কলকাতা: চারদিকে রুক্ষ পাহাড়। মাঝে-মধ্যে ঝোপঝাড়, গাছপালা। পা বাড়াতে গেলেই উড়ে আসছে পাক সেনার গোলা। ছুটে আসছে বুলেটের ঝাঁক। বাতাসে বারুদের ঝাঁঝ। চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ছে সহযোদ্ধার রক্তাক্ত দেহ। তার মধ্যেই দেশরক্ষার প্রত্যয়ে বুঁদ হয়ে দৃঢ়চেতা, কিন্তু সতর্ক পদক্ষেপ। বিপদকে উপেক্ষা করে, জীবন বিপন্ন করে শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করার অঙ্গীকার। ১৯৯৯ সালে কার্গিলে যে শপথের কাছে মাথা নুইয়েছিল পাক সেনা। শনিবার, ভারতের ৭৪তম স্বাধীনতা দিবসে জব্বলপুর থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি আনন্দ-র সঙ্গে কার্গিল যুদ্ধের রোমহর্ষক স্মৃতি ভাগ করে নিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সাব মেজর রিচপাল সিংহ সালারিয়া। যিনি তিরন্দাজিতেও জিতেছেন প্রচুর পদক। আপাতত জাতীয় তিরন্দাজি দলের কোচ রিচপাল। তাঁর প্রশিক্ষণে কমনওয়েলথ গেমস থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ, সর্বত্র পদক জিতেছেন দীপিকা কুমারী, অতনু দাস, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিরন্দাজরা।


বাবা ৭১-এর যুদ্ধ লড়েছেন, উৎসাহ দেন মা-ও

কার্গিল যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ২০ বছর। তার আগে থেকেই তিরন্দাজিতে ছিলাম। যখন যুদ্ধ শুরু হল, আমাদের সকলকে কার্গিল যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। দেশের স্বার্থ সব সময়ই অগ্রাধিকার পায়। তবে যুদ্ধে যেতে হচ্ছে বলে বাড়ির কারও চোখেমুখে বিষণ্ণতা দেখিনি। বাড়ির সকলে এত সমর্থন করেছেন যে, দারুণ ইতিবাচক হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। বাবা-মা কান্নাকাটি শুরু করলে মনোবল ভেঙে যায়। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান। বাবা রঘুবীর সিংহ সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। বাবা অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, দেশকে সেবা করার এই সুযোগ বারবার আসে না। দেশের স্বার্থই আমাদের পরিবারের সকলের কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছে। দেশের জন্য কিছু করছি, সেই গর্ব অনুভব করাটাই একজন সেনার মূলধন। যুদ্ধে যাওয়ার সময় বাবা-মা আর ভাই ও বোন কেউ একবারও উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। মা কমলা দেবী আমাকে জম্মু ভারিব্রামনার বাড়ি থেকে ট্রান্সিট ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। মায়ের চোখে গর্ব ঠিকরে বেরচ্ছিল। কোনও উদ্বেগ দেখিনি। আমাকে ট্রান্সিট ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হয়েছিল। তারপর সেখান থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশে কনভয় যায় একের পর এক।

রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ ভারতের পুরুষ তিরন্দাজদের সঙ্গে রিচপাল (মধ্যে)

যুদ্ধে নিহতদের চিনব কী করে, শেখান বাবা

ছোট থেকে দেখতাম বাবার ব্যক্তিত্ব, সেনার পোশাক পরিপাটি করে পরা, শৃঙ্খলাপরায়ণতা। এসব দেখেই মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তখন যুদ্ধ কী, সেসব বুঝতাম না। সেই থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতাম সেনাবাহিনীতে যোগ দেব। পরে বাবা যুদ্ধের গল্প শোনাতেন। বলতেন, কীভাবে কেউ মারা গিয়েছে কি না শনাক্ত করতে হয়। মুখোমুখি যুদ্ধ কীরকম হয়। এসব শুনে একটা অভিজ্ঞতা তো তৈরি হয়ই। কার্গিল যুদ্ধে যাওয়ার আগে আমিও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। জানতাম যুদ্ধক্ষেত্রে কী ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে।

চোখের সামনে শহিদ সহযোদ্ধা

যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব বারবার পাল্টে যেতে থাকে। কখনও হয়তো রেনফোর্সমেন্টের দায়িত্ব সামলাতে হয়েছে। যাদের কাজ হল যারা যুদ্ধ করছে তাদের খাবার-অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া। কখনও পার্সেলের দেখাশোনা করতে হয়েছে, কখনও আবার আমাদের সরাসরি যুদ্ধ করতে হয়েছে। আমি ১৬ গ্রেনেডিয়ার্স রেজিমেন্টের সদস্য ছিলাম। দ্রাস সেক্টরে পোস্টিং ছিল। আমাদের ব্যাটেলিয়নের প্রায় ৪০ জন একসঙ্গে ট্রেনিং করেছিলাম। ২৩ জুলাই তাদের মধ্যে থেকেই এক সহযোদ্ধা চোখের সামনে পাক সেনার গুলিতে শহিদ হন। তাঁর নাম পবন কুমার। একসঙ্গে ট্রেনিং করেছিলাম আমরা। নিহত ও আহতদের সরিয়ে নিয়ে আসাও আমাদের দায়িত্ব ছিল। কার্গিল যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে আমি একেবারে নতুন। সিনিয়রদের নির্দেশ মেনে কাজ করেছি।

কেন এত কঠোর ট্রেনিং, বোঝা যায় যুদ্ধে গেলে

দেশের জন্য কিছু করার জন্য সবসময়ই একটা ইতিবাচক মনোভাব থাকে। সেনার কাজ শুধু কঠিনই নয়, ভীষণ কঠিন। সকলে সেই সুযোগ পায় না। ভীষণ কষ্টসাধ্য ট্রেনিং করানো হয়। যারা সুযোগ পায়, সকলেরই বয়স থাকে ১৭-১৮ বা ১৯ বছর। সকলেই তখন ভাবে, কেন এত কঠোর ট্রেনিং করানো হচ্ছে। এর সুফল বোঝা যায় যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে। বন্দুকের সামনে দাঁড়াতে গেলে দৃঢ়চেতা তো হতে হবেই। সেই মানসিক কাঠিন্যটা প্রত্যেক সৈনিকের মধ্যে তৈরি করে দেয় শুরুর কড়া প্রশিক্ষণ।

 

ভারতীয় তিরন্দাজদের সঙ্গে কোচ রিচপাল

প্রত্যেক পাহাড়ের আলাদা নামকরণ

যুদ্ধ যে কোনও সৈনিকের কাছেই খুব চ্যালেঞ্জিং। ১৯৯৯ সালে মে মাসের গোড়া থেকে শুরু হয়ে তিন মাস চলেছিল কার্গিল যুদ্ধ। কার্গিল পার্বত্য অঞ্চল। প্রত্যেক পাহাড়ের একটা করে নামকরণ (নাম্বারিং) করা আছে ভারতীয় সেনার। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সমস্ত নামকরণ করে স্পষ্টভাবে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই পাহাড় বা বিশালাকার প্রস্তরখণ্ড ধরে রণকৌশল ঠিক করা হতো। এক একটা পাহাড়ে চড়তে ২-৩ ঘণ্টা করে সময় লেগে যায়। হয়তো আমাদের মিশন হল শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করা। আর তার জন্য পাহাড়ে চড়তে হবে। উল্টোদিক থেকে গুলি-গোলা চলছে, বোমা উড়ে আসছে, তার মধ্যেই জীবন বিপন্ন করে এগিয়ে যেতে হয়েছে।

ঠিক মাথার ওপর উড়ে এল পাক বোমা

বড় বড় প্রস্তরখণ্ড অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণও বাঁচিয়েছে। সামনে থেকে গুলি এলে পাথরের আড়ালে গিয়ে প্রাণরক্ষা করা যায়। একটা ভয়াবহ ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমার যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার ২-৩ দিন পরের ঘটনা। কার্গিলে ভারতীয় সেনার একদল সরাসরি লড়াই করছিল। আর একদল পিছন থেকে সাপোর্ট করেছিল। সেই ভূমিকা অদলবদলও হয়েছে। ফোরফ্রন্টে থাকা একটা ট্রুপকে রেশন ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম আমরা। ফেরার পথে শত্রুপক্ষ কোনওভাবে আমাদের দেখে নিয়েছিল দূর থেকে। পাক সেনা বোমা ছুড়তে শুরু করে। প্রথম বোমাটা আমাদের একশো মিটার দূরে পড়ে। আমি আর পবন দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয় বোমাটা ২০ মিটার দূরে পড়ল। আত্মরক্ষার জন্য তৎক্ষণাৎ আমরা পাথরের নীচে ঢুকে গিয়েছিলাম। তৃতীয় বোমাটা ঠিক আমরা যে পাথরের খাঁজে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তার ওপর পড়েছিল। মৃত্যু অত কাছ থেকে আর দেখিনি। আমরা প্রায় একঘণ্টা পাথরের নীচে শুয়েছিলাম। পাক সেনা ভেবেছিল আমরা মারা গিয়েছি। তারপর আমরা ওখান থেকে ফিরতে পারি।

রাখির দিন ঘরে ফেরা

যুদ্ধক্ষেত্রে চোখের সামনে টানা গুলির লড়াই দেখাটা যে কী রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কার্গিল যুদ্ধজয়ের পর যেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম, সেদিন রাখিবন্ধন উৎসব ছিল। সেটা ছিল ভীষণ আনন্দের দিন! বোনের হাতে সেদিনের রাখি পরাটা যে কী শান্তির ছিল...। এখন বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সংসার করছি। কলকাতাতেও কাটিয়েছি ৫-৬ বছর। কর্মসূত্রে আমাকে জব্বলপুরে থাকতে হয়। সকলকেই কার্গিলের গল্প শোনাই। কারণ, ওই যুদ্ধজয় আমাদের সকলের গর্বের বিষয়।

জাতীয় তিরন্দাজদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব

কার্গিল যুদ্ধের পর তিরন্দাজি চালিয়ে গিয়েছি। যুদ্ধের পরের বছর, ২০০০ সালে অমরাবতীতে জাতীয় তিরন্দাজিতে দলগত বিভাগে সোনা ও ব্যক্তিগত বিভাগে রুপো জিতেছিলাম। ২০১৭ সাল থেকে জাতীয় তিরন্দাজি দলের কোচের দায়িত্বে। আমার প্রশিক্ষণে দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসে পদক জিতেছিল ভারত। বিশ্ব তিরন্দাজির সিনিয়র ও জুনিয়র বিভাগে ও এশীয় তিরন্দাজিতেও আমার প্রশিক্ষণে পদক পেয়েছে ভারতীয় তিরন্দাজেরা। ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাই যে, পদক জয়ও দেশকে গর্বিত করা। সেনাবাহিনী ও খেলাধুলোয় আমাদের দেশে স্ত্রী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। তবে সমাজের অন্যত্র বৈষম্য রয়েছে। সেগুলো দূর করতে হবে। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন যাঁরা, সারা বছর তাঁদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। শুধু ১৫ অগাস্ট বা ২৬ জানুয়ারি পালন করলে হবে না।