কোচি: কয়েক দিন আগে কেরল ব্লাস্টার্সের (Kerala Blasters) মাঠে গিয়ে তাদের হারিয়ে দিয়ে এসেছিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এ বার সেই একই কাণ্ড ঘটিয়ে দেখাল তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল (East Bengal)l। বুধবার কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে হলুদ ও লাল-হলুদ বাহিনীর লড়াইয়ে কেরল ব্লাস্টার্সকে ৪-২-এ হারাল ১১ নম্বরে থাকা ইস্টবেঙ্গল। জোড়া গোল করেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার সাউল ক্রেসপো ও নাওরেম মহেশ সিংহ (Naorem Mahesh Singh)।
মঙ্গলবার রাতেই চলতি আইএসএলের প্লে অফে নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর এ দিন নিজেদের মাঠে নেমে মেজাজ ধরে রাখতে না পারার মাশুল দিতে হয় ব্লাস্টার্সের দুই তরুণ সদস্য মিডফিল্ডার জিকসন সিংহ ও ডিফেন্ডার নাওচা সিংহকে। এই দু’জন লাল কার্ড দেখায় এ দিন ন’জনে খেলতে হয় কেরল ব্লাস্টার্সকে। ফলে ম্যাচে আধিপত্য বিস্তার করতে সুবিধা হয় লাল-হলুদ বাহিনীর। তাও দু’টি গোল শোধ করে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল হলুদ-বাহিনী। এর মধ্যে প্রথমটি করেন তাদের লিথুয়ানিয়ান ফরোয়ার্ড ফেদর সেরনিচ। অন্যটি ছিল আত্মঘাতী গোল, ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডার হিজাজি মাহেরের।
চলতি লিগের পাঁচ নম্বর জয় পেয়ে লিগ টেবলের সাত নম্বরে উঠে এল ইস্টবেঙ্গল। অর্থাৎ, তারা এখন প্লে অফের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। সম্প্রতি মোহনবাগান এসজি-কে কলকাতার মাটিতে হারিয়ে দেয় এগারো নম্বরে থাকা চেন্নাইয়িন এফসি। এ বার কেরল ব্লাস্টার্সকে তাদের ঘরের মাঠে হারাল ইস্টবেঙ্গল। কাকতালীয় হলেও সত্যি যে এগারো নম্বরে থাকা দলগুলি কিন্তু পরপর অঘটন ঘটাচ্ছে। লিগ টেবলের ওপরের চেয়ে এখন নীচের দিকের অবস্থা অনেক বেশি রোমহর্ষক।
ছ’নম্বরে থাকা বেঙ্গালুরু এফসি-র সংগ্রহ ২০ ম্যাচে ২২। এর পরের চারটি স্থানে থাকা দলগুলির পয়েন্ট সংখ্যা ২১। এদের মধ্যে শুধু চেন্নাইন ১৯টি ম্যাচ খেলেছে। বাকি তিন দলেরই ২০টি করে ম্যাচ হয়ে গিয়েছে। এখন যারা ১১ নম্বরে, সেই নর্থইস্ট ইউনাইটেডের খাতায় ১৯ ম্যাচে ২০। তাদের পরের ম্যাচ ঘরের মাঠে এই কেরল ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধেই। লিগ যত শেষের দিকে এগোচ্ছে, ততই উত্তেজনার পারদ চড়ছে।
বুধবার কোচির ম্যাচও সারাক্ষণ এ রকমই টানটান উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। মহম্মদ রাওকিপ, সায়ন বন্দোপাধ্যায় ও পিভি বিষ্ণুকে এ দিন প্রথম একাদশে রেখে দল নামিয়ে আক্রমণাত্মক ফুটবল দিয়েই শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। বরং ঘরের মাঠে কিছুটা কোণঠাসা মনে হচ্ছিল কেরল ব্লাস্টার্স এফসিকেই।
শুরুর দিকে ঘন ঘন আক্রমণে ওঠেন ক্লেটন সিলভা, সায়ন বন্দোপাধ্যায়, নাওরেম মহেশ সিংহ, পিভি বিষ্ণুরা। কিন্তু কোনও বারেই সফল হতে পারেননি। বক্সের সামনে একাধিক ফ্রি কিকও পায় তারা। কিন্তু তাতেও ব্যর্থতা। প্রথম কুড়ি মিনিটের মধ্যে যেখানে লাল-হলুদ বাহিনী সাতবার গোলের সুযোগ তৈরি করে, সেখানে ব্লাস্টার্স একটিও সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। চোট সারিয়ে মাঠে ফেরা সল ক্রেসপোও দূরপাল্লার শট নেন গোল লক্ষ্য করে। কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বক্সের মাথা থেকে নেওয়া ক্লেটনের শট দ্বিতীয় পোস্টের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়।
এত সবের পরেও ম্যাচের প্রথম গোলটি করে কেরল ব্লাস্টার্সই এবং সেটিই ছিল ম্যাচে তাদের প্রথম গোলে শট। ২৩ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিয়ে মাঝমাঠ পেরিয়ে ব্লাস্টার্সের লিথুয়ানিয়ান ফরোয়ার্ড ফেদর সেরনিচকে থ্রু বাড়ান রাহুল কেপি। তখন ইস্টবেঙ্গলের প্রায় সবাই গোল করার জন্য উঠে গিয়েছেন। নিজেদের এলাকায় ছিলেন শুধু আলেকজান্দার প্যানটিচ। সেরনিচের পা থেকে বল কাড়ার জন্য গোল ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে আসেন প্রভসুখন গিল। কিন্তু কেউই আটকাতে পারেননি তাঁকে। বক্সে ঢুকে ফাঁকা গোলে বল ঠেলে দেন সেরনিচ (১-০)।
গোল খাওয়ার পর বেশ কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়ে ইস্টবেঙ্গল। এই সময়ে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে ব্লাস্টার্স। কিন্তু ম্যাচের মোড় ঘোরে প্রথমার্ধের একেবারে শেষ দিকে, যখন ৪৫ মিনিটের মাথায় ভারতীয় দলের ফুটবলার জিকসন সিং ম্যাচের দ্বিতীয় হলুদ কার্ড তথা লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে যান। দু’বারই নাওরেম মহেশ সিংকে ফাউল করে কার্ড দেখেন তিনি। ব্লাস্টার্স এখান থেকেই দশজনে খেলা শুরু করে এবং স্টপেজ টাইমে আরও বড় ভুল করেন তাদের গোলকিপার করণজিৎ সিংহ। গোলমুখী বিষ্ণুকে বক্সে অবৈধ ভাবে বাধা দেন তিনি। ফলে পেনাল্টি পায় ইস্টবেঙ্গল। বিরতিতে যাওয়ার ঠিক আগে স্পট কিকে গোল করতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় সাউল ক্রেসপো (১-১)। প্রথমার্ধে ব্লাস্টার্স যেখানে দু'টির বেশি শট গোলে রাখতে পারেনি, সেখানে ইস্টবেঙ্গলের পাঁচটি শট ছিল গোলে। প্রতিপক্ষের বক্সে যেখানে ৭ বার বল ছোঁয় ব্লাস্টার্স, সেখানে ইস্টবেঙ্গল ১০ বার বলে পা লাগায়।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ইস্টবেঙ্গলের ডাগ আউট থেকে প্যানটিচের জায়গায় ভিক্টর ভাজকেজ ও সায়নের জায়গায় হরমনজ্যোৎ সিং খাবরা নামেন। তাদের পুরো দলের বিরুদ্ধে ব্লাস্টার্সের দশজনের লড়াইয়ের শুরুতে ইস্টবেঙ্গল আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ক্রেসপো, ক্লেটনরা গোলে শট নিলেও সফল হননি। তবে চেষ্টা ছাড়েনি হোম টিমও।
৫৩ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে তাদের জাপানি ফরোয়ার্ড দাইসুকে সাকাইয়ের শট দখলে নিয়ে নেন গোলকিপার গিল। তবে এর সাত মিনিট পরে রাহুল কেপির ক্রস থেকে সাকাইয়ের শট বারে লেগে ফিরে না এলে হয়তো পিছিয়ে পড়ত ইস্টবেঙ্গল।
আক্রমণে তরতাজা পা আনার জন্য বিষ্ণুর জায়গায় তরুণ ফরোয়ার্ড আমন সিকে-কে নামায় ইস্টবেঙ্গল। এই সময়ে দুই দলের মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। দশজনেও টানা লড়ে যায় ব্লাস্টার্স। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের নাগাড়ে চাপ বেশিক্ষণ রাখতে পারেনি হলুদ-বাহিনী। চাপের মুখে তারাই ভুল করে বসে এবং ফের গোল খেয়ে যায়।
৭১ মিনিটের মাথায় ব্লাস্টার্সের গোলকিপার বক্সের বাইরে ডিফেন্ডার মার্ক লেস্কোভিচের উদ্দেশ্যে বল দেন। কিন্তু পিছন থেকে এসে লেস্কোভিচের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন আমন এবং পিছন থেকে মাঝবরাবর বক্সে ঢোকা সল ক্রেসপোর উদ্দেশ্যে কাট ব্যাক করেন। বক্সের মাঝখান থেকে গোলে বল ঠেলতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি ক্রেসপো (১-২)।
কিন্তু দ্বিতীয় গোলের মিনিট তিনেক পর ইস্টবেঙ্গল আরও সুবিধা পেয়ে যায় প্রতিপক্ষের আর এক খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখায়। জিকসনের পর এ বার লাল কার্ড দেখেন নাওচা সিং, যিনি বল ছেড়ে আমনের মুখে বিপজ্জনক ভাবে ঢুঁসো মারেন। আঘাত পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আমন। নাওচাকে লাল কার্ড দেখানোর সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় নেননি রেফারি।
ন’জন নিয়েই অবশ্য তুমুল লড়াই চালিয়ে যায় ব্লাস্টার্স। সেরনিচের জায়গায় নামা ইশান পন্ডিতা একাধিকবার গোলের সুযোগ তৈরি করেন। সন্দীপ সিংয়ের ক্রস থেকে ভিবিন মোহননের গোলমুখী শট আটকান গিল। কিন্তু পাল্টা চাপ বাড়ায় ইস্টবেঙ্গল। ৮১ মিনিটের মাথায় রকিপের ক্রসে গোলে হেড করেন ভাজকেজ। কিন্তু তাঁর হেড পোস্টে লেগে ফিরে আসে।
এই সুযোগ হাতছাড়া হলেও তার পরবর্তী মিনিটেই বক্সের মধ্যে ক্লেটনের পাস থেকে যে সুযোগ পান মহেশ, তা হাতছাড়া করেননি। বক্সের বাঁ দিক থেকে যে কার্লারটি মারেন তিনি তা জালে জড়িয়ে যায় (১-৩)। দাইসুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হেড করে তা ক্লিয়ার করতে গিয়েও পারেননি।
ম্যাচের সময় বেশি না থাকলেও উত্তেজনা তখনও অনেক বাকি ছিল। ৮৪ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিয়ে ওঠা সন্দীপ সিং বক্সের মধ্যে ইশান পন্ডিতার উদ্দেশ্যে ক্রস বাড়ান। তা ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজের গোলেই বল ঠেলে দেন জর্ডনের ডিফেন্ডার হিজাজি মাহের (২-৩)। দলের বিপদ ডেকে আনেন তিনি। কিন্তু সেই বিপদ থেকে দলকে দূরে সরিয়ে আনেন ফের মহেশ, ৮৭ মিনিটের মাথায় তাঁর দ্বিতীয় গোল করে।
বাঁ দিকের কর্নার স্পটের সামনে থেকে বক্সের মধ্যে থাকা মহেশকে ক্রস বাড়ান, যা তিনি অনায়াসে রিসিভ করে দ্বিতীয় পোস্টের দিকে ভলি মারেন। ব্লাস্টার্সের গোলকিপার বাঁদিকে ডাইভ দিয়ে বলে হাত লাগানোর চেষ্টাও করেন। বল তাঁর হাতে লাগলেও বারের নীচ দিয়ে গোলের ওপরের জালে জড়িয়ে যায় (২-৪)। এর পরে রেফারি সাত মিনিট বাড়তি সময় দিলেও আর লড়াই করার ক্ষমতা ছিল না কেরলর দলের ফুটবলারদের মধ্যে।
(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে
আরও পড়ুন: ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে টানা দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক রোনাল্ডোর, বড় জয় আল নাসেরের