কলকাতা: রাজায় রাজায় যুদ্ধে প্রাণ গেল উলুখাগড়ার? নাকি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা?
সিএবি (CAB) পরিচালিত স্থানীয় ক্রিকেটের টি-২০ টুর্নামেন্ট জে সি মুখোপাধ্যায় ট্রফিতে (JC Mukherjee Trophy) কুমারটুলি বনাম টালিগঞ্জ অগ্রগামী ম্যাচে ৪ বলে আম্পায়ার একটি ওভারের সমাপ্তি ঘোষণা করে দেওয়ায় তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। বেনজির ঘটনায় তোলপাড় পড়েছিল সিএবি-তে। টুর্নামেন্ট কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিল টালিগঞ্জ। বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জেরে সবচেয়ে জোরাল ধাক্কা খেতে হয়েছিল যাদের। কারণ, কার্যত জেতা ম্যাচ হেরে গিয়েছিল টালিগঞ্জ। যে ঘটনার কথা আগেই লিখেছিল এবিপি আনন্দ।
শুক্রবার সেই অভিযোগ নিয়ে বৈঠক ডেকেছিল সিএবি-র টুর্নামেন্ট কমিটি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, ৪ বলে ওভার সমাপ্ত করে দেওয়ার অপরাধে ম্যাচ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত তিনজনকে নির্বাসিত করা হবে। বৈঠকের শেষে টুর্নামেন্ট কমিটির প্রধান নীতীশ রঞ্জন দত্ত (অনু) এবিপি আনন্দকে বললেন, 'কুমারটুলি বনাম টালিগঞ্জ ম্যাচের মাঠের দুই আম্পায়ার স্বস্তিক দত্তচৌধুরী ও দেবতোষ মুস্তাফি এবং ম্যাচ অবজার্ভার দীপ্তেন্দু মাহাতাকে ২ মাসের জন্য নির্বাসিত করা হচ্ছে।'
শাস্তির যে সিদ্ধান্ত বেশ বেনজির বলেই মনে করছে ময়দান। পাশাপাশি জোরালভাবে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে, কেন গোটা ঘটনার দায় চাপানো হল শুধু মাঠের দুই আম্পায়ার ও পর্যবেক্ষকের ওপর? কেন ম্যাচ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আরও তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি - তৃতীয় আম্পায়ার সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় ও দুই স্কোরার শুভম মণ্ডল ও অতনু জানাকে ছাড় দেওয়া হল? এই প্রশ্নও তোলা হচ্ছে যে, সিএবি শাস্তি দিল মানে ধরেই নেওয়া হল সংশ্লিষ্ট ম্যাচে অন্যায় হয়েছে। তা হলে কেন যে ক্লাবের কার্যত নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হল, সেই টালিগঞ্জ অগ্রগামীর ক্ষতিপূরণ করা হল না? কেন টালিগঞ্জকে পয়েন্ট দেওয়া হল না? যাদের টুর্নামেন্টের পরের পর্বে যাওয়াই এখন অনিশ্চিত।
ঠিক কী ঘটেছিল?
রেঞ্জার্স মাঠে গত মঙ্গলবার প্রথম ডিভিশনের জে সি মুখোপাধ্যায় টি-২০ টুর্নামেন্টে কুমারটুলি বনাম টালিগঞ্জের ম্যাচের ঘটনা। আগে ব্যাটিং করে ২০ ওভারে কুমারটুলি তুলেছিল ৪ উইকেটে ১৭০ রান। জবাবে টালিগঞ্জ ১৬৮ রানে আটকে যায়। মাত্র ২ রানে ম্যাচ হারে। অভিযোগ ওঠে, টালিগঞ্জ ইনিংসের ১৯তম ওভারে দুটি বল কম খেলানো হয়। চার বলেই ওভারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন আম্পায়ার স্বস্তিক দত্তচৌধুরী। পরে জানা যায়, মাঠের দুই আম্পায়ার ও স্কোরারদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিতেই এমন ঘটনা। পরে আম্পায়ার নিজেও নাকি স্বীকার করে নেন যে, তিনি স্কোরারের ইঙ্গিত বুঝতে ভুল করেছিলেন।
যদিও গোটা ঘটনায় অনেকেই গভীর অভিসন্ধি খুঁজে পেয়েছেন। বলা হচ্ছে, ওই দুই বল কম না খেলালে নির্ধারিত সময়ে ২০ ওভার শেষই করতে পারত না কুমারটুলি। নির্দিষ্ট সময়ে এক ওভার কম বল করত তারা। সেক্ষেত্রে নিয়ম মেনে পেনাল্টি পেত টালিগঞ্জ। ম্যাচও জিতে যেত অনায়াসে। সেটা আটকাতে ও কুমারটুলিকে সুবিধা করে দিতেই ১৯তম ওভার দ্রুত শেষ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ।
এমনিতেই স্থানীয় ক্রিকেটে আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি গুরুতর সব অভিযোগ সামনে আসছে। ক্ষোভের যে বারুদে শুধুমাত্র অগ্নিসংযোগের কাজটি ঘটিয়েছে কুমারটুলি-টালিগঞ্জ ম্যাচ।
প্রশ্ন উঠছে সিএবি-র আম্পায়ার্স কমিটি নিয়েও। যে কমিটির চেয়ারম্যান প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি বকলমে কুমারটুলি ক্লাবের সর্বময় কর্তা। যাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে ময়দানের সব ক্লাবেই গুরুতর সংশয়ের আবহ। ঘটনাচক্রে, যে সমস্ত ম্যাচ নিয়ে বিতর্ক বাঁধছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জড়িয়ে যাচ্ছে কুমারটুলির নাম। প্রশ্ন উঠছে, পুরোটাই কি কাকতালীয়, নাকি রয়েছে সুপরিকল্পিত নকশা?
বলা হচ্ছে, প্রসেনজিৎ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ শিবিরের অঙ্গুলিহেলনে স্থানীয় ক্রিকেটে পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিং চলছে। এমনকী, সিএবি-তেও নাকি 'থ্রেট কালচার' চলছে। যে কারণে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে। ময়দানের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্তা ক্ষোভে ফুঁসছেন। কেউ কেউ সিএবি-র টুর্নামেন্ট কমিটির শুক্রবারের বৈঠকে শাস্তির সিদ্ধান্ত শুনেও হতবাক। ম্যাচ পরিচালনায় দায়িত্বে থাকেন যাঁরা, সেই প্লেয়ার্স কন্ট্রোল টিম (PCT)-এ মাঠের দুই আম্পায়ার ও অবজার্ভার ছাড়াও ছিলেন দুই স্কোরার ও তৃতীয় আম্পায়ার সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন শুধু দুই আম্পায়ার ও অবজার্ভারকে নির্বাসিত করা হল, জোরাল প্রশ্ন উঠছে। বলা হচ্ছে, সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান প্রসেনজিতের ঘনিষ্ঠ বলেই ছাড় পেয়ে গেলেন। টুর্নামেন্ট কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে তাই সন্তুষ্ট হতে পারছে না ময়দান।
প্রশ্ন উঠছে স্কোরারদের মান নিয়েও। আম্পায়ারদের ক্ষেত্রে গ্রেডেশন রয়েছে। গ্রেড অনুযায়ী ম্যাচ ও পারিশ্রমিক পান আম্পায়াররা। কিন্তু স্কোরার বা অবজার্ভারদের ক্ষেত্রে সেরকম কোনও ভাগ নেই। যা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে ময়দানে। কেউ কেউ স্কোরার হিসাবে এক বা দুই দশক কাটিয়ে ফেলেও ম্যাচে দিন প্রতি যা পারিশ্রমিক পান, চলতি মরশুমে স্কোরার হিসাবে অভিষেক ঘটানো কেউও সেই একই ম্যাচ ফি পান। মোটামুটিভাবে যা দৈনিক ১০৪৫ টাকা। অবজার্ভারদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ডিভিশন ম্যাচে দৈনিক ১১৫০ ও প্রথম ডিভিশনের ম্যাচে দৈনিক ১৬৫০ টাকা করে দেওয়া হয়। স্কোরার ও অবজার্ভারদেরও অবিলম্বে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী গ্রেডেশন চালু করার দাবি তুলছে ময়দানের বৃহৎ একটা অংশ।
সব মিলিয়ে স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সিএবি-র গোটা ঘটনা সরেজমিনে খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা উচিত বলেই দাবি ময়দানের বিভিন্ন ক্লাবের।