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি লাইভকে সাদিক বললেন, 'মুসলিম মডেল হাইস্কুল ও ওয়াহাদ এগল্যাটস ক্রিকেট ক্লাবে বাবর প্রথম যখন আসে, ওর বয়স বছর তেরো। ওর ক্রিকেটীয় প্রতিভা শুরুতেই উপলব্ধি করেছিলাম। অ্যাকাডেমিতে বয়সে ওর চেয়ে  অনেক বড় বোলারদেরও ভয়ডরহীনভাবে খেলত। আমার অভিজ্ঞতা বলেছিল, এ ছেলে অনেক দূর যাবে।'


সাদিক যে ভুল ছিলেন না, বাইশ গজে প্রমাণ করে চলেছেন বাবর। ওয়ান ডে ক্রিকেটে প্রায় ৫৯ গড় রেখে ৫২০২ রান। ১৮ সেঞ্চুরি। টেস্ট ও ওয়ান ডে-তেও ধারাবাহিকভাবে রান করেছেন। ২৮ বছরের পাক ব্যাটার বিশ্বের তাবড় বোলারদের ঘুম কেড়েছেন। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সদ্যসমাপ্ত ওয়ান ডে সিরিজের শেষ দুই ম্যাচেই হাফসেঞ্চুরি। পাক দলের সেরা সম্পদ মনে করা হচ্ছে বাবরের ছন্দ।


দিন দুয়েক পরেই শুরু এশিয়া কাপ (Asia Cup)। প্রথম ম্যাচেই নামছে আয়োজক পাকিস্তান। ৩০ অগাস্ট মূলতানে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ নেপাল। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্ব অপেক্ষায় রয়েছে ২ সেপ্টেম্বরের। পাল্লেকেলে-তে সেদিন ভারত-পাকিস্তান মহারণ। কোন দল এগিয়ে? বাবরের ছোটবেলার কোচ বলছেন, 'ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে কোনও ফেভারিট হয় না। এই ম্যাচে প্রবল স্নায়ুর চাপ থাকে। যারা সেদিন ভাল ক্রিকেট খেলবে, তারাই জিতবে। আগে কোন ম্যাচে কে কী করেছে বা কে কেমন ছন্দে রয়েছে, সেটা সব সময় এই ম্যাচের দিশা নির্ধারিত করতে পারে না।'


এশিয়া কাপের পরেই ওয়ান ডে বিশ্বকাপ। ১৪ অক্টোবর আমদাবাদে ভারত-পাক (Ind vs Pak) দ্বৈরথ। বিশ্বকাপে কারা এগিয়ে? সাদিক বলছেন, 'ভারতের মাটিতে খেলা হবে বিশ্বকাপ। ভারতের পরিবেশ-পরিস্থিতি অনেকটাই পাকিস্তানের মতো। তাই দুই দলই ক্রিকেটীয় দিক থেকে সমান জায়গায় থাকবে। বাকিটা ঠিক হবে সেই নির্দিষ্ট দিন কে কেমন ক্রিকেট খেলবে তার ওপর।' যোগ করলেন, 'একটা সময় মনে করা হতো ভারত-পাক ম্যাচ মানেই ভারতের ব্যাটিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের বোলিংয়ের লড়াই। সেই সরফরাজ নওয়াজ, ইমরান খানের সঙ্গে সুনীল গাওস্কর-দিলীপ বেঙ্গসরকারদের দ্বৈরথের যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে ওয়াসিম আক্রম-ওয়াকার ইউনিস-শোয়েব আখতার বনাম সচিন তেন্ডুলকর-রাহুল দ্রাবিড়-সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-বীরেন্দ্র সহবাগের লড়াই পর্যন্ত। এখন কিন্তু ভারতের হাতেও ভাল পেসার রয়েছে। অন্যদিকে বাবর, মহম্মদ রিজওয়ানরা থাকায় পাক ব্যাটিংও যথেষ্ট শক্তিশালী। তাই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। তবে শাহিন শাহ আফ্রিদি, হ্যারিস রউফরা যেরকম বল করছে, তাতে ভারতীয় ব্যাটিংকে কড়া পরীক্ষার মুখে পরতে হবে।'


অভিজ্ঞ পাক কোচকে জিজ্ঞেস করা গেল, বাবর আজম ও বিরাট কোহলির (Virat Kohli) মধ্যে বিশ্বের সেরা ব্যাটার কে, এই তর্কে তোলপাড় হয় চায়ের আড্ডা। আপনার চোখে সেরা কে? সাদিক বললেন, 'বিরাট ও বাবর, দুজনই দুর্দান্ত ব্যাটার। তবে বিরাট অনেক আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছে। ওর রান, সেঞ্চুরির সংখ্যা তাই অনেক বেশি। বাবরকে অনেকটা পথ পেরতে হবে। বিরাট এগিয়ে। তবে ওকে ধরার দক্ষতা কারও থাকলে, সেটা বাবর।' যোগ করলেন, 'পাকিস্তানে কিন্তু বিরাটের প্রচুর সমর্থক। পাক জনতা ওর ব্যাটিং দেখতে ভালবাসে। বাবরকেও নিশ্চয়ই ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা পছন্দ করেন।'


এশিয়া কাপের আয়োজক দেশ হয়েও ঘরের মাটিতে বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছে না পাকিস্তান। ঘরের মাঠে খেলার সুবিধা না পাওয়া কি পাক শিবিরের কাছে ধাক্কা? সাদিক বলছেন, 'আমাদের দেশে ক্রিকেটটাই নষ্ট হতে বসেছিল। তবে এখন ফের ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হয়েছে। ভাল খেললে কোনও দেশেই সমস্যা হওয়ার কথা নয়।'


৩১ বছর ওয়ান ডে বিশ্বকাপ অধরা। এবার ভারতের মাটিতে খেলা বলে কি সুবিধা পাবে পাকিস্তান? উপমহাদেশের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে খেলা হবে বলে? 'পাকিস্তান ১৯৯২ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া-নিউজ়িল্যান্ডে খেলে। ফলে পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত নই। পাকিস্তান ওয়ান ডে বিশ্বব়্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে। বিশ্বকাপে অন্যতম ফেভারিট তো বটেই,' বলছিলেন সাদিক।


করোনার ধাক্কা আর লকডাউনে বেসামাল হয়ে গিয়েছিল জীবন। সংসার বাঁচাতে রাস্তায় ফল বিক্রি করতে হতো সাদিককে। তবে পরে পাকিস্তান সুপার লিগের দল লাহৌর কালান্দার্স তাঁকে ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট পদে নিযুক্ত করে। ফের কোচিংয়ে ফিরেছেন। এশিয়া কাপের আগে বাবরের সঙ্গে কথা হয়েছে? সাদিক বলছেন, 'আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজ খেলছিল পাকিস্তান। তারপরই এশিয়া কাপ। তার পরেই বিশ্বকাপ। কোনও টুর্নামেন্ট চলাকালীন সাধারণত কথা বলি না। বাবর অভিজ্ঞ। জানে কখন কী করতে হবে। ও দলের অধিনায়কও। পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দেওয়া সহজ নয়। প্রচুর চাপ থাকে।'


এশিয়া কাপে ভারতই কি সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ? সাদিক বলছেন, 'ভুলে যাবেন না শ্রীলঙ্কা গতবারের চ্যাম্পিয়ন। বাংলাদেশ, আফগানিস্তানও ভাল দল। কোনও দলকেই হাল্কাভাবে নেওয়া চলবে না।'


ছাত্রের কাছে কী প্রত্যাশা? সাদিক বলছেন, 'ও ব্যাট হাতে ছন্দ বজায় রাখুক। নিজের স্বাভাবিক খেলা খেললেই রান পাবে। ওর হাত ধরে পাকিস্তান শীঘ্রই বড় ট্রফি জিতবে।'


আরও পড়ুন: গায়ে জাতীয় পতাকা জড়িয়েই আর্শাদকে ছবি তোলার আহ্বান নীরজের, কী করলেন পাক অ্যাথলিট?


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামেও। যুক্ত হোন


https://t.me/abpanandaofficial