সন্দীপ সরকার: ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের জগতে তিনি কিংবদন্তি। বয়স মাত্র ২৭। কিন্তু ইতিমধ্যেই সাফল্যের মুকুটে একাধিক রঙিন পালক। সে এশিয়ান গেমসে (Asian Games) পদক জয় হোক বা পিটি ঊষার (PT Usha) ৩৬ বছর পর প্রথম কোনও ভারতীয় মহিলা অ্যাথলিট হিসাবে অলিম্পিক্সের (Olympics) মূল পর্বের যোগ্যতা অর্জন।


সেই দ্যুতি চন্দ (Dutee Chand) এখন ব্যস্ত ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের বাইরের লড়াইয়ে। আইনি যুদ্ধে। ট্র্যাকে নামাই যে থমকে গিয়েছে তাঁর!


ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বরের মারুতি ভিলা ফেজ টুয়ে একতলা বাড়ির ড্রয়িং রুমের ট্রফি ক্যাবিনেট উপচে পড়ছে। পদক, স্মারক, সার্টিফিকেটের ভিড়। বিশাল স্মার্ট টিভিতে চলছিল বিটিং রিট্রিটের ভিডিও। খানিক অপেক্ষার পর দ্যুতি যখন ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসলেন, গায়ে ভারতীয় দলের টি শার্ট। তার ওপর জাতীয় অ্যাথলেটিক্স টিমের ব্লেজার। বাড়িতেও যেন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের মেজাজ।


আড্ডা শুরু হল হাল্কা মেজাজে। কেরিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কী? দ্যুতি বললেন, 'সবচেয়ে স্মরণীয় ২০১৯ সালে নাপোলিতে ওয়র্ল্ড ইউনিভার্সিটি গেমসে সোনা জয়। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিক্সে দৌড়েছিলাম। পিটি ঊষার ৩৬ বছর পরে অলিম্পিক্সের মূল পর্বে উঠেছিলাম কোনও ভারতীয় মহিলা স্প্রিন্টার হিসাবে। ১৬ বছর পর এশিয়ান গেমসে দেশকে জোড়া রুপোর পদক দিয়েছিলাম।'


আর সবচেয়ে কঠিন সময়? '২০১৪ সালে শরীরে পুরুষ হরমোন বেশি রয়েছে বলে মহিলাদের ইভেন্টে নামতে দেওয়া হয়নি। সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে স্যুইৎজারল্যান্ডের ক্যাস-এ আবেদন করেছিলাম। সেই মামলায় জিতেছিলাম,' বলছিলেন দ্যুতি। ডোপ টেস্টে ধরা পড়ায় যিনি আপাতত ৪ বছরের জন্য নির্বাসিত। দ্যুতি বলছেন, 'কোনও প্রতিযোগিতার সময় বা পরে ডোপিং টেস্ট হয়। বছরের যে কোনও সময়েই ডোপিং টেস্ট হতে পারে। আমার কুঁচকিতে চোট ছিল। চিকিৎসা চলছিল। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানের মাঝে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। বোনের বিয়ে চলছিল। 'এ' নমুনায় নিষিদ্ধ ওষুধ পাওয়া যায়। আমি 'বি' নমুনার জন্য আবেদন করি। সেটাও পজিটিভ হয়। জানি না আমার খাবারে কেউ কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল কি না। হতেই পারে এটা ষড়যন্ত্র। তবে আমি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন-সহ সব নথি জমা করেছি।'


দ্যুতি আশাবাদী, আইনি লড়াইয়ে জয় পাবেন। বলছিলেন, 'আগামী মাসে মামলার দিন পড়তে পারে। আশা করছি ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যাব। কারণ, কোনও প্রতিযোগিতার মধ্যে ধরা পড়িনি। আমার আইনজীবী পার্থ গোস্বামীও আত্মবিশ্বাসী যে, আমি ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যাব।' ২৭ বছর বয়স। কিন্তু ৪ বছরের নির্বাসন বহাল থাকলে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ফিরতে ২০২৭ হয়ে যাবে। বয়স হয়ে যাবে ৩১। কেরিয়ার নিয়েই তো প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে?


দ্যুতি বলছেন, '২০১৪ সালেও বলা হয়েছিল আমার কেরিয়ার শেষ। আজীবনের জন্য নির্বাসন করা হয়েছিল। আপনাদের রাজ্যের পিঙ্কি প্রামাণিককেও নির্বাসিত করা হয়েছিল। কিন্তু আইনি লড়াইয়ে আমি জিতেছিলাম। তিন মাসের মধ্যে ফিরে এসেছিলাম। এবারও তাই হাল ছাড়তে নারাজ। অনেকেই বলছেন ৪ বছর নির্বাসন বহাল থাকলে কেরিয়ার শেষ। আমি এত নেতিবাচক ভাবছি না। কেরিয়ারে প্রায় পাঁচশোবার ডোপ টেস্ট দিয়েছি। কোনওদিন চুরি করিনি। অভাবের সঙ্গে লড়াই করে এখানে পৌঁছেছি। মানসিকভাবে আমি ভীষণ শক্তিশালী। প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছি।'


আগামী বছর প্যারিস অলিম্পিক্সে নামতে না পারলে কী হবে? অবসর নেবেন? দ্যুতির কথায়, 'অবসর নিয়ে ভাবিনি। আগামী মাসে শুনানির পর সিদ্ধান্ত নেব। তবে সব অ্যাথলিটরাই খেলা ছাড়ার পর চাকরির পাশাপাশি ছোটদের কোচিং করায়। আমিও করাব। আমার নিজস্ব অ্যাকাডেমি রয়েছে। সেখানে অভাবী বাচ্চাদের ট্রেনিং করাব। সমাজসেবা করার ইচ্ছা রয়েছে। রাজনীতিতে যোগ দিতে পারি। অনেক দলের প্রস্তাব রয়েছে।'


ওড়িশায় পরের দ্যুতি চন্দ কে? হাসছেন চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলিট। রাখঢাক না করে বলছেন, 'ওড়িশায় হোক বা ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সে, আমার সময়ের ধারেকাছেও কেউ নেই।'


দ্যুতির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সমকামী তিনি। বান্ধবী মোনালিসা দাসের সঙ্গে লিভ ইন করেন। সমলিঙ্গে বিয়ে স্বীকৃতি পেলেই বিয়েও সেরে ফেলতে চান। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন কোন সংকল্প নিয়ে? 'সব মানুষের শরীর এক। মন আলাদা। একটা ছেলে যে একটা মেয়েকেই পছন্দ করবে বা একটা মেয়ে ছেলেকে পছন্দ করবে, তার কোনও মানে নেই। আমি মোনালিসাকে ভালবাসি। পছন্দ করি। ওর সঙ্গে থাকব বলে কথা দিয়েছি। আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে সুপ্রিম কোর্ট এখনও ছাড়পত্র দেয়নি। অপেক্ষা করছি। আমাদের লড়াই চলবে,' খোলামেলা আড্ডায় বলছিলেন দ্যুতি।


সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার দেখুন নীচের লিঙ্কে ক্লিক করে



সমাজের কটাক্ষও হজম করতে হয়েছে। বলছিলেন, 'প্রচুর প্রশ্ন উঠেছে। প্রচুর হয়রানি হয়েছে। হেনস্থার শিকার হয়েছি। সমাজ মেনে নেয়নি শুরুতে। বক্রোক্তি শুনতে হয়েছে। পরিবারের অনেকে আপত্তি জানিয়েছে। এক বোনের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে। পরে অবশ্য সকলের ধারণা পাল্টেছে। এখন পরিবারও সমর্থন করছে। আর অনেক সময় তো ছেলে-মেয়ের সম্পর্কও বাড়ি থেকে মেনে নেয় না। ধর্ম-জাতপাত নিয়ে অনেক সমস্যা হয় আমাদের দেশে।'


কথায় কথায় দ্যুতি জানালেন, ২০১৮ সালে মোনালিসার সঙ্গে আলাপ। বলছেন, 'মোনালিসাও খেলাধুলো ভালবাসে। আমাকে উৎসাহ দেয়। বলে, পরিশ্রম করো। সফল হবেই। আমার ভরসা, অনুপ্রেরণা - সবই ও। ওর সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।'


ধর্মনিষ্ঠ মোনালিসা তখন বাড়ির সামনের তুলসী বেদিতে ধূপ-প্রদীপ জ্বালছেন। শঙ্খধ্বনি শোনা গেল। সমাজ-আইনের ঘুমও কি ভাঙবে? অপেক্ষায় দেশের দ্রুততম স্প্রিন্টার দ্যুতি। শুধু যেন আদালতের 'অন ইওর মার্ক, সেট, গো' শোনার অপেক্ষায়... 


আরও পড়ুন: সুনীলদের সামনে ফের কঠিন পরীক্ষা, কিংস কাপ খেলতে তাইল্যান্ডে যাবে ভারতীয় ফুটবল দল