দোহা: মেসি (Lionel Messi) যদি বিশ্বকাপ না জেতেন?
‘তাহলেও ও-ই বিশ্বসেরা থাকবে। পরের দিন সকালেও সূর্য উঠবে। সন্ধ্যায় অস্ত যাবে।’ গত বছর সরল গলায় বলে দিয়েছিলেন লিওনেল স্কালোনি।
নামটা মাথায় গেঁথে নিন। লিওনেল স্কালোনি (Lionel Scaloni)।
বিশ্বকাপের অন্যান্য দলের কোচদের দেখুন। স্যুটেড-ব্যুটেড। কোচ মানেই যেন অন্য এক শ্রেণির প্রতিনিধি। যিনি ধোপদুরস্ত পোশাক পরবেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে চোখা ভাষায় কথা বলবেন। দল গোল দিলে মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুড়ে দেবেন।
আর সেখানে স্কালোনিকে দেখুন। পরনে সাদামাটা ট্র্যাক শ্যুট। দল জিতলে হুঙ্কার দেওয়া নেই। প্রবল চাপের মুখে গোল খেলেও নির্লিপ্ত। গোল করলেও ভাবলেশহীন। হাতে মেসির মতো ব্রহ্মাস্ত্র। অথচ প্রতিপক্ষকে সমীহ করেন। দেখে নেব, মেরে ফেলব, কেটে ফেলব টাইপের কথাবার্তা এই ভদ্রলোকের মুখে কোনওদিন শুনবেন না। কোনও সিনিয়র দলকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। সহকারী কোচ থেকে সরাসরি হেড কোচের চাকরি। তাও আবার আর্জেন্তিনার মতো দলের। যে দলে পান থেকে চুন খসা মানে দেশীয় সাংবাদিকরা ধুয়ে দেবে। এরকম দলের দায়িত্বপ্রাপ্তি যে কাউকে পৌঁছে দেবে সপ্তম স্বর্গে।
স্কালোনি জানেন, তিনি বাঘের পিঠে সওয়ার। তাই কোপা আমেরিকা জিতেও আবেগে ভেসে যাননি। সে যতই ফুটবলাররা জয়ের আনন্দে তাঁকে কোলে তুলে লোফালুফি করুক না কেন! বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেও নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করছেন। ফ্রান্স ম্যাচের আগে সাংবাদিক বৈঠকে গলা ধরে এসেছে। কিন্তু আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন পেশাদারিত্বের সঙ্গে। স্কালোনি সত্যিই এক ব্যতিক্রমী চরিত্র।
আর্জেন্তিনার কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রাতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল অপেক্ষা। জাতীয় দলের জার্সিতে প্রথম বড় কোনও ট্রফি জেতা মেসি কি পারবেন বিশ্বকাপ মাথার ওপর তুলে ধরতে? প্রশ্নটা শুনে নির্লিপ্ত ছিলেন স্কালোনি। বলেছিলেন, ‘কাপ জিতুক আর না জিতুক, মেসি মেসি-ই।’
ফাইনালের আগে সেই স্কালোনি এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন, তাঁর পূর্বসূরি দানিয়েল পাসারেল্লা, আলেহান্দ্রো সাবেয়া, হর্হে সাম্পাওলি এমনকী, কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনারা যা কোনও দিন ভাবতেও পারেননি।
কী করেছেন স্কালোনি?
আর্জেন্তিনা শিবিরে এনে হাজির করেছেন সেই সমস্ত চরিত্রকে, যাঁরা ফুটবল বিশ্বকাপে মাঠে নামতে পারতেন। পারেননি। কারণ, কারও অসুস্থতা। কারও চোট। সের্খিও আউয়েরো যেমন। হৃদযন্ত্রের সমস্যা ধরা না পড়লে যিনি মেসির সঙ্গে বিশ্বকাপে দলের আক্রমণভাগ সামলাতেন। যিনি দলে থাকলে তরুণ তুর্কি হুলিয়ান আলভারেজের হয়তো বিশ্বকাপে খেলাই হতো না। আরও কত এরকম নাম। জিওভানি লো সেলসো, জোয়াকিন কোরেয়া, নিকোলাস গঞ্জালেস, রবের্তো পেরেইরা, লুকাস মার্তিনেজ কোয়ার্তা, হুয়ান মাজো, নিকোলাস ডমিঙ্গেস। দলের সবাইকে এককাট্টা করতে সব চরিত্রকে দোহায় জাতীয় দলের শিবিরে এনে ফেলেছেন স্কালোনি। অভিনব উদ্যোগ। নিঃসন্দেহে। আর তাই তিনি ফুটবলারদের কোচ। ফুটবলারদের বন্ধু। অনুশাসন আছে। কিন্তু ক্যানিজিয়াকে সোনালি চুল না কাটলে দলে না রাখার ভিত্তিহীন জেদ নেই। বরং আছে সব মুহূর্তে পাশে থাকার আশ্বাস। স্কালোনি কোচ নন, যেন পরিবারের বড় দাদা। যাঁর সঙ্গে সুখ-দুঃখ অবলীলায় ভাগ করে নেওয়া যায়। আর্জেন্তিনার ফুটবলাররাও তাই মেসির পাশাপাশি স্কালোনির জন্যও জীবন বাজি রাখতে পারেন। মেসিও যে তালিকার বাইরে নন।
আর কী করেছেন স্কালোনি?
মেসির ছত্রছায়ায় থেকেও মেসি-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার সাহস দেখিয়েছেন। আর্জেন্তিনা ফুটবলকে স্বাবলম্বী করে তোলার সংকল্প দেখিয়েছেন। যা আর্জেন্তিনার আগের কোনও কোচ পারেননি। আলভারেজ, এনজো ফার্নান্দেজদের তুলে এনেছেন। গত বছর দশেক ধরে আর্জেন্তিনার খেলার একটাই মন্ত্র ছিল। বল পায়ে পেয়েছো কী, মেসিকে বাড়াও। বাকিটা ও-ই সামলে নেবে, এই বিশ্বাসে। স্কালোনি প্রথম বুঝেছিলেন, মেসি অন্য গ্রহের ফুটবলার। কিন্তু মানুষ হিসাবে তো রক্ত-মাংসেরই। একার পক্ষে সব ম্যাচ জেতানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি মেসি পরবর্তী আর্জেন্তিনা ফুটবলের কী হবে?
অগত্যা আলভারেজ, এনজো ফার্নান্দেজদের উত্থান।
রবিবার দোহার লুসেইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্তিনা বিশ্বকাপ জিতলে ইতিহাস স্পর্শ করবেন মেসি। মারাদোনার সঙ্গে একই আসনে বসে পড়বেন।
আর না পারলে?
মেসি মেসি-ই থাকবেন। আধুনিক ফুটবলের সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে সোনালি অধ্যায় হয়ে। ফুটবলের ইতিহাসে অমর-অক্ষয় হয়ে। কিংবদন্তি হয়ে। ফুটবলের জাদুকর হয়ে।
আর স্কালোনি হয়তো তখন মুচকি হাসবেন। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায়। মনে মনে হয়তো বলবেন, ‘মেসি মেসি-ই...’।
আরও পড়ুন: মেসি ম্যাজিকে মুগ্ধ কাফুও , আর্জেন্তিনার বিশ্বজয় দেখতে চান প্রাক্তন ব্রাজিল অধিনায়ক