কলকাতা: ভাল শুরু করে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলের (East Bengal) না জিতে মাঠ ছাড়ার দৃশ্য গত মরশুমে অনেকবার দেখা গিয়েছিল। মরশুম বদলেছে, কোচ বদলেছে, দলের খোলনলচেও পাল্টেছে। কিন্তু তাদের এই অভ্যাসে বদল আসেনি ছিটে ফোঁটাও।
রবিবার সন্ধ্যায় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ডুরান্ড কাপের (Durand Cup 2023) ম্যাচে দেখা গেল সেই একই দৃশ্য। যা গত মরশুমে দেখা গিয়েছে অনেকবার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী., যাদের তিন দিন আগে পাঁচ গোল দিয়েছিল মোহনবাগান এসজি, তাদের বিরুদ্ধে ৮৮ মিনিট পর্যন্ত ২-০-য় এগিয়ে ছিল ইস্টবেঙ্গল এফসি। প্রথমার্ধে যথাক্রমে ৩৪ ও ৪৯তম মিনিটে দুই বিদেশি সল ক্রেসপো ও হাভিয়ের সিভেরিয়ো গোল করে দলকে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন।
দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি ডিফেন্ডার নিশু কুমার লাল কার্ড দেখায় দশ জনে খেলতে হয় লাল-হলুদ বাহিনীকে। শেষ বেলায় একসঙ্গে একাধিক খেলোয়াড় বদল করে তারা। কিন্তু ম্যাচের শেষ দশ মিনিটে অদ্ভূতভাবে জয়ের স্বস্তি ঢুকে পড়ে লাল-হলুদ শিবিরে। ফুটবলারদের মধ্যে চলে আসা গা-ছাড়া ভাবও ছিল স্পষ্ট। তাদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই শেষ আট মিনিটের মধ্যে পরপর দু'টি গোল করে ম্যাচ ড্র করে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ আর্মি (Bangladesh Army)। ৮৮ মিনিটে শাহরিয়র ইমন ও ৯৬ মিনিটের মাথায় মিরাজ প্রধান গোল করে ইস্টবেঙ্গলের অবধারিত জয় রুখে দেন। সারা ম্যাচে দুর্দান্ত খেলে ৬৫ শতাংশ বল পজেশন নিয়েও শেষ পর্যন্ত জয়ের হাসি নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারল না তারা।
এ দিন শক্তিশালী দল নিয়েই মাঠে নামে ইস্টবেঙ্গল এফসি। প্রথম দলে দুই বিদেশি সল ক্রেসপো ও হাভিয়ের সিভেরিয়ো, দু’জনেই ছিলেন। মন্দার রাও দেশাই, হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা, লালচুঙনুঙ্গা, নাওরেম মহেশ সিং, নন্দকুমার শেখররাও ছিলেন দলে। দ্বিতীয়ার্ধে বোরহা হেরেরা, ভিপি সুহের, মোবাশির রহমান, গুনরাজ গ্রেওয়াল এমনকী গতকাল রাতে শহরে এসে পৌঁছনো জর্ডন এলসিকেও নামানো হয়। ডাগ আউটে হেড কোচ কার্লস কুয়াদ্রাতকেও দেখা যায়।
ম্যাচটা যে শুরু থেকেই দাপটের সঙ্গে খেলার উদ্দেশ্য নিয়েই নেমেছিল তারা, তা এই লাইন-আপ দেখেই বোঝা যায়। এবং শুরু থেকেই আধিপত্য বিস্তার করার প্রবণতাও দেখা যায় তাদের খেলায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের প্রথম ম্যাচের পারফরম্যান্সের তুলনায় এ দিন কিছুটা উন্নত ফুটবল খেলার চেষ্টা করলেও প্রতিপক্ষের দাপটে বারবার খেই হারিয়ে ফেলে।
পাঁচ মিনিটের মাথাতেই এগিয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পায় লাল-হলুদ বাহিনী। মন্দারের ক্রস থেকে গোল করেন স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড সিভেরিও। কিন্তু বল তাঁর হাতে লেগে গোলে ঢোকায় রেফারি সঙ্গে সঙ্গে তা বাতিল করে দেন। শুরুতেই গোল না পেয়ে মরিয়া হয়ে ওঠা ইস্টবেঙ্গল মূলত বাঁদিকের উইং দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। বারবার গোলের সুযোগ তৈরি করেও ব্যর্থ হন নন্দকুমাররা। নন্দ নিজে একাধিকবার বাঁদিক দিয়ে উঠে বক্সে ঢুকে পড়লেও তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নেন বাংলাদেশ সেনার ডিফেন্ডাররা।
এ দিন সেনা দলের মাঝমাঠ ও রক্ষণকে অনেক উন্নত লাগলেও তাদের আক্রমণে তেমন ধার ছিল না। ২৩ মিনিটের মাথায় প্রতিপক্ষের বক্সে ঠিকমতো পায়ে বল লাগাতে পারলে অবধারিত গোল পেতেন তিনি। কিন্তু তা পারেননি। বল দখলে এ দিন ইস্টবেঙ্গল অনেক এগিয়ে ছিল। প্রথমার্ধে প্রায় ৬৫ শতাংশ বল পজেশন তাদেরই ছিল।
ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম গোল কার্যত উপহার দেয় সেনারা। যেমন আগের ম্যাচে মোহনবাগানকেও দিয়েছিল। ৩২ মিনিটের মাথায় বাইলাইন থেকে বল ফিরিয়ে আনার সময় নিশু কুমারকে টেনে ধরে ফেলে দেওয়া হয়। যার ফলে রেফারি পেনাল্টি দেন এবং সেই পেনাল্টি থেকে গোল করেন সল ক্রেসপো (১-০)।
এই গোলের ছ’মিনিট পরেই প্রায় ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে গোলের সুযোগ পেয়ে যান তরুণ মিডফিল্ডার গুইতে পেকা। ক্রেসপোর বাড়ানো বল নিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি। কিন্তু তাঁর গোলমুখী শট পায়ে আটকে দেন বাংলাদেশ সেনা দলের গোলকিপার আশারাফুল রানা। এর পরই বক্সের মধ্যে গোলের উদ্দেশ্যে সিভেরিওর একটি জোরালো ভলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
ওই সময় লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও প্রথমার্ধের বাড়তি সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে অসাধারণ হেডে গোল করে ব্যবধান আরও বাড়িয়ে নেন হায়দরাবাদ এফসি থেকে আসা ফরোয়ার্ড। সেনা দলের বক্সের ডান দিকে কর্নার স্পটের সামনে থেকে দেওয়া খাবরার অনবদ্য ক্রসে হেড করেন সিভেরিও (২-০)। গোলকিপার রানা ওই ক্রস আটকানোর চেষ্টা করেও পারেননি। তাঁর ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে নেন সিভেরিও।
বিরতির পর শুরুর দিকে সেনা দল ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে আনার চেষ্টা করলেও বেশিক্ষণ তা ধরে রাখতে পারেনি। মিনিট দশেক পর থেকেই ফের ইস্টবেঙ্গলই দখলদারি বাড়িয়ে নেয়। আসলে বাংলাদেশের ফুটবলারদের সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় অ্যাটাকিং থার্ডে ফিনিশ করা নিয়ে। গোলের সুযোগ তৈরি করেও বারবার খারাপ ফিনিশিংয়ের জন্য ব্যর্থ হয় তারা।
কিন্তু ৬৭ মিনিটের মাথায় যে ঘটনা ঘটে, তার জন্য বোধহয় তৈরি ছিল না ইস্টবেঙ্গল শিবির। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে অযথা কনুই দিয়ে আঘাত করার জন্য নিশু কুমারকে লাল কার্ড দেখান রেফারি। বল অনেক দূরে থাকা অবস্থাতেই প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে কেন আঘাত করেন নিশুর মতো অভিজ্ঞ ফুটবলার, তা তিনিই জানেন। ম্যাচের শেষ ২৩ মিনিট লাল-হলুদ শিবিরকে দশ জনেই খেলতে হয়।
প্রতিপক্ষের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সেনা দল ম্যাচে ফিরতে পারে কি না, সেটাই তখন দেখার ছিল। ৭২ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে জাফর ইকবাল গোলে জোরালো শট নেন, যা চলে যায় লাল-হলুদ কিপার প্রভসুখন গিলের হাতে।
এক জন কম তো ছিলেনই, ম্যাচের শেষ দিকে কিছুটা গা ছাড়া ভাবও দেখা যায় লাল-হলুদ ফুটবলারদের মধ্যে। এই পরিস্থিতিকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করে বাংলাদেশের সেনা দল। নির্ধারিত সময়ের একেবারে শেষ দিকে তাদের চেষ্টা অবশেষে সফল হয় শাহরিয়ার ইমনের গোলে। থ্রো ইনের পর বক্সের বাঁদিক থেকে দেওয়া মিনহাজুরের হেডে বল উড়ে আসে বক্সের সামনের দিকে। ওখানে থাকা ইমন বাঁ পায়ে জোরালো শট নেন গোলে। যা গিলের ডানদিক দিয়ে গোলে ঢুকে যায় (২-১)। রিয়্যাকশন টাইম সামান্য বেশি হয়ে যাওয়ায় তিনি বলের নাগাল পাননি।
কিন্তু তখনও যে আরও বিপদ অপেক্ষা করে রয়েছে তাদের জন্য, তা বুঝতে পারেননি লাল-হলুদ তারকারা। ছ’মিনিটের স্টপেজ টাইমের একেবারে শেষ মিনিটে আরও একটি গোল খেয়ে বসে কলকাতার দল। নিজেদের বক্সের বাঁ দিক থেকে গোলকিপারকে ব্যাকপাস করার চেষ্টা করেন খাবরা। সেই পাস ছিনিয়ে নেন ইমন এবং ক্রস দেন বক্সের মধ্যে।
বক্সের সামনে থেকে নেওয়া গোলমুখী শট আটকে দেন গিল। কিন্তু তাঁর হাত থেকে ছিটকে আসা বল তাড়া করে জালে জড়িয়ে দেন মিরাজ প্রধান (২-২)। এত ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও তখন ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডারদের তৎপরতা দেখা যায়নি। ক্লান্তি ও জয়ের স্বস্তিতে তখন তাঁরা ডুবে ছিলেন বোধহয়। তারই মাশুল দিতে হল শেষ পর্যন্ত। হাতে আসা তিন পয়েন্টের মধ্যে দুই পয়েন্ট খুইয়ে মাঠ ছাড়তে হল।
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামেও। যুক্ত হোন
https://t.me/abpanandaofficial