রিও দে জেনেইরো: এমিলিয়ানো মার্তিনেজ় বলছেন, আশৈশব তিনি মারাকানায় ফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখেছেন। আর্জেন্তিনা যে রবিবার ভারতীয় সময় ভোর সাড়ে পাঁচটায় কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজ়িলকে চ্যালেঞ্জ করবে, তার নেপথ্যে রয়েছে সেমিফাইনালে গোলপোস্টের নীচে মার্তিনেজ়ের অনবদ্য পারফরম্যান্স। যে টুর্নামেন্টের জন্য মেয়ের জন্মদিনে পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারেননি তিনি।
আর তিনি, লিওনেল মেসিও কি ভুলতে পেরেছেন মারাকানাকে? যে স্টেডিয়াম তাঁকে প্রথমবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। আর জার্মানির কাছে ফাইনালে হেরে স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল এই মারাকানাতেই। বিশ্বকাপ আর তাঁর দুই হাতের মধ্যে দূরত্বটা ছিল ঠিক চায়ের পেয়ালা আর ঠোঁটের মধ্যেকার ফাঁকের মতো। গানের ভাষায় যেন, কত কাছে কিন্তু তবু কত দূরে...
তাই রবিবারের মারাকানা তাঁর কাছেও শাপমোচনের মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে। যে কারণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখাচ্ছে এলএমটেন-কে। তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা অনেকেই বলছেন যে, আর্জেন্তিনা জার্সিতে কোনওদিন এত সংকল্পবদ্ধ দেখায়নি মেসিকে। নিজে গোল করছেন। তার চেয়েও বেশি গোল করাচ্ছেন। টুর্নামেন্টে এখনও পর্যন্ত ছ'টি ম্যাচ খেলেছেন। তার মধ্যে পাঁচটিতে ম্যাচের সেরা। বিপক্ষের জুতোর স্পাইকে বাঁ পায়ে গভীর ক্ষত হয়েছে। যে বাঁ পায়ের জাদু দেখতে রাতের পর রাত জাগে ফুটবলবিশ্ব, সেই বাঁ পা দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে রক্ত। ভিজে রক্তিম হয়েছে সাদা মোজা। মেসি অবিচল। নিজের চোট নিয়ে নির্লিপ্ত। চোয়াল কঠিন করে ফ্রি কিকের বল সাজিয়েছেন।
সাত বছর আগের এক জুলাইয়ের রাত ভুলতে পারেন না মেসি। কী করেই বা ভুলবেন গঞ্জালো হিগুয়াইন ও রদ্রিগো পালাসিও-র সেই অবিশ্বাস্য মিস! জার্মানির প্রায় ফাঁকা গোলে বল ঠেলতে না পারা। যা দেখে ফুটবল ঈশ্বরও হয়তো হেসেছিলেন। অবজ্ঞার হাসি। হয়তো তিনিও গোটা বিশ্বের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠেছিলেন, কী হে তুমি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার? তোমার যাবতীয় সাফল্য তো বার্সেলোনা জার্সিতেই সীমাবদ্ধ! দেশের হয়ে কোথায় আর নায়ক হতে পারলে? মারিও গোৎজের শট লা আলবিসেলেস্তে শিবিরে আঁধার নামিয়েছে। আর তিনি মাঠ ছেড়েছেন নতমস্তকে। নিয়তি মেনে নিয়ে।
ফুটবল ঈশ্বর তখনও হয়তো মুচকি হেসেছিলেন। তা নাহলে কী করেই বা ফের এক জুলাইয়ে মারাকানাতেই তিনি হাজির করলেন মেসিকে। ফের এক ফাইনালে। যে টুর্নামেন্ট ব্রাজ়িলে হওয়ার কথাই ছিল না, তাই কি না সাম্বার দেশে হাজির। হোক না সে কোপা আমেরিকা, না হোক বিশ্বকাপ, ফাইনাল তো বটে!
এবারও মেসির পাশে নেই দুর্দান্ত কোনও তারকা। বার্সা জার্সিতে জ়াভি-ইনিয়েস্তাদের মাপের ফুটবলার বাদ দিন। মেসির কাছে আর্জেন্তিনা জার্সিতে বরাবরই তা অলীক কল্পনা বই কিছু নয়। কিন্তু নিদেনপক্ষে দুরন্ত ফর্মে থাকা একটা সের্জিও আগুয়েরো বা অ্য়াঙ্খেল দি মারিয়াও নেই। প্রথমজনকে তো কোচ লিওনেল স্কালোনি সব ম্যাচে খেলাতেই পারছেন না। আর দ্বিতীয়জন খেলছেন পরিবর্ত হিসাবে। তবু মেসির বাঁ পা খুঁজে নিচ্ছে তেকাঠি। আর নিজে গোল করার পাশাপাশি কখনও গোলের ঠিকানা লেখা বল বাড়িয়ে দিচ্ছেন নবাগত লউতারো মার্তিনেজ় বা পাপু গোমেজকে, কখনও রদ্রিগো দে পল-কে। যিনি আবার কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে গোল নষ্ট করে একটা সময় মেসির হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আর এই অনভিজ্ঞ সতীর্থদের নিয়েই চলছে মেসির সংগ্রাম। কতটা মরিয়া সেই লড়াই? পাশাপাশি দুটি ছোট্ট তথ্য সাজিয়ে দেওয়া যাক।
সমালোচকেরা বলে থাকেন, মেসি তো স্পেনের, আর্জেন্তিনার হল কবে? মেসিকে নাকি কোনওদিন আর্জেন্তিনার জাতীয় সঙ্গীতের সময় মাঠে ঠোঁট নাড়তে দেখা যায় না। দলের জয়ে উল্লাস করেন না। ড্রেসিংরুমে নাকি নীরব থাকেন।
সেই মেসিই সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার সেরা স্ট্রাইকার ইয়েরি মিনা টাইব্রেকারে গোল নষ্ট করার পর লাফিয়ে উঠলেন। প্রবল চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন, 'বাইলা আহোরা, বাইলা আহোরা'। স্পেনীয় ভাষা। বাংলা করলে কি দাঁড়ায় জানেন? 'নাচো, এবার নাচো'। কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে কলম্বিয়া জেতার পর মিনা নেচেছিলেন। মেসি সেমিফাইনালে বিদ্রুপ ছুড়ে দিলেন মিনাকে। মেসির মতো আপাত শান্ত ফুটবলার, প্রতিপক্ষের কড়া ট্যাকলেও যিনি মুখ খোলেন না, বড় জোড় কার্ড দেখানোর আবেদন করেন, তিনি কি না স্লেজিং করছেন বিপক্ষকে!
আসলে এই মেসি মরিয়া। এই মেসি ট্রফি ছাড়া কিছু দেখছেন না। এই মেসি বুঝে গিয়েছেন, সারাবছর ক্লাবের জার্সিতে ডজ়-ড্রিবল-ফ্রি কিকের জাদুতে যতই বিশ্ব মোহিত হোক না কেন, এবারও না পারলে সেই অপ্রীতিকর প্রশ্ন তো আজীবন তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করবেই। তুমি নাকি বিশ্বের সেরা ফুটবলার? দেশের হয়ে কী করেছো বাপু?
আর উত্তর হাতড়ে বেড়াবেন মেসি। ছোটবেলা যাঁর ফুটবল দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে টিস্য়ু পেপারে চুক্তি পাকা করে ফেলেছিলেন বার্সেলোনার পোড়খাওয়া ফুটবল কর্তা। সেসব বৃত্তান্ত ফুটবল ইতিহাসের পাতায় গল্প হয়েই থেকে যাবে। আর বাস্তবের রূঢ়, রুক্ষ জমি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পায়ের তলা থেকে ক্রমশ সরে যেতে থাকবে। সরেই যাবে।
ব্রাজ়িলের বিরুদ্ধে ফাইনালের আগে আর্জেন্তিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি বলেছেন, 'নিজেকে সেরা প্রমাণ করার জন্য মেসিকে কোপা আমেরিকা জিতে দেখাতে হবে না।'
যা শুনে মেসি যে একেবারেই আশ্বস্ত হননি, নিজেকে নিরাপদ ভেবে মুখ ফেরাননি, বলাই বাহুল্য। ফের রানার্স হয়ে ফিরলে তাঁর রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না। বরং মারাকানার পুরনো ঘা ফের খুঁচিয়ে উঠবে। অদৃশ্য যন্ত্রণায় হয়তো কাতরাতে থাকবে সাড়ে পাঁচ ফিটের সামান্য বেশি উচ্চতার অবয়ব।
অনুরাগীরা বলবেন, কী হয়েছে? পুসকাস-ইউসেবিও-প্লাতিনিরাও তো পারেননি! সোশ্যাল মিডিয়ায় মেসির সমর্থনে ঝড় উঠবে।
মেসি রানার্সের জন্য বরাদ্দ সান্ত্বনার ঝড় চাইবেন না। জয়মালা পরেই মাঠ ছাড়তে চাইবেন। আর্জেন্তিনার জার্সিতে প্রথম বড় ট্রফি জিতে। প্রিয় বন্ধু নেমার ও তাঁর দলবলকে হারিয়ে।
ফাইনালের আগের দিন মেসি হয়তো সারারাত ভেবে যাবেন, ফুটবল ঈশ্বর মারাকানায় কী চিত্রনাট্য সাজাচ্ছেন তাঁর জন্য!
কখন, কোথায় দেখবেন ম্যাচ: আর্জেন্তিনা বনাম ব্রাজ়িল খেলা শুরু ভোর ৫.৩০। ম্যাচ দেখা যাবে সোনি সিক্স, সোনি টেন ওয়ান, সোনি টেন থ্রি, সোনি টেন ফোর চ্যানেল ও সোনি লিভ অ্যাপে।