সন্দীপ সরকার, কলকাতা: বুধবার সকালে খবরটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ক্রিকেটবিশ্ব। ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া (India vs Australia) বর্ডার-গাওস্কর সিরিজ (Border Gavaskar Trophy) চলাকালীনই অবসর ঘোষণা করেছেন আর অশ্বিন (Ravichandran Ashwin)। ব্রিসবেন টেস্ট ড্র হওয়ার পরই যে খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতীয় ক্রিকেটে অশ্বিনের অবদান কী? প্রশ্নটা করা হয়েছিল সৌরাশিস লাহিড়ীকে। এক মুহূর্ত না ভেবে প্রাক্তন অফস্পিনার এবিপি আনন্দকে বললেন, 'ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে যদি সেরা তিন ম্যাচ উইনারকে বেছে নিতে বলা হয়, প্রথম তিনে থাকবে আর অশ্বিন। আমি সুনীল গাওস্কর, কপিল দেব, অনিল কুম্বলে, রাহুল দ্রাবিড়, বিরাট কোহলি, সকলের কথা মাথায় রেখেই বলছি। এত বড় কিংবদন্তি। ক্রিকেট মাঠে ওর প্রভাব বিশাল।'
মনে করিয়ে দেওয়া যাক, সৌরাশিস নিজে ছিলেন অফস্পিনার। অশ্বিনের বিরুদ্ধেও অনেক ম্যাচ খেলেছেন। ভিশন ২০২০ প্রকল্পে একসময় কাছ থেকে দেখেছেন, কাজ করেছেন কিংবদন্তি মুথাইয়া মুরলীধরনের সঙ্গে। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর কোচিংয়ে যুক্ত ময়দানের 'প্যাটশি'। যাঁর ক্রিকেটীয় দৃষ্টিভঙ্গি সকলের কাছেই প্রশংসিত।
অশ্বিন প্রসঙ্গে সেই সৌরাশিসই বলে চললেন, 'দু’ধরনের ক্রিকেটার রয়েছে। অনেকে পারফর্ম করে। অনেকে ম্যাচ জেতায়। রবিচন্দ্রন অশ্বিন পুরোপুরি ম্যাচ উইনার। ভারতকে অজস্র ম্যাচ জিতিয়েছে। বিশেষ করে ঘরের মাঠে এরকম দাপট আমি আর কারও বোলিংয়ে দেখিনি। মুথাইয়া মুরলীধরন হোক বা জিমি অ্যান্ডারসন, অশ্বিনের মতো ঘরের মাঠে এত টেস্ট ম্যাচ কেউ জেতায়নি।' যোগ করলেন, 'সবচেয়ে বড় কথা, ওর ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক তুখোড়। ওর মতো একজন ক্রিকেটার ড্রেসিংরুমে থাকা মানেই বিরাট প্রাপ্তি। সবরকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখে। সব প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে রয়েছে। ক্রিকেটের দারুণ ছাত্র। পরিশ্রমী। শিখতে মুখিয়ে থাকে। ওর নিষ্ঠা, সংকল্প তরুণদের কাছে উদাহরণ হতে পারে। ক্রিকেট নিয়ে ভাবে।'
অশ্বিনের কোন গুণটা সবচেয়ে ভাল লাগে? 'এত কিছু অর্জন করার পরেও পরের ম্যাচের প্রস্তুতিতে ফাঁক রাখে না। প্রস্তুতি ভাল হলে কী হতে পারে, তার সেরা উদাহরণ অশ্বিন। ও অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে গেলে সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতির মতো প্রস্তুতি নেয়, ঘরের মাঠে যদি ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলে, তার জন্য আলাদা প্রস্তুতি নেয়। শ্রীলঙ্কায় খেলতে গেলে সেভাবে নিজেকে তৈরি করে,' বলছিলেন সৌরাশিস। আরও বললেন, 'প্রতিনিয়ত নিজেকে পাল্টেছে। সেটাই ভাল ক্রিকেটার আর মহান ক্রিকেটারের তফাত। প্রত্যেক দিন উন্নতি করা প্রয়োজন, প্রত্যেক ম্যাচে, প্রত্যেক স্পেলে, প্রত্যেক ওভারে উন্নতি করা দরকার। সেটা অশ্বিন করে গিয়েছে।'
টেস্টে ৫৩৭ উইকেট। পাশাপাশি ৩৫০৩ রান। ৬টি সেঞ্চুরি রয়েছে অশ্বিনের। সৌরাশিস বলছেন, 'ওর ব্যাটিং নিয়েও কথা বলতে চাই। ওর বোলিং রেকর্ড এত ভাল যে, ওর ব্যাটিং নিয়ে খুব একটা আলোচনাই হয় না। তবে আমার মনে হয় ও যেভাবে মিডল বা লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করেছে, শুধু ব্যাটিংয়ের জন্যই ও দলে চলে আসতে পারে। ওর মতো ব্যাটিং রেকর্ড কোনও ব্যাটারের থাকলেও সে গর্ববোধ করত। অত নীচে ব্যাটিং করেও টেস্ট ম্যাচে ৬টি সেঞ্চুরি মুখের কথা নয়। টেস্টে পাঁচশোর বেশি উইকেট, সাড়ে তিন হাজারের ওপর রান। অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান। ইতিহাসে যত কিংবদন্তি স্পিনার রয়েছে, যেমন শ্যেন ওয়ার্ন, মুথাইয়া মুরলীধরন, অনিল কুম্বলে, নাথান লায়ন – অশ্বিনও সেই তালিকায় থাকবে। আর ব্যাটিংয়ে ও বাকি সকলকে পিছনে ফেলবে। সেটা ওর স্কোরশিটে বাড়তি পয়েন্ট যোগ করবে।'
বল নিয়ে বরাবরই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গিয়েছেন অশ্বিন। কখনও তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে এসেছে ব্যাটারদের আতঙ্ক-সম ক্যারম বল। কখনও আবার নিখুঁত অফস্পিন কাঁপুনি ধরিয়েছে। সৌরাশিস বলছেন, 'অশ্বিনকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি। স্পিন বোলিং একটা শিল্প। আর ও একজন শিল্পী। আর ওস্তাদ শিল্পী। স্পিন বোলিংকে অন্য স্তরে নিয়ে গিয়েছে। এত পরিচ্ছন্ন অ্যাকশন নিয়ে এত বোলিং বৈচিত্র। আর পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপারে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। ও জানে নেটে যে বলটা করেছে ম্যাচেও সেটা একদম জায়গায় ফেলতে পারে। সেটা ম্যাচের প্রথম বল হলেও পারে। দক্ষতা আর নিজের ওপর বিশ্বাস না থাকলে এটা হয় না।' যোগ করলেন, 'টেস্ট ক্রিকেটে বেশিরভাগ উইকেট ও স্টক বল অর্থাৎ অফস্পিন করেই নিয়েছে। কিন্তু তিন ধরনের ক্রিকেটে খেলায় ও বুঝে গিয়েছিল যে, বোলিং বৈচিত্র এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যা ব্যাটারদের ধারণার বাইরে। সে জন্যই কখনও ক্যারম বল, কখনও লেগ স্পিন, কখনও টপ স্পিন, কখনও বড় স্পিন, কখনও ছোট স্পিন এগুলো সাদা বলেও করেছে। স্পিন বোলিংয়ে বিবর্তন ঘটিয়েছে।'
প্রথম অশ্বিন-দর্শনের অভিজ্ঞতা? সাফ মনে আছে সৌরাশিসের। বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার বলছেন, 'ওর বিরুদ্ধে অনেক ম্যাচ খেলেছি। তবে বোলিং নিয়ে খুব একটা কথা হয়নি। বেশিরভাগ সময়ে সৌজন্য বিনিময়ই হয়েছে শুধু। অশ্বিন আর আমি প্রায় সমসাময়িক। আমার এক ব্যাচ পরের ছেলে। এখনও মনে আছে ওর সঙ্গে প্রথম আলপ হওয়ার দিনটি। ২০০৪-২০০৫ মরশুম। আমরা রঞ্জি ফাইনালে মুম্বইয়ের কাছে হেরে গেলাম। ম্যাচের তৃতীয় দিন একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ছিল। সেবার বর্ষসেরা স্পিনার হয়েছিল অশ্বিন। তার আগে শুনছিলাম তামিলনাড়ুর এক স্পিনার উইকেট নিচ্ছে। সেদিনই প্রথম ওকে দেখি। তারপর প্রত্যেক দিন নিজেকে পরিণত করে তুলেছে। কিংবদন্তি হয়েছে ও।'
অশ্বিনের বিরুদ্ধে প্রচুর ম্যাচ খেলেছেন। সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত? সৌরাশিস বলছেন, 'ইডেনে একটা ম্যাচের কথা খুব মনে পড়ছে। ২০১৪ সালের বিজয় হাজারে ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলা ও তামিলনাড়ু। লো স্কোরিং সেই ম্যাচে আমি ছিলাম সর্বোচ্চ স্কোরার। শেষ দিকে আমার আর অশোক ডিন্ডার পার্টনারশিপে আমরা ১৬৭ রান তুলেছিলাম। তামিলনাড়ু ৯০ রানে অল আউট হয়ে গিয়েছিল। আমরা ম্যাচটা জিতেছিলাম। মহম্মদ শামি ও ডিন্ডা দারুণ বোলিং করেছিল।' যোগ করলেন, 'সেই ম্যাচে অশ্বিন আমাকে একটা বল করেছিল। রাউন্ড দ্য উইকেট এসে। স্ট্রেটার দিয়েছিল, সিম আপ বল। আউটস্যুইং বোলারের বলে এরকম হয়। কিছু বুঝতেই পারিনি। পুরো ওপেন আপ হয়ে গিয়েছিলাম। বলটি ধোঁকা দিয়েছিল তামিলনাড়ুর উইকেটকিপার দীনেশ কার্তিক ও প্রথম স্লিপে দাঁড়ানো লক্ষ্মীপতি বালাজিকেও। বলটি আমার ব্যাটের কানায় লেগে উইকেটকিপার ও স্লিপের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছিল। অভাবনীয় বল। স্পিনারের বল ওরকম স্যুইং করতে পারে আজন্ম শুনিনি বা দেখিনি।'
সৌরাশিসের সরল স্বীকারোক্তি, 'আমি অফস্পিনার হিসাবে ওকে দেখে মুগ্ধ। ওর মতো বোলিং করার চেষ্টাও করতাম। কিন্তু আমাদের দক্ষতায় সেটা করে উঠতে পারিনি। আমরা প্রাথমিক ব্যাপারগুলোয় বেশি জোর দিতাম। ও আমার অনুপ্রেরণা।' যোগ করলেন, 'মন খারাপ নয়, বরং ওর কেরিয়ার সেলিব্রেট করা উচিত। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম নিদেবিত পূজারি।'
আরও পড়ুন: ছেলের অবসরের পর খেলা দেখতেন না সৌরভের মা, কার জন্য টিভি খুলেছিলেন? ইডেনে ঝুলন-বরণে অজানা গল্প
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।