কলকাতা: বিশ্ব ফুটবলে এরকম মাহেন্দ্রক্ষণ খুব কমই এসেছে। যখন প্রায় একই সঙ্গে শুরু হতে চলেছে বিশ্বের সেরা দুই ফুটবল টুর্নামেন্ট। ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ইউরো কাপ। আর দক্ষিণ আফ্রিকার ফুটবল গরিমার মঞ্চ কোপা আমেরিকা। আমি নিজে ব্রাজিলের ভক্ত। তাই কোপা আমেরিকা দেখার জন্য তর সইছে না।


যদিও দশ দলের টুর্নামেন্ট কোপা আমেরিকা নিয়ে আলোচনা করতে বসে শুরুতেই দেখে নেব গ্রুপ 'এ'। এই গ্রুপে রয়েছে আর্জেন্তিনা, বলিভিয়া, উরুগুয়ে, চিলি ও প্যারাগুয়ে। ভীষণ কঠিন এই গ্রুপ। দুটি গ্রুপ থেকেই চারটি করে দল নক আউট পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। এ গ্রুপ থেকে কোন চারটি দল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠবে, আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করা ভীষণ কঠিন। কারণ, দলগুলির মধ্যে ব্যবধান বেশ কম। যে কোনও দল হিসেব নিকেশ উল্টে দিতে পারে। তাই কোনও দলকে ছোট ভাবার জায়গাই নেই।


তবে এই গ্রুপে সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকবে আর্জেন্তিনা। আর ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ছাড়া ফুটবলে যে দুই দলকে ঘিরে বাঙালির আবেগ আবর্তিত হয়, সেই দুটি হল ব্রাজিল ও আর্জেন্তিনা।


আর্জেন্তিনার প্রাণভোমরা অবশ্যই লিওনেল মেসি। মহাতারকা মেসি কী করে, তার দিকে সকলের নজর থাকবে। মেসিকে নিয়ে আলোচনা করতে বসলেই অবধারিতভাবে উঠবে সেই প্রশ্ন। দেশের জার্সিতে কি বড় কোনও ট্রফি জিততে পারবে মেসি? অলিম্পিক্সে সোনা জয় ছাড়া বিশ্ব ফুটবলের কুলীন টুর্নামেন্টে কোনও ট্রফি নেই মেসির। বিশ্বকাপের ফাইনালে হার, কোপা আমেরিকার ফাইনালে দুবার উঠে দুবারই পরাজয়। ব্য়র্থতা আর হতাশায় তো একবার অবসরই ঘোষণা করে ফেলেছিল। পরে অবশ্য সেই সিদ্ধান্ত বদলে ফের মাঠে ফিরেছে। এবারের কোপা আমেরিকায় ফের মেসির সামনে দেশকে ট্রফি দেওয়ার সুযোগ।


আর্জেন্তিনা দলটা ভাল। তবে আহামরি নয়। ব্রাজিলের সঙ্গে তুলনা করতে পারব না কারণ, ব্রাজিল এই আর্জেন্তিনার চেয়ে অনেক এগিয়ে। মেসির ওপর দলটা অতিরিক্ত মাত্রায় নির্ভরশীল। ব্রাজিল দলটা খুঁটিয়ে দেখুন, নেমারকে বাদ দিয়েও প্রত্য়েক পোজিশনে দারুণ সমস্ত ফুটবলার রয়েছে। আর্জেন্তিনা দলে অত বৈচিত্র নেই। দলটা ভীষণরকম মেসির মুখাপেক্ষী। আর প্রত্যেক দলই মাঠে নামার আগে মেসিকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে ফেলে। কোনও দলই চায় না মেসির মতো বল প্লেয়ারকে ফাঁকা জায়গা দিতে। তাই মেসির জন্য থাকে চক্রব্যূহ। যা কাটিয়ে ওঠা মেসির পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে যায়। বার্সেলোনায় ও পাশে এমন কয়েকজন সতীর্থকে পায় যারা মেসির বাড়ানো বল ধরে গোল করতে পারে। আর্জেন্তিনায় সেদিক থেকে ও চাপে থাকে।


কোপা আমেরিকা শুরুর ঠিক মুখে একটা বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে আর্জেন্তিনা। কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনকারী পর্বের ম্য়াচে বুধবার ঘাড়ে ও মাথায় বিশ্রী চোট পেয়েছে লা আলবিসেলেস্তের গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেস। অ্যাস্টন ভিলার হয়ে এবার দুরন্ত ফর্মে ছিল মার্তিনেস। বহু বছর পর আর্জেন্তিনা একজন খুব ভাল গোলকিপার পেয়েছে। নিজে গোলকিপার হওয়ার জন্য জানি, তিন কাঠির নীচে ক্ষিপ্রতা, অনুমান ক্ষমতা ও রিফ্লেক্সই সাফল্য়ের চাবিকাঠি। এই তিনটি গুণই রয়েছে মার্তিনেসের। কিন্তু কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে যেভাবে চোট পেয়েছে আমার মনে হয় না তাড়াতাড়ি মাঠে ফিরতে পারবে। ম্য়াচ ফিট হয়ে ওঠাটা বেশ কঠিন। কোপা আমেরিকার মতো একটা বড় টুর্নামেন্টের আগে দলের এরকম একজন গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারের চোট পাওয়াটা যে কোনও দলের কাছে দুশ্চিন্তার বিষয়। অনেক অঙ্ক বদলে যাবে।


আর্জেন্তিনার রিজার্ভ বেঞ্চ মোটামুটি। অ্যাঙ্খেল দি মারিয়া, সের্খিও আউয়েরোরা রয়েছে। যদি ক্লাব ফুটবলের কথা ধরি, নিকোলাস ওতামেন্দি খুব ভাল ফর্মে রয়েছে। ক্রিস্তিয়ান রোমেরো ক্লাব ফুটবলে নজর কেড়েছে। ওর ট্রান্সফার নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। বুধবার কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম গোলটা ওই করল। প্যারিস সঁ জরমঁ-র মিডফিল্ডার লিয়েন্দ্রো পারিদেজ়ও কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে গোল করল। পাশাপাশি দে পল, লউতেরো মার্তিনেজ়রা বেশ ভাল ফর্মে রয়েছে। আর্জেন্তিনাকে দল হিসাবে কখনওই উপেক্ষা করা যাবে না। লিওনেল স্কালোনির তিন ফরওয়ার্ড মেসি, গঞ্জালেস ও মার্তিনেস বিশ্বমানের। তবে অতিরিক্ত মেসি নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে হবে নীল-সাদা জার্সিধারীদের।


সেই তুলনায় চিলি ও উরুগুয়ে বেশ ভাল টিম। চিলির বিরুদ্ধে বেগ পেতে হবে আর্জেন্তিনাকে। আমার তো মনে হয় চিলি এই গ্রুপের সবচেয়ে বিপজ্জনক দল। প্রত্যেকবার সাইলেন্ট কিলারের ভূমিকা পালন করে। নীরবে আসে অথচ মাঠে নেমে কার্যকরী ফুটবল খেলে প্রতিপক্ষের ঘুম উড়িয়ে দেয়। পরিসংখ্যান দেখলেও ওদের হিসেবের বাইরে রাখা সম্ভব নয়। গত তিনবারের কোপা আমেরিকায় দুবার চ্যাম্পিয়ন চিলি। তাও দুবারই আর্জেন্তিনাকে হারিয়ে। উরুগুয়ে দলেও রয়েছে লুইস সুয়ারেজ়, এডিনসন কাভানির মতো ফুটবলার। বড় মঞ্চে কীভাবে খেলতে হয় জানে। সব মিলিয়ে জমজমাট লড়াই অপেক্ষা করে রয়েছে গ্রুপ এ-তে।


*সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন: সন্দীপ সরকার