কলকাতা: পূর্ব মেদিনীপুরে রূপনারায়ণের তীরে জামিট্যা গ্রাম। কাছাকাছি বড় জনপদ বলতে, কোলাঘাট। সেই জামিট্যা গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলে দয়ানন্দ গরানী জায়গা করে নিলেন বিরাট কোহলিদের সংসারে! ভারতীয় দলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া সফরে উড়ে যাবেন বঙ্গতনয়!

কে এই দয়ানন্দ গরানী? বাংলার ময়দানেও অনেকে এখনও নামটির সঙ্গে পরিচিত নন। ঝাঁকরা চুলের বছর আঠাশের যুবককে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবেন না যে, বেশ বিরল নজির গড়ে ফেলেছেন। কারণ, ভারতীয় দলের ম্যাসাজ থেরাপিস্ট কাম থ্রো ডাউন স্পেশ্যালিস্ট হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন দয়ানন্দ। সাম্প্রতিককালে বাংলা থেকে কেউ ভারতীয় দলের কোচিং স্টাফদের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছেন, এরকম নজির নেই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে দয়ানন্দের সাফল্য চমকপ্রদ। সচিন তেন্ডুলকরের আমল থেকে জাতীয় দলে এই দায়িত্ব পালন করে এসেছেন ডি রাঘবেন্দ্র। তবে তিনি করোনা আক্রান্ত। তাই অস্ট্রেলিয়া যেতে পারছেন না। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন দয়ানন্দ।



আইপিএলে কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের ম্যাসাজ থেরাপিস্ট ও থ্রো ডাউন বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব সামলেছেন মেদিনীপুরের যুবক। সেখান থেকেই সরাসরি কোহলি-যশপ্রীত বুমরাদের সংসারে জায়গা করে নিয়েছেন। দয়ানন্দের কাহিনীও চমকে দেওয়ার মতো। ক্রিকেটে রোজগারের খোঁজ না পেলে হয়তো পারিবারিক চাষবাষের কাজই বেছে নিতে হতো তাঁকে।

কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের আইপিএল অভিযান শেষ হয়ে গিয়েছে। তবে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের তরফ থেকে দুবাইয়েই থেকে যেতে বলা হয়েছে তাঁকে। ‘২ নভেম্বর দেশে ফেরার কথা ছিল। তবে অস্ট্রেলিয়া সফরে যেতে হবে বলে জৈব সুরক্ষা বলয় ভেঙে বেরতে বারণ করা হয়েছে আমাকে,’ দুবাই থেকে হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলে এবিপি আনন্দকে বলছিলেন দয়ানন্দ।



জামিট্যা গ্রামে বাবা, মা, দাদা-বৌদিদের নিয়ে সংসার। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর জো। মাটির বাড়ি। টিনের চাল। পারিবারিক জীবিকা কৃষিকাজ। দয়ানন্দ বলছেন, ‘জমিতে ধান ও অন্যান্য শস্যের চাষ হয়। তাতেই কোনও মতে সংসার চলে। আমিও সময় পেলেই চাষবাষের কাজে হাত লাগাই। ধান রোওয়া থেকে শুরু করে হ্যান্ড ট্রাক্টর দিয়ে জমি চষা, সব কাজই করি।’

প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ভারতীয় ক্রিকেটের মূল স্রোতে কীভাবে? দয়ানন্দ বলছেন, ‘ছোট থেকেই ক্রিকেট ভালবাসতাম। নিজে খেলতামও। ডানহাতি মিডিয়াম পেসার আমি। ২০০৭ সালে কোলাঘাট থেকে কলকাতার যুবভারতী স্টেডিয়ামে ফ্রেন্ডস অফ দ্য স্টেডিয়ামের ক্যাম্পে প্র্যাক্টিস করতে যেতাম। তবে রোজ যাতায়াত করার অর্থ ছিল না। তাই কোলাঘাটেই কৌশিক ভৌমিকের (লাট্টুদা) কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। মাসে মাত্র ২০ টাকা খরচে। লাট্টুদা ও ডঃ মলয় পাল দারুণভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।’



কোলাঘাট থেকে ময়দানে খেলতে আসা। বরানগর স্পোর্টিংয়ের হয়ে সিএবি-র দ্বিতীয় ডিভিশন লিগে খেলা শুরু করেন দয়ানন্দ। তারপর হোয়াইট বর্ডার, মৌরি স্পোর্টিং হয়ে কলকাতা পুলিশ দলে। পুলিশ দলের কর্তা দেবরাজ নাহাটা গ্রিন পুলিশে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন তাঁকে। সেই সময়ই অলোকেন্দু লাহিড়ীর মাধ্যমে দয়ানন্দের আলাপ হয় সঞ্জীব দাসের সঙ্গে। সঞ্জীব তখন রাজস্থান রঞ্জি দলের ট্রেনার। তাঁর উৎসাহেই ম্যাসিওর ও থ্রো ডাউন স্পেশ্যালিস্ট হিসাবে নতুন ইনিংস শুরু দয়ানন্দের। ২০১৬ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ ক্রিকেট দলে নিযুক্ত হন। সঞ্জীবের পরামর্শেই সেখানে ডান ও বাঁ হাতে নেটে বোলিং শুরু করেন দয়ানন্দ। দ্রুত তাঁর কাজ সকলের নজর কেড়ে নেয়।

এখন বাংলার সিনিয়র দলের ট্রেনার সঞ্জীব। বলছিলেন, ‘দয়ানন্দের দু’হাতেই বল করার অদ্ভুত দক্ষতা রয়েছে। থ্রো ডাউনও করে দু’হাতে। এতে ব্যাটসম্যানদের ডানহাতি ও বাঁহাতি – দুরকম বোলারের বিরুদ্ধেই প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হয়।’ বেঙ্গালুরুতে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন দয়ানন্দ। চলতি আইপিএলের আগে প্রীতি জিন্টার কিংস ইলেভেন পঞ্জাব দলে নিযুক্ত হন।

ক্রিস গেইল-কে এল রাহুলদের প্র্যাক্টিসসঙ্গী হওয়ার অভিজ্ঞতা কীরকম? দয়ানন্দ বলছেন, ‘রাহুল, ময়ঙ্ক অগ্রবাল, মহম্মদ শামি, গেইল, সকলেই আমার কাজে খুশি। কোচ অনিল কুম্বলেও খুব উৎসাহ দিয়েছেন।’

পঞ্জাব শিবিরে ভাল কাজ করার সুবাদেই ভারতীয় দলে সুযোগ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ৪টি টেস্ট ও ৩টি করে ওয়ান ডে ও টি-টোয়েন্টি খেলবে ভারতীয় দল। প্যাট কামিন্স, জশ হ্যাজলউডদের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই কোহলি-অজিঙ্ক রাহানেদের। সেই দ্বৈরথের প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন বাংলার দয়ানন্দও।