কলকাতা: এ বছরের স্বাধীনতা দিবস চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে যাবে রাম বাবুর কাছে। স্বাধীনতার উৎসব অবশ্য কিছুটা ফিকে হয়েছে। কারণ, ওই দিনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেছেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। সেই ধোনি, গত ১৫ বছর ধরে যাঁকে ঈশ্বর মনে করেন রাম। দেশে, দেশের বাইরেও ধোনির জন্য গলা ফাটাতে হাজির হয়ে যান ক্রিকেট মাঠে। ক্রিকেটবিশ্বে সকলে তাঁকে একডাকে চেনে ধোনির ‘সুপারফ্যান’ হিসাবে।


আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধোনিকে আর দেখা যাবে না, এখনও যেন মেনে নিতে পারছেন না রাম। মোহালি থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি আনন্দকে তিনি বললেন, ‘১৫ অগাস্ট কয়েকজন পরিচিতের কাছে খবর পাই যে, সন্ধ্যা ৭.২৯ মিনিটে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি স্যার ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে অবসর ঘোষণা করেছেন। তারপর আমি নিজে ফোন খুলে সেই পোস্ট দেখি। বিস্ময়ে আমার হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। হ্যান্ডসেটটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আর কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি সেদিন থেকে।‘



রাম ভাবতে পারেননি যে, আচমকা এভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াবেন ধোনি। বলছেন, ‘দেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিয়েছেন ধোনি স্যার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ওয়ান ডে বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, টেস্ট ও ওয়ান ডে-তে বিশ্বের এক নম্বর দলের শিরোপা। এত বড় একজন তারকার এমন অবসর ভীষণ বিস্ময়কর। আমি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে অনুরোধ করব, দেশের মাটিতে ধোনি স্যারের একটা বিদায়ী ম্যাচ আয়োজন করার জন্য। যাতে অন্তত ভক্তরা নীল জার্সিতে মাহি স্যারকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ পায়। এই সম্মান ওঁর প্রাপ্য।’

আরও অনেকের মতোই রামেরও ধারণা, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এক বছর পিছিয়ে যাওয়ার জন্যই সম্ভবত অবসর ঘোষণা করেছেন ধোনি। বলছেন, ‘করোনার জন্য পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। তবে সিদ্ধান্তটা মাহি স্যারের ব্যক্তিগত। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে একইরকমভাবে টেস্ট থেকে আচমকা সরে দাঁড়িয়েছিলেন। মাহি স্যার এরকমই। তবে ভক্ত হিসাবে আমি মর্মাহত। গত ১৫ বছর ধরে ওঁকে অনুসরণ করছি। ভারতের ম্যাচ থাকলেই সেখানে পৌঁছে যাই।’



ধোনি-প্রেমের শুরুটা কীভাবে? প্রাক্তন জাতীয় অধিনায়কের সুপারফ্যান বলছেন, ‘আমার বাড়ি চণ্ডীগড়ের মোহালিতে। মাহি স্যারকে প্রথম টিভিতেই দেখেছি। আমি নিজে ক্রিকেট খেলতাম। ক্রিকেট আমার নেশা। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মাহি স্যারের অভিষেক দেখেই ভাল লেগে যায়। সেই শুরু। তারপর পাকিস্তান ভারতে খেলতে আসে। বিশাখাপত্তনমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৪৮ রান করেছিলেন। ওঁর লম্বা চুল দেখে আমিও সেরকমই হেয়ারস্টাইল করেছিলাম। মোহালি স্টেডিয়ামে ম্যাচ থাকলে মাহি স্যারের ৭ নম্বর জার্সি পরে, গগলস চোখে ম্যাচ দেখতে যেতাম। ২০০৯ সাল থেকে গায়ে তেরঙা এঁকে মাঠে যাওয়া শুরু।’

তবে ধোনির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেতে আরও অপেক্ষা করতে হয় রামকে। ‘২০১৩ সালে ধর্মশালায় ভারত-ইংল্যান্ড ওয়ান ডে ম্যাচ ছিল। জানুয়ারি মাস। ধর্মশালার কনকনে ঠাণ্ডা। সাংবাদিক সম্মেলন করে বেরচ্ছিলেন মাহি স্যার। আমি সেখানেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমার সারা গায়ে ভারতের তেরঙার রং। পিঠে ৭ নম্বর লেখা। হাতে জাতীয় পতাকা। আমি গিয়ে মাহি স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যাচ্ছিলাম। মাহি স্যার আমার হাত ধরে আটকান। তারপর বলেন, এখানে খুব ঠাণ্ডা। আপনি টি-শার্ট পরুন। সেটাই আমাকে বলা ওঁর প্রথম কথা,’ বলছিলেন রাম।



তারপর ধোনির সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতে থাকে রামের। ধোনির সুপারফ্যান বলছেন, ‘উনি প্রত্য়েক ম্যাচের টিকিট পাঠিয়ে দিতেন। আমি সব ম্যাচে হাজির হয়ে যেতাম। নিজের পয়সায় এক শহর থেকে আর এক শহর খেলা দেখতে গিয়েছি। পয়সা না থাকলে বিনা টিকিটেও ট্রেনে সফর করে ম্যাচ দেখতে গিয়েছি। পার্টটাইম চাকরি করে টাকা জমাতাম। অনেক সময় বন্ধুরা টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে।’ তবে ২০১৪ সালে সমস্যায় পড়েন রাম। সেবার বাংলাদেশে হচ্ছে এশিয়া কাপ। বাংলাদেশে যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে পারেননি রাম। তাঁর কথায়, ‘আমার সমস্যা শুনে মাহি স্যার আমাকে বিমানের টিকিট কেটে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরে দুবাইয়ে গিয়েছিলাম। অরুণ পাণ্ডে মারফত সেই খরচও মাহি স্যারই দেন।’

২০১৪ সালেরই আর একটা ঘটনা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না রাম। বাংলাদেশেই হয়েছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। টুর্নামেন্ট দেখতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন রাম। ‘সেটা ছিল আমার দ্বিতীয়বারের জন্য বাংলাদেশ সফর। টুর্নামেন্ট চলাকালীন আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম। খাওয়াদাওয়া করতে পারিনি। আমি অবশ্য ওষুধ না খেয়ে, সব কিছু উপেক্ষা করে মাঠে পৌঁছে যেতাম খেলা দেখতে। মাহি স্যারের কাছে খবর যেতেই উনি আমার সঙ্গে মাঠেই দেখা করেন। সব রিপোর্ট খতিয়ে দেখে বলেন, সন্ধ্যায় টিমহোটেলে দেখা করতে। সেখানে যেতে আমার পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকা থেকে চণ্ডীগড়ের ফ্লাইটের টিকিট কেটে দেন। পরের দিন ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার সেমিফাইনাল ম্যাচ ছিল। সেই ম্যাচটা দেখতে পারিনি। চণ্ডীগড়ে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছিলেন মাহি স্যার। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, ধোনিকে ধন্যবাদ দিন। চিকিৎসা না করালে প্রাণে মারা পড়তেন!’ বলছিলেন রাম।



২০১৬ সালে এশিয়া কাপের সময় ফের বাংলাদেশে গিয়েছিলেন রাম। সেবারও খরচ দিয়েছিলেন ধোনি। রাম বলছেন, ‘মাহি স্যারের কাছে কোনওদিন টাকা চাইনি। তবে খেলা দেখতে পারব না, এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে বলতাম। উনি সবসময় সাহায্য করেছেন। আমাকে অনেক টি-শার্ট দিয়েছেন। গত দীপাবলীর সময় রাঁচিতে ভারতের খেলা দেখতে গিয়ে মাহি স্যারের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওঁকে ছোট্ট একটা উপহারও দিয়েছিলাম।’

ধোনির অবসরের খবর পেয়ে বিমর্ষ রাম। বললেন, ‘মাহি স্যারের বন্ধু চিট্টু ভাইয়াকে (সীমন্ত লোহানি) ফোন করেছিলাম। মাহি স্যার তখন চেন্নাইয়ে। চিট্টু ভাইয়া বলেছেন, আমার বার্তা পৌঁছে দেবেন ওঁর কাছে। সুযোগ পেলেই ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করব। মাহি স্যার যে কাজই করবেন, আমি পাশে থাকব।’



করোনা পরিস্থিতিতে এখন কর্মহীন রাম। সংসার চালাতে সমস্যা হচ্ছে। মোহালির বাড়িতেই আছেন। কাজ খুঁজছেন। তারই মাঝে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে আইপিএল দেখতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। রাম বলছেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে দর্শকশূন্য ম্যাচে আইপিএল শুরু হবে। তবে পরের দিকে মাঠে ২০-৩০ শতাংশ দর্শক ঢুকতে দেওয়া হতে পারে শুনছি। সেরকম সুযোগ তৈরি হলে ইউএই যাব। চেন্নাই সুপার কিংসের হলুদ জার্সিতে মাহি স্যারের হয়ে গলা ফাটাব।’