সন্দীপ সরকার, কল্যাণী: ভারতীয় ক্রিকেটকে কোহিনূর উপহার দিয়েছিলেন তিনি। রাজধানী দিল্লিতে তাঁর হাত ধরেই উত্থান হয়েছিল বিরাট কোহলি-র (Virat Kohli)। তাঁর কাছেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি, প্রতিষ্ঠা বিরাটের। গোটা বিশ্বের কাছে যিনি কিংগ কোহলি, তাঁর কাছে শুধুই স্নেহের পাত্র, প্রিয়তম শিষ্য। তাঁকে এখনও এতটাই কদর করেন বিরাট যে, শিক্ষক দিবসে আস্ত একখানা গাড়ি কিনে গুরুদক্ষিণা দিয়েছিলেন। দ্রোণাচার্য কোচ সেই রাজকুমার শর্মা এখন কল্যাণীতে। অসমের মেন্টর হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন। বাংলার বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ খেলতে দলবল নিয়ে এসেছেন। সোমবার দ্বিতীয় দিনের খেলার শেষে কোহলির শৈশবের কোচকে পাওয়া গেল শহরের এক অভিজাত হোটেলে। লবিতে বসে দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন। কোহলির অবসর নিয়ে জল্পনা থেকে শুরু করে ভারতের স্পিন-কৌশলের মুখ থুবড়ে পড়া, সব বিষয়েই অকপট রাজকুমার।
প্রশ্ন: অনেকে বলছেন, বিরাট কোহলিকে ছাড়া ভারতের ওয়ান ডে দল ভাবা এখনও সম্ভব নয়, আবার অনেকের মতে কোহলির এখনই অবসর নেওয়া উচিত...
রাজকুমার শর্মা: আমি অন্তত এমন কাউকে চিনি না যে বলছে কোহলির অবসর নেওয়া উচিত। আমার তো মনে হয় ১৪০ কোটি ভারতীয় চায় বিরাট কোহলি খেলুক। দু-একজন নেতিবাচক মানসিকতার লোক হয়তো ভাবতে পারে যে, বিরাটের খেলা উচিত নয়। তবে বাকি দেশ, গোটা বিশ্বই চায় কোহলি খেলা চালিয়ে যাক এবং ২০২৭ সালের ওয়ান ডে বিশ্বকাপ অবশ্যই খেলুক।
প্রশ্ন: দুই ফর্ম্যাট থেকে অবসর ঘোষণা করে দিয়েছেন কোহলি। শুধু ওয়ান ডে-তে খেলছেন। ম্যাচ প্র্যাক্টিসের অভাব নিয়ে চারপাশে এত কথা হচ্ছে। আপনারও কি মনে হয় যে, পর্যাপ্ত ম্যাচ প্র্যাক্টিস পাচ্ছেন না বিরাট?
রাজকুমার: ২০০৮ সাল থেকে ও ভারতীয় দলে খেলছে। ১৭ বছর হয়ে গেল। আপনি যদি পরিসংখ্যান ও রেকর্ড দেখেন, ভারতীয় ক্রিকেটে বিরাটের যা অবদান, তা এই দেশের আর কারও নেই। আবারও বলছি, আর কোনও ভারতীয় ক্রিকেটারের এত অবদান নেই, যা রয়েছে বিরাটের। বিরাটের মতো এত ধারাবাহিকভাবে ভারতকে আর কেউ ম্যাচ জেতায়নি। নিজের ফিটনেস নিয়ে ভীষণ সচেতন। প্র্যাক্টিসের মধ্যেই থাকে। ভারতের হয়ে খেলা সবচেয়ে শৃঙ্খলাপরায়ণ ক্রিকেটারদের মধ্যে একজন বিরাট। ম্যাচ প্র্যাক্টিসের অভাবটা এমন কোনও চিন্তার বিষয় নয়। ও এখন ভীষণ অভিজ্ঞও। দেশের জন্য এতদিন যা করেছে, এখনও সেটা করতে পারে। তাছাড়া ও একটা পদ্ধতি মেনে চলে সারা বছর। হৃদয় দিয়ে প্র্যাক্টিস করে। ফিটনেস বজায় রাখে। আমি চিন্তার কিছু দেখছি না।
প্রশ্ন: ফিটনেস চর্চা নিয়ে বিরাটের সাধনাটা ঠিক কীভাবে শুরু হয়েছিল?
রাজকুমার: ভারতীয় দলে ও যখন সুযোগ পেয়েছিল এত ফিট ছিল না। এমন নয় যে ফিট ছিল না। অন্যান্য ভারতীয় ক্রিকেটারদের মতোই ফিট ছিল। তবে ও তখন স্বপ্ন দেখত বিশ্বের এক নম্বর হবে। ওর মন বলেছিল যে, তার জন্য আরও পরিশ্রম করতে হবে। বিশ্বের সেরা হতে হলে আরও ফিট হতে হবে। সেখান থেকেই ওর ফিটনেস চর্চা শুরু। তারপর তো গোটা ভারতীয় দলের ফিটনেস সংস্কৃতিই বদলে দিয়েছে ও। আর শুধু ক্রিকেটই কেন, অন্য খেলার লোকজনও ওকে অনুসরণ করে। সাধারণ মানুষ ওর মতো ফিট হতে চায়।
প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮২টা সেঞ্চুরি। সব ফর্ম্যাটে দাপট। বিরাটের ক্রিকেট সফরকে কীভাবে দেখেন?
রাজকুমার: ৮২টা সেঞ্চুরি মুখের কথা নয়। কোনও পার্কে দিন রাত ক্রিকেট খেললেও ৮২টা সেঞ্চুরি করা যাবে না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্বের সর্বত্র রান করেছে। বড় দলের বিরুদ্ধে রান করেছে। ছোটখাট কোনও দলের বিরুদ্ধে খেলা হলে হয়তো অনেক সময় বিশ্রাম নিয়েছে। কিন্তু শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে খেলার চ্যালেঞ্জ থেকে কখনও পিছপা হয়নি। বড় দল দেখলেই ও জ্বলে ওঠে। নিজের সেরাটা বার করে আনে। আর একটা কথা। ওর ৮২টা সেঞ্চুরি ভারতকে কটা ম্যাচ জিতিয়েছে দেখবেন। ওর মতো ভারতকে এক ম্যাচ কেউ জেতায়নি।
প্রশ্ন: ইডেনে ঘূর্ণি পিচ বানিয়ে আড়াই দিনে টেস্ট হেরে গেল ভারত। অথচ বিরাট কোহলি অধিনায়ক থাকার সময় ভাল স্পোর্টিং উইকেটে খেলত ভারত। এখন কি ভারতীয় দল সঠিক দিশায় এগোচ্ছে?
রাজকুমার: এ নিয়ে আমি বেশি কথা বলব না। কারণ, প্রত্যেক টিম ম্যানেজমেন্টের আলাদা চিন্তাভাবনা থাকে। বিরাট আর রবি শাস্ত্রী যখন অধিনায়ক ও কোচ ছিল, তখন ওদের একটা নিজস্ব ঘরানা ছিল। এখনকার ভারতীয় দলের অন্যরকম চিন্তাভাবনা রয়েছে। থাকতেই পারে। ভাল ফল হলে লোকে বাহবা দেবে। খারাপ হলে নিন্দে করবে।
প্রশ্ন: অধিনায়ক হিসাবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় দেখিয়েছিলেন যে, বিদেশেও আমরা জিততে পারি। আর কোহলি এমন একটা পেস বোলিং আক্রমণ তৈরি করেছিলেন যে, বিদেশি দলও সমীহ করত। অধিনায়ক বিরাটের এই দিকটা কীভাবে দেখেন?
রাজকুমার: আগে একটা সময় ছিল যখন ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় যেত আর পিচে বড় বড় ঘাস রাখা হতো। আমাদের কাছে ভাল স্পিনার থাকত। ভাল পেসার ছিল না। আমাদের ব্যাটারদের কঠিন পরীক্ষা দিতে হতো। হাতে এমন ফাস্টবোলার ছিল না যাদের প্রতিপক্ষ দলও ভয় পাবে। অত জোরে কেউ বলই করতে পারত না। বিরাট অধিনায়ক হিসাবে সেই দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। জোরে বোলারদের একটা পুল তৈরি করেছিল। অন্তত আট ফাস্টবোলার এমন ছিল যাদের যখন খুশি খেলানো যেত। ভারতীয় ক্রিকেটে পেস বোলিংয়ের নকশাটা বদলে দিয়েছিল বিরাট।
প্রশ্ন: ওয়ান ডে ক্রিকেটে যাঁর ৫৮-র কাছাকাছি ব্যাটিং গড়, ৫১ সেঞ্চুরি, অস্ট্রেলিয়ায় ২টি ম্যাচে ব্যর্থ হতেই সেই কোহলিকে নিয়েও সমালোচনার ঝড় উঠছে। বিরাট নিজে সামলান কীভাবে?
রাজকুমার: বিরাট এখন অনেক পরিণত। ও যা অর্জন করেছে, তাতে এখন কে কী বলল যায় আসে না। যারা এত কথা বলে তাদের জ্ঞানও খুব স্বল্প। যারা দু-একটা ইনিংসে রান না পেলেই বলে বিরাট শেষ, তারা ক্রিকেটের কিছু বোঝেই না। বিরাট এসব নিয়ে ভাবেই না। ও নিজের প্রস্তুতি আর পরিশ্রম নিয়েই শুধু ভাবে। বাইরের কথায় কান দেয় না।