কলকাতা: শীতের শহরে শিয়ালদা কোলে মার্কেটে আটকে গিয়েছে বহু আলু পেঁয়াজের লরি। নাজেহাল পুলিশ। কারণ কী?


দেখা গেল, বাজারের বাইরে যেখানে সকালে পা রাখার জায়গা থাকে না, সেখানে একটা টিভি। আর কম করে হলেও একশো মানুষ বসে আছেন। তখন রাত সাড়ে ১২টা। আবার বেহালার চৌরাস্তায় বিশাল জায়ান্ট স্ক্রিন। সব কটা রাজনৈতিক পার্টির অফিসে ভিড়। একটা গোল মিস হতেই চিৎকার চেঁচামেচি। গাঙ্গুলিবাগানে দেখা গেল ঝালমুড়ি বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু দোকানদারকে হাতে হাতে সবাইকে ঠোঙা পৌঁছে দিতে হচ্ছে। কেউ দোকানে এসে ঝালমুড়ি নিয়ে যাচ্ছেন না। সবাই তো ক্লাবের সামনে বসে! নড়বেন না। প্রিয় দলের ম্যাচ চলছে যে।


ভবানীপুর, শোভাবাজার, কসবা, সিঁথি, সব জায়গায় এক ছবি। এই শহর ফুটবল অন্ত প্রাণ। আর যদি এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল আর্জেন্তিনা মুখোমুখি হয়? তা হলে তো কথাই নেই। বিশ্বকাপের এই ম্যাচ দেখার জন্য হয়তো ছুটিও ঘোষণা হয়ে যেতে পারে।  বিশ্বকাপে ফিফার সূচি অনুযায়ী দুই দল নিজেদের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ জিতলে দেখা হতে পারে সেমিফাইনালে। আর সেই ম্যাচ যদি হয়, তাহলে ৩২ বছরের অপেক্ষার অবসান হবে। সেই ম্যাচ হয়তো গত তিন দশকে বিশ্বকাপের মঞ্চে সব থেকে আলোচিত আর চর্চিত ম্যাচ হতে চলেছে। যার জন্য ২৪ ঘণ্টা জাগতে বললেও রাজি হয়ে যাবেন ফুটবলপ্রেমী বাঙালি।


বিশ্বকাপের (Fifa World Cup) মঞ্চে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা (Brazil vs Argentina) এখনও পর্যন্ত চারবার মুখোমুখি হয়েছে। কী ফল হয়েছিল সেই চার সাক্ষাতে?


প্রথম সাক্ষাৎ


১৯৭৪ সালে ব্রাজিল আর আর্জেন্তিনা বিশ্বকাপে প্রথমবার মুখোমুখি হয় গ্রুপ এ দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে। পশ্চিম জার্মানি ছিল সেই বিশ্বকাপের আয়োজক। ব্রাজিল  ২-১ গোলে হারায় আর্জেন্তিনাকে। ব্রাজিলের হয়ে মিডফিল্ডার রেভিলিনহো ৩২ মিনিটে প্রথম গোল করার পর ৩৫ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে উঠে এসে গোল শোধ করেন আর্জেন্তিনার অধিনায়ক মাগুয়েল বৃন্দিসি। টানটান সেই ম্যাচে কে জিতবে বোঝা যাচ্ছিল না। এক ইঞ্চি জমি কেউ কাউকে ছাড়েনি। এরপর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ব্রাজিলের জর্জিনহো ৪৯ মিনিটে গোল করেন। তারপর আর্জেন্তিনা বহু চেষ্টা করেও সমতা ফেরাতে পারেনি। ব্রাজিল জিতে যায়। আর্জেন্তিনার রেনি হাউসম্যান ৭২ মিনিটে হলুদ কার্ড দেখেন কড়া ট্যাকল করার জন্য। সেই বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানি জেতে। হল্যান্ড অর্থাৎ নেদারল্যান্ডস রানার আপ হয়।


দ্বিতীয় সাক্ষাৎ


১৯৭৮ সালে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনার ম্যাচে উত্তেজনায় কাঁপছিল সারা বিশ্ব। গ্রুপ বি ম্যাচ ছিল। রবিবার। জুন মাসের ১৮ তারিখ। আর্জেন্তিনার মাঠে খেলা। ব্রাজিল বনাম আর্জেন্তিনা। আর সেবার আর্জেন্তিনা অন্যতম ডার্ক হর্স। উত্তেজনায় ভরপুর ম্যাচে ব্রাজিলের সিয়াকাও প্রথম হলুদ কার্ড দেখেন ৪৫ মিনিটে। ০-০ স্কোর তখন। আর্জেন্তিনার সমর্থকদের পাল্লা ভারি। দ্বিতীয়ার্ধে ৬৭ মিনিটে মেজাজ হারিয়ে ফাউল করে বসেন ব্রাজিলের এডিনহো। বহুবার চেষ্টা করেও গোল না পেয়ে হতাশ জিকো ৭৪ মিনিটে ফাউল করে দেখলেন হলুদ কার্ড। ৯০ মিনিট পার। স্কোরলাইন ০-০। আর্জেন্তিনার মাটিতে ব্রাজিল যেমন জিততে পারল না, তেমনই আর্জেন্তিনাও নিজেদের হোম গ্রাউন্ডে হারাতে পারল না ব্রাজিলকে। সেই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্তিনা। ব্রাজিল হয় তৃতীয়। নেদারল্যান্ডস রানার্স। বিশ্বকাপে আর্জেন্তিনার মারিও কেম্পেস ৬ গোল দিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। 


তৃতীয় সাক্ষাৎ


১৯৮২ সাল। স্পেনে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ। গ্রুপ সি। একই গ্রুপে তিন বড় দল। ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা ও ইতালি। ১৯৭৮ সালের ম্যাচ আমীমাংসিত ছিল। সেই ম্যাচে বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার জিকো ১৯৮২ সালে অভিজ্ঞ ফুটবলার। ম্যাচের শুরুতেই ১১ মিনিটের মাথায় ব্রাজিলের একটি ফ্রি কিক গোলকিপারের হাতে লেগে বারে লেগে নিচের দিকে নেমে আসে। দৌড়ে তরতাজা জিকো বলকে জলে জড়িয়ে দেন। যদিও কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় আর্জেন্তিনা। শক্ত ডিফেন্স বারবার ব্রাজিলের মারাত্মক আক্রমণকে আটকে দিতে থাকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর কিছু সময় পর্যন্ত স্বাভাবিক খেলা চললেও, ৬৬ মিনিটের মাথায় স্ট্রাইকার সার্জিনহো ব্রাজিলের হয়ে হেডে গোল করেন। এরপর যেন ব্রাজিল অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিল। আর ৭৫ মিনিটে রক্ষণভাগের ফুটবলার জুনিয়রের গোলে ৩-০ এগিয়ে যায় ব্রাজিল। এরপর ম্যাচ যত গড়ায় তত উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সেদিন শুরু থেকে মাঠে ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। দূরপাল্লার শট থেকে শুরু করে সেই চেনা দৌড়ে বক্সে ঢুকে একাধিক শট মারলেও গোল হচ্ছিল না। মেজাজ হারিয়ে লাথি মেরে বসেন ব্রাজিলের ডিফেন্ডার বাতিস্তাকে। তাই ৮৫ মিনিটে রেড কার্ড হজম করতে হয় তাঁকে। ব্রাজিল দুটি হলুদ কার্ড দেখে। এমনকী, আর্জেন্তিনার অধিনায়ক পাসারেলাও হলুদ কার্ড দেখেন। হলুদ কার্ড দেখেন ব্রাজিলের গোলরক্ষক। কিন্তু আর্জেন্তিনা তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ৮৯ মিনিটে মুখরক্ষা হয় ব়্যামন দিয়াজের গোলে। ম্যাচ শেষে স্কোরলাইন ৩-১ ব্রাজিলের পক্ষে। সেই বিশ্বকাপ ইতালি জয়ী হয়। রানার্স আপ হয় পশ্চিম জার্মানি।


চতুর্থ সাক্ষাৎ


১৯৯০ সাল। এবার আর্জেন্তিনার প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। আর সেটাই হল। ১-০ গোলে ব্রাজিলকে হারাল আর্জেন্তিনা। কিন্তু জেতার পথ অত্যন্ত দুর্গম ছিল। ম্যাচে মোট ৬টি কার্ড রেফারিকে দেখাতে হয়। আর্জেন্তিনার একজন মিডফিল্ডার ও একজন ডিফেন্ডার হলুদ কার্ড হজম করেন। এমনকী, আর্জেন্তিনার গোলরক্ষক হলুদ কার্ড দেখেন। আর ব্রাজিলের তিনজন ডিফেন্ডার হলুদ কার্ড দেখেন। ৮৩ মিনিটে তাঁদের মধ্যে ব্রাজিলের অধিনায়ক রিকার্দো গোমস লাল কার্ড দেখে বসেন। সেই ম্যাচে সমতা ফেরাতে পারেনি ব্রাজিল।


অর্থাৎ স্কোর হল ব্রাজিল ২ আর্জেন্তিনা ১। আমীমাংসিত ১ ম্যাচ। এবার কি আর্জেন্তিনার সমতা ফেরানোর পালা? নাকি লিড বাড়াবে ব্রাজিল?


বিশ্বকাপ এখন মধ্য গগনে। তাই তিলোত্তমা কলকাতা রোজ রাত জাগছে। আর উত্তেজনায় ফুটছে। অলি গলি সেজেছে পছন্দের দলের পতাকায়। মেসি-রোনাল্ডো-নেমার-এমবাপেদের ছবিতে। এবার ব্রাজিল বনাম আর্জেন্তিনা ম্যাচ হোক, চাইছেন প্রতিটা ফুটবলপ্রেমী মানুষ। হবে নাই বা কেন? টিভির পর্দার সেই তারকাদের মধ্যে অনেকেরই পা স্পর্শ করেছে সিটি অফ জয়ের মাটিও।


১৯৭৭ সালে পেলে, ২০১১ সালে লিওনেল মেসি, ২০২২ সালে কাফু। আর যাঁর কথা না বললে চলবে না, তিনি দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। একবার নয়, দু-দুইবার। ২০০৮ ও ২০১৭ সালে। বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের ৯৯ শতাশই আর্জেন্তিনা আর ব্রাজিলের সমর্থক। হাইভোল্টেজ একটি সেমিফাইনালের অপেক্ষায় বাঙালি ক্রীড়াপ্রেমীরা।


আরও পড়ুন: আজ দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে খেলবেন নেমার? কী বলছেন ব্রাজিলের কোচ?