কলকাতা: গত তিন মরশুমে হতাশাজনক ফলের পর সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩-এ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী ইস্টবেঙ্গল এফসি (East Bengal), যারা গত একশো বছর ধরে ভারতীয় ফুটবলে রীতিমতো আধিপত্য করে এসেছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ক্লাবের ইতিহাসে ২০২৩ অবশ্যই এক তাৎপর্যপূর্ণ সাল।



গত বছরটি কেমন গিয়েছে ইস্টবেঙ্গলের, তা নিয়ে মুখ খুললেন দলের স্পেনীয় কোচ কার্লেস কুয়াদ্রাত (Carles Cuadrat। গত বছরেই যাঁকে ক্লাবের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্য নিয়ে নিয়োগ করেন ক্লাবের কর্তারা।

সেই কাজে অনেকটাই সফল কুয়াদ্রাত। হবেন নাই বা কেন? এ দেশে কোচিং করানোর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে ৫৪ বছর বয়সী কুয়াদ্রাতের। ২০১৬ থেকে তিনি বেঙ্গালুরু এফসি-র সহকারী কোচের পদে ছিলেন। যখন ২০১৮-য় প্রধান কোচ হিসেবে বেঙ্গালুরু এফসি-র দায়িত্ব নেন, তখন প্রথম মরশুমেই (২০১৮-১৯) দলকে প্রথম আইএসএল চ্যাম্পিয়ন করেন। তাঁরই প্রশিক্ষণে বেঙ্গালুরু একই মরশুমে লিগ সেরা ও ট্রফি জয়ী দুই-ই হয়।


ইস্টবেঙ্গল এফসি-র ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি গত বছরের এই লড়াই নিয়ে যা বললেন, তার উল্লেখযোগ্য অংশ এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল।

কেন ইস্টবেঙ্গল?

ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ফোন পেয়ে বুঝেছিলাম, এটা একটা বড় ক্লাব, ঐতিহাসিক ক্লাব। ওরা শুরু থেকেই চেয়েছিল আমি ওদের ক্লাবের পরিস্থিতিতে একটা পরিবর্তন এনে দিই। পরবর্তী দুই মরশুমের জন্য ওরা আমাকে একটা প্রকল্প দিয়েছিল। আমি যে একটা শতবর্ষের ক্লাবকে ফের আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে পারি বলে মনে করেছেন ক্লাব কর্তারা, এটা আমার কাছে খুবু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। আমরা কথা বলা শুরু করি এবং আমাদের দুপক্ষের মতের মিল হওয়ায় আমি প্রস্তাব গ্রহণ করি।


যুদ্ধের সৈন্য-বাছাই

দলকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য যে অনেক পরিবর্তন করতে হবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। প্রথমেই দরকার ছিল একঝাঁক ভাল খেলোয়াড়। কয়েকজন ভাল ভাল বিদেশি খেলোয়াড়কেও নিয়ে আসা প্রয়োজন ছিল। ক্লেইটনকে (সিলভা) তো গত মরশুমে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য রেখে দেওয়াই হয়েছিল। এ ছাড়াও গত মরশুমের কয়েকজন দেশীয় খেলোয়াড়কেও রেখে দেওয়া হয়, যারা এ মরশুমে দলকে ফের শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। এমন কয়েকজন বিদেশি খেলোয়াড়কে সই করানো হয়, যারা ওডিশা, হায়দরাবাদের দলের হয়ে খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং ইন্ডিয়ান সুপার লিগ কী, তা খুব ভাল করে জানে। তাদের এখানে মানিয়ে নিতে তেমন কোনও অসুবিধা যাতে না হয়।

নন্দকুমার, লালচুঙনুঙ্গা, মহেশ সিংয়ের মতো জাতীয় দলে খেলা খেলোয়াড়দেরও দলে নেওয়া হয়। এর আগে যারা আমার তত্ত্বাবধানে খেলেছে সে রকম কয়েকজনকেও নিলাম, যেমন গোলকিপার প্রভসুখন গিল, যে দুই মরশুম আগেই গোল্ডেন গ্লাভ পেয়েছিল। আমি জানি, ও নিজেকে যথেষ্ট উন্নত করে তুলেছে। এ ছাড়া খাবরা, নিশুর মতো খেলোয়াড়, যাদের আমি বেঙ্গালুরু শিবিরে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম এবং ওদের নিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম। মন্দার, গুরসিমরাতরাও আমার প্রশিক্ষণে খেলেছে। ফলে ওরা জানে কোচ হিসেবে আমি কেমন এবং আমার কৌশল কী রকম হয়, এ সবই।

যুদ্ধের সূচনা

আমি কলকাতায় এসে পৌঁছনোর পরে যে ভাবে হইহুল্লোড় করা হয়, তখনই বুঝি ইস্টবেঙ্গল কত বড় ক্লাব। ভোর চারটের সময় এয়ারপোর্টে নতুন কোচকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিলেন সমর্থকেরা। এ থেকেই বুঝতে পারি ওরা আমাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে এবং আমারও নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল এবং আরও একবার মনে হয়, আমাকে ওরা বিরাট পরিবর্তনের প্রত্যাশায় নিয়ে এসেছে এবং সত্যিই এই পরিবর্তন ওদের কাছে কতটা জরুরি।

ডুরান্ড কাপের ফাইনালে ওঠা আমাদের পক্ষে খুবই জরুরি ছিল। কারণ, এর ফলে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে একটা ইতিবাচক বার্তা দিতে পেরেছিলাম আমরা। বছর পাঁচেক পরে একটা ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠার চেয়ে ভাল শুরু আর কী হতে পারে? তখনই আমরা সবাইকে দেখিয়ে দিই, আমরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে চাই এবং দেশের অন্যতম সেরা টুর্নামেন্টে আমরা ফিরে এসেছি।

চার বছর পর ডার্বিতে জয়টা সত্যিই অসাধারণ ছিল। যে ভাবে আমরা সেই সাফল্য উদযাপন করেছিলাম, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আমি ভাবতেই পারিনি, এত সমর্থক মাঠে এএসে দলের জন্য গলা ফাটাবেন। তখনই আমি উপলব্ধি করি যে, এরকম আরও কয়েকটা জয় প্রয়োজন ক্লাবের। সে দিন ক্লাবের খেলোয়াড়, সাপোর্ট স্টাফকে বলেছিলাম, আমাদের এ রকম আরও সাফল্য এনে দিতে হবে ক্লাবকে। আমাদের পাশে এত মানুষ রয়েছে। তাদের আনন্দ দিতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। ওদের কিছু দিতে পারলে ওরাও আমাদের পাশে সবসময় থাকবে। ওই জয়টার ওপর ভিত্তি করেই আমরা আমাদের পথ তৈরি করে নিই।

লড়াই-ই শেষ কথা

ক্লাবের যে স্লোগান— কখনও লড়াই না করে মরা যাবে না, এই স্লোগানই বুঝিয়ে দেয় এই ক্লাবের মানসিকতা কী রকম, কতটা মরিয়া আমরা। এই যে আমাদের লোগো, এর জন্য যে আমরা সব কিছু উজাড় করে দিতে পারি, সেটাই দেখাতে হবে সবাইকে। তাই আমাদের কথা বার্তায় এই ব্যাপারটা থাকে। আমরা কৌশল নিয়ে, কী ভাবে খেলব তা নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু ক্লাবের জন্য বড় কিছু করার যে শরীরি ভাষা, সাহসিকতা আমাদের মধ্যে আছে, তা নিয়ে আলাদা করে আলোচনা করতে হয় না আমাদের। এগুলো সব সময়ই থাকে আমাদের আচরণে।

আমি এমনই একটা ফুটবল সংস্কৃতি থেকে এসেছি, যেখানে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবে ভাল ফুটবলার তৈরি হয়। আমি প্রায় দশ বছর খেলোয়াড় হিসেবে যেমন সেখানকার ইউথ অ্যাকাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তেমনই পরে সেখানকার কোচের ভূমিকাও পালন করি। ফলে আমি সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভাল ভাবে পরিচিত। ইস্টবেঙ্গলের প্রকল্পে আমার হাতে দু’বছর সময় আছে। তাই আমাকে শুধু পরের ম্যাচের কথা ভাবলেই হয় না, ১৬ মাস পরের কথাও ভাবতে হয়। ভবিষ্যতের জন্য তরুণ প্রতিভার কথাও ভাবতে হয়।

মহেশই আদর্শ

মহেশকে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা খুব ভাল হয়েছে। কারণ, ক্লাবের প্রতি ওর অবদান প্রচুর। অন্যান্য খেলোয়াড়রাও এতে উৎসাহিত হয়। ওরা বুঝতে পারছে কর্তৃপক্ষ ক্লাবের উন্নতির ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস। মহেশের অনেক কিছু দেওয়ার আছে। ও জাতীয় দলের খেলোয়াড়। ওর মতো একজন খেলোয়াড়ের ভবিষ্যৎ যখন আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে, তখন অন্যান্য ভাল খেলোয়াড়রাও আমাদের ক্লাবের প্রতি আগ্রহী হবে।

মহেশ ছাড়াও আমাদের একাধিক খেলোয়াড় আছে, যারা জাতীয় দলের হয়ে খেলে। নুঙ্গা, নন্দ সিনিয়র দলের খেলে। অনূর্ধ্ব ২৩ দলে খেলে গিল। এ ছাড়াও পেকা, গুরনাজদের মতো অনূর্ধ্ব ১৭-য় খেলা প্রতিভা রয়েছে আমাদের দলে। তাই আমরা ভারতীয় ফুটবলকে বার্তা দিতে পারি যে, আমাদের এমন একাধিক ফুটবলার আছে, যারা ভারতীয় ফুটবলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।

ঘরের মাঠই দুর্ভেদ্য দূর্গ

ঘরের মাঠের সুবিধা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই ব্যাপারে গত তিনটি মরশুমের চেয়ে এই মরশুমে আমরা অনেক উন্নতি করেছি (ঘরের মাঠে ৫৪.৫ শতাংশ ম্যাচে জয়)। আমাদের ঘরের মাঠ এখন দূর্গে পরিণত হয়েছে এবং প্রচুর সমর্থক আসছেন স্টেডিয়ামে। প্রতিপক্ষদের কাছে আমাদের মাঠ থেকে পয়েন্ট নিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে উঠছে।

খেলোয়াড়দের কাছে আমার স্পষ্ট বার্তা হল, কোনও ম্যাচে তোমাদের ভাগ্য তোমাদের পাশে না থাকলেও পয়েন্ট অর্জন করার মতো যোগ্য হয়ে উঠতে হবে তোমাদের। নিজেদের চ্যাম্পিয়ন টিম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে হলে তোমাদের এই জায়গাতেই নিজেদের নিয়ে যেতে হবে। আমার এই বার্তা মনে হয় খেলোয়াড়রা অবশেষে উপলব্ধি করতে পেরেছে। গত তিনটে ম্যাচে নিশ্চয়ই আমাদের পারফরম্যান্সে সেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন।

এখন আমরা নিজেদের এমন এক শক্তিশালী দল গড়ে তুলেছি, যাদের বিরুদ্ধে খেলা প্রতিপক্ষের কাছে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। (প্রতি চার ম্যাচে তিন পয়েন্ট)। তিন মাস আগে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, তার চেয়ে এখন অনেক গুছিয়ে নিয়েছি আমরা। অনেক কঠিন প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেছি আমরা। তাই আমাদের সামনে এখন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।


আগামী ছ’মাসে আমাদের সামনে দুটো খেতাব জয়ের সুযোগ রয়েছে। আশা করি আমরা সফল হব। ক্লাবের প্রত্যকেই হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফেরানোর মরিয়া চেষ্টা করছে। কেউ পিছিয়ে নেই। সবাই লাল-হলুদ জনতার মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। আশা করি, নতুন বছরে আমরা সবাই একাধিক সাফল্যের উদযাপনে সবাই একসঙ্গে সামিল হব। (তথ্যসূত্র: আইএসএল মিডিয়া)


আরও পড়ুন: নতুন চাকরি পেলেন সানা, জানালেন গর্বিত বাবা সৌরভ


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে