সন্দীপ সরকার, কলকাতা: হকির নয়, এ যেন ক্রিকেটের কবীর খান।
চেয়েছিলেন ক্রিকেটার হিসাবে প্রতিষ্ঠা। প্রতিশ্রুতিও ছিল তাঁর খেলায়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক হাজারো প্রতিবন্ধকতায় আর বাইশ গজে ডালপালা বেশিদূর মেলে হয়ে ওঠা হয়নি।
সেই জয়ন্ত ঘোষ দস্তিদারই (Jayanta Ghosh Dastidar) যখন ক্রিকেট কোচিংয়ে এলেন, একের পর এক মুকুট জিতে নিতে শুরু করলেন। নিজের কেরিয়ারের আক্ষেপ যেন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মিটিয়ে নিচ্ছেন। ‘চক দে ইন্ডিয়া’ সিনেমায় ঠিক যেমনটা করেছিলেন শাহরুখ ‘কবীর’ খান। থুড়ি, পর্দায় কেন, বাস্তবেও তো রয়েছে এক চরিত্র। অভিনয়ের মাধ্যমে যাঁকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শাহরুখ। মীররঞ্জন নেগি। কেরিয়ারের কালিমা যিনি মুছেছিলেন কোচ হিসাবে সাফল্যে।
জয়ন্তর কেরিয়ারে কালি সেই অর্থে ছিল না। ছিল কাঁটা।
দমদম স্টেশনের অদূরে বাড়ি। ছাপোষা সংসারের ছেলে চেয়েছিলেন নামী ফাস্টবোলার হতে। যাঁরা ময়দানে তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে দেখেছেন, সকলেই মেনে নেন যে, জয়ন্তর মতো প্রতিভার আরও বিকশিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ক্রিকেট ঈশ্বর হয়তো তা চাননি।
না হলে বাঙালি যে পেসার একদিন রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে খেলেছেন, তিনিই কি না পর্যাপ্ত সুযোগের অপেক্ষায় হারিয়ে যান!
কিন্তু ফিরে এসেছেন জয়ন্ত। ক্রিকেট মাঠে শুরু করেছেন দ্বিতীয় ইনিংস। কোচ হিসাবে। আর নতুন ইনিংসে জিতেছেন ত্রিমুকুট। একই বছরে সিনিয়র আর অনূর্ধ্ব ২৩-এ চ্যাম্পিয়ন বাংলার মহিলা দলের কোচ ছিলেন। এবার কোচ হিসাবে বাংলাকে দিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অনূর্ধ্ব ১৫ মেয়েদের ওয়ান ডে ট্রফি।
তিন বছর হল অনূর্ধ্ব ১৫ টুর্নামেন্ট চালু করেছে ভারতীয় বোর্ড। প্রথম বছর বাংলার অনূর্ধ্ব ১৫ দলের হেড কোচ ছিলেন চরণজিৎ সিংহ। জয়ন্ত ছিলেন সহকারী। পরের বার জয়ন্ত হন প্রধান কোচ। সহকারী করা হয় অনন্যা মিত্রকে। হেড কোচ হিসাবে প্রথমবারই নজরকাড়া পারফরম্যান্সের পরেও মোহালিতে সেমিফাইনালে হরিয়ানার কাছে হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচে হেরে যায় জয়ন্তর বাংলা। অভিযোগ, সেবার বিভিন্ন রাজ্য ক্রিকেট সংস্থা মেয়েদের দল তৈরি করতেই হিমশিম খাচ্ছিল বলে কিছুটা নমনীয় হয়েছিল ভারতীয় বোর্ড। বয়স নির্ধারণের জন্য যে হাড়ের পরীক্ষা হয়, তা শিথিল করা হয়েছিল। বাংলা শিবিরের অনেকে নিশ্চিত যে, বয়সের চেয়ে বড় মেয়েদের খেলিয়ে ম্যাচ জিতেছিল হরিয়ানা। চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল হরিয়ানাই।
এবার যেন সেই শাপমুক্তি। অপরাজিত থেকে বোর্ডের অনূর্ধ্ব ১৫ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন বাংলা। এমনকী, গোটা মরশুমে একটিও ম্যাচ হারেনি বাংলার অনূর্ধ্ব ১৫ মেয়েদের দল। বোর্ডের টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে গ্বালিয়রে পাঁচ ম্যাচের সবকটি জেতে বাংলা। অরুণাচল প্রদেশের বিরুদ্ধে রেকর্ডও গড়ে। ৩৭০ রানে ম্যাচ জিতে। ৩৫ ওভারে বাংলা ৩৮৭ রান তুলেছিল। ১৭ রানে অল আউট হয়ে যায় অরুণাচল প্রদেশ। গ্রুপ পর্বে পাঞ্জাবকেও বিধ্বস্ত করে জিতেছিল বাংলা।
গর্বিত জয়ন্ত বলছেন, 'সকলে মিলে পারফর্ম করেছে। আমার অধিনায়ক সন্দীপ্তা পাত্র দারুণ খেলেছে। টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ও। ৮ ম্যাচে ৩৭০-এর ওপর রান।'
গতবার সেমিফাইনালে হারের ধাক্কা মেনে নিতে পারেননি জয়ন্ত। অনেকদিন ধরেই নিয়েছিলেন এবারের টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি। বলছিলেন, 'সিএবি-কে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, অনূর্ধ্ব ১৫ দলের জন্য ওপেন ট্রায়াল করব। ইডেন গার্ডেন্সের ইন্ডোরে ট্রায়ালে এসেছিল প্রায় ১৩০ জন। সেখান থেকে ৩৫ জনকে বাছা হয়। পরে দল আরও ছোট করে ২৬ জনের করা হয়। সিএবি-ও খুব সহযোগিতা করেছে।'
ঘর গোছানোর সেই শুরু। জয়ন্তর কথায়, 'সন্দীপ্তা পাত্র ও ঈপ্সিতা মণ্ডল বেঙ্গল প্রো টি-টোয়েন্টিতে মহিলাদের ফাইনালেও নজর কাড়ে। দুজনই অনূর্ধ্ব ১৫। এছাড়া বল হাতে বোর্ডের গোটা টুর্নামেন্টে এবার দারুণ পারফর্ম করেছে দেবযানী দাস। টুর্নামেন্টে যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। চায়নাম্যান স্পিনার। গতবারও ছিল সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিক সহ পাঁচ উইকেট নিয়েছিল চুঁচুড়ার ১৪ বছরের কিশোরী। সঙ্গে অদ্রিজা সরকারও নজর কেড়েছে।'
এরকম এক-একটা মুক্তো দিয়েই মালা গেঁথেছেন জয়ন্ত। যিনি তিন ট্রফির মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুশি অনূর্ধ্ব ১৫ চ্যাম্পিয়ন হতে পেরে। কেন? ‘কারণ, এখানে চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি। প্রত্যেক বছর সম্পূর্ণ নতুন দল গড়ে অনুশীলন করাতে হয়। শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। এবারই যেমন গতবারের দলের থেকে মাত্র দুজনকে পেয়েছিলাম। দেবযানী দাস ও সন্দীপ্তা পাত্র। আর একজন ছিল, তবে সে মূল দলে সুযোগ পায়নি। বাকি সকলে নতুন,' বলছিলেন জয়ন্ত।
২০১৮-১৯ মরশুমে সিনিয়র ও অনূর্ধ্ব ২৩ – পরপর ট্রফি জেতান জয়ন্ত। পরেরবার হন তেইশ দলের প্রধান কোচ। মাঝে একবার অনূর্ধ্ব ১৯ পুরুষ দলের কোচিং স্টাফে দেবাঙ্গ গাঁধীর সহকারী ছিলেন। অভিষেক পোড়েল, রবি কুমারদের উত্থানের নেপথ্যেও তাঁর অবদান। সিনিয়র দলের কোচ থাকাকালীন রিচা ঘোষের ক্রিকেটীয় পরিচর্যাও জয়ন্তর হাতে।
ক্রিকেটার হিসাবে স্বপ্নপূরণের আগে থেমে যাওয়ার যন্ত্রণার উপশম কি হচ্ছে কোচ হিসাবে সাফল্যে? জয়ন্ত বলছেন, 'আমি যেটা পারিনি, ওরা সেটা করে দেখাচ্ছে, ভাল লাগছে। ভারতীয় দলে খেলার স্বপ্ন সকলেরই থাকে। আমি ভারতের যুব দলে খেলেছি। সিনিয়র দলে খেলার স্বপ্নপূরণ হয়নি। ছাত্রীদের সাফল্যে সেই আক্ষেপ কিছুটা তো মিটছেই।'
কেন বাংলার হয়ে মাত্র ৩টি রঞ্জি ম্যাচ খেলেই আটকে থাকতে হয়েছিল জয়ন্তকে? ময়দানে কান পাতলেই শোনা যায় সেই কাহনি। সেই সময় সিএবি স্থানীয় ক্রিকেটে নিয়ম ছিল, কোনও ক্লাবই তিনজনের বেশি রঞ্জি ট্রফির ক্রিকেটার প্রথম একাদশে রাখতে পারবে না। জয়ন্ত তখন খেলেন ইস্টবেঙ্গলে। সঙ্গে শ্রীকান্ত কল্যাণী, শরদিন্দু মুখোপাধ্যায় ও দত্তাত্রেয় মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন সেই দলে। তাই নিয়মিত খেলতে পারেননি। সেমিফাইনালে পারফর্ম করেও ফাইনালে বাইরে বসতে হয়েছে। যা কেরিয়ারকে কিছুতেই মাথাচাড়া দিতে দেয়নি। পরে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে কালীঘাটে যোগ দেন। কালীঘাটের হয়ে জেসি মুখোপাধ্যায় টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে একাই নিয়েছিলেন ৯ উইকেট।
ইডেনে লালচাঁদ রাজপুত, সুলক্ষণ কুলকার্নিদের অসমের বিরুদ্ধে ম্যাচে রঞ্জি অভিষেক। প্রথম ইনিংসে ৩ স্পেলে ১১ ওভার বল করে নেন তিন উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৫ ওভার বল করে এক উইকেট। বাংলার সেই দলে জয়ন্তর সঙ্গেই জোরে বোলিং বিভাগে ছিলেন সাগরময় শেনসর্মা ও রাজীব শেঠ। সঙ্গে স্পিনার শরদিন্দু মুখোপাধ্যায় ও অনুপ দাস। কখনও খেলতেন উৎপল চট্টোপাধ্যায়।
ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলেছেন জয়ন্ত। বলছিলেন, 'সেই দলের অধিনায়ক ছিল রাহুল দ্রাবিড়। সঙ্গে সুজিত সোমসুন্দর, ডেভিড জনসন।' কেরিয়ারে স্মরণীয় মুহূর্ত? 'বুচিবাবু টুর্নামেন্টে খেলেছিলাম। তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে ম্যাচে বাউন্সারে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তকে আউট করেছিলাম। অনূর্ধ্ব ১৫ ও অনূর্ধ্ব ১৭ আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। অনূর্ধ্ব ১৫ জোনে সেরা বোলার হয়েছিলাম। অনূর্ধ্ব ১৭ জোন টুর্নামেন্টের ফাইনালে সৌরভের সঙ্গে খেলেছি। ফাইনালে ব্যাট হাতে ম্যাচ জেতাই,' বলছিলেন জয়ন্ত।
চেন্নাইয়ে ভারতীয় দলের ট্রায়ালে ডাক পেয়েছিলেন। নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজের আগে সেই ট্রায়ালে কারচুপি হয়েছিল বলেও অভিযোগ। জয়ন্তকে নেটে মন্থর গতিতে বল করতে বলেন অসমের এক নির্বাচক। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাই করেন জয়ন্ত। পরে দেখা যায়, অসমের এক ক্রিকেটার দলে ডাক পেয়েছেন।
দ্রাবিড়ের সঙ্গে এখনও সুসম্পর্ক। জয়ন্ত বলছিলেন, 'রাহুল এখনও কদর করে। ইডেনের ড্রেসিংরুমে আমাকে ডেকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমাদের গ্রুপ ছবি দেখে নস্ট্যালজিক হয়ে পড়েছিল। সকলের নাম মনে রেখেছে ও। পরে বেঙ্গালুরুতে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতেও দেখা হয়েছে। গল্প, আড্ডা হয়েছে। একমাস জাতীয় শিবিরে একসঙ্গে ছিলাম।'
কোচিংয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন কবে? 'তখন এরিয়ান্সে খেলি। সত্রাজিৎ লাহিড়ী তখন আম্পায়ারিং করছে। আমাকে আম্পায়ারিংয়ে আসার প্রস্তাব দেয়। আমার আগ্রহ ছিল না। তখন বলে, তা হলে কোচিং কর। তারপর লেভেল এ কোর্স করি। ২০০৮ সালে। তারপর ২০১২ সালে লেভেল বি পাশ করি। কোচিং উপভোগ করতে শুরু করি। আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এখন বাচ্চাদের শিখিয়ে খুব ভাল লাগে। কেউ শিখতে আগ্রহী দেখলে দারুণ লাগে। একটা বাচ্চার উন্নতি দেখতে দারুণ লাগে,' বলছিলেন জয়ন্ত।
জয়পুরে ফাইনালে পাঞ্জাবকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন। ফাইনালের আগের দিনও কবীর খান সুলভ সংলাপ শোনা গিয়েছিল জয়ন্তর মুখে। নিজেই শোনালেন সেই গল্প। বললেন, 'ফাইনালের আগের দিন রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। উত্তেজনায়। প্রতিপক্ষ পাঞ্জাব। তার আগের দিনই মেয়েদের বলেছিলাম, এতদিনের খাটনি যেন জলে না যায়। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলে কেউ তাকাবে না। দাঁড়িয়ে দেখবে পাঞ্জাবের ক্রিকেটারেরা ছবি তুলছে, উৎসব করছে। সেটা ভাল লাগবে তো?'
ঠিক যেন পর্দার শাহরুখ। ফাইনালের আগে তাঁর মুখে বিখ্যাত সেই বাক্য, 'ইয়ে সত্তর মিনিট।'
ছাত্রীরা হতাশ করেনি। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। জয়ন্তর গলায় উচ্ছ্বাস, 'পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই আমার দুই ওপেনার, বিশেষ করে অদ্রিজা শুরু থেকে যে রকম আগ্রাসী ব্যাটিং করে, ম্যাচের রং পাল্টে যায়।'
ত্রিমুকুটে নবজাগরণ দমদমের ক্রিকেটারেরও।
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।