কলকাতা: মহমেডানের বিরুদ্ধে যে ভাবে ন’জনে খেলে এক পয়েন্ট অর্জন করে তাঁর দল, তার পরে ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই তাঁর মনে। কুড়ি দিন আগে সেই ম্যাচে নন্দকুমার শেকর ও নাওরেম মহেশ সিংকে লাল কার্ড দেখিয়ে বার করে দেওয়া হয়। তার পরে প্রায় ৭৫ মিনিট ন’জনে খেলে আক্রমণাত্মক মহমেডানকে একটিও গোল করতে দেয়নি ইস্টবেঙ্গল (East Bengal)।
সেই ম্যচের লড়াইয়ে খুশি স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোন (Oscar Bruzon) দিন দশেকের অনুশীলনে দলের সমস্যাগুলি ধরে ধরে সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। গত কয়েকদিনের অনুশীলনে দলের যে উন্নতি তিনি দেখেছেন, তা দেখে তাঁর আশা, নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে এক নতুন ইস্টবেঙ্গলকে দেখা যাবে, যারা সহজে প্রতিপক্ষকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বে না।
শুক্রবার ঘরের মাঠে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে নামছে ইস্টবেঙ্গল। ন’টি ম্যাচে ২১ গোল করা নর্থইস্টের আগ্রাসী আক্রমণ আটকে পাল্টা আক্রমণে উঠে তাদের বিরুদ্ধে গোল করা যে সোজা কাজ হবে না, তা জানেন অস্কার। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা ও কৌশল যদি ঠিকমতো কার্যকর করতে পারে তাঁর দলের ফুটবলাররা, তা হলে তা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে অস্কার বলেন, 'কাল আমরা আক্রমণে খুবই ধারালো একটা দলের বিরুদ্ধে খেলব। ওরা ন’টি ম্যাচে ২১ গোল করে এখন লিগ টেবলের তিন নম্বরে রয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় প্রতি ম্যাচেই যথাসম্ভব বেশি গোল করাটাই ওদের প্রধান লক্ষ্য। তবে ওরা গোল খেয়েছেও অনেক (১৫)। প্রথম চারটি দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল খেয়েছে নর্থইস্টই। ওদের গোল করার অনেক ক্ষমতা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু ওদের রক্ষণে ফাটল খুঁজে বের করাটা খুব একটা কঠিন কাজ নয়'।
অর্থাৎ, হুয়ান পেদ্রো বেনালির দলের দুর্বল রক্ষণকেই কাজে লাগাতে চান অস্কার। তা স্পষ্ট জানিয়েও দিলেন। বলেন, 'ওরা নিয়মিত গোল খেয়ে চলেছে। এটা ওদের দুর্বলতা বলতে পারেন। এই জায়গাটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আমাদের আক্রমণে আরও নিখুঁত হতে হবে। আমরা যদি এই ম্যাচে আক্রমণে বাড়তি পরিশ্রম করে ওদের দুর্বল রক্ষণে ফাটল ধরাতে পারি এবং তা কাজে লাগাতে পারি, তা হলে আমাদের লাভ হতে পারে'।
কিন্তু তাঁর নিজের দলের আক্রমণের যা বেহাল অবস্থা, ৬৫টি গোলের সুযোগ (এ পর্যন্ত সবচেয়ে কম) তৈরি করেও মাত্র চারটি গোল করতে পেরেছে, তাতে আশাবাদী হওয়াটা কঠিন। তবু আশায় রয়েছেন অস্কার। আক্রমণের দুর্বলতার কথা মেনে নিয়েও দলের রক্ষণের প্রশংসা করেন তিনি। বলেন, 'এটা ঠিকই যে সবচেয়ে কম গোল দেওয়া দলগুলির তালিকায় আমরা ওপরের দিকে আছি (৯ ম্যাচে ৪ গোল)। আমাদের আক্রমণে আরও ধার বাড়াতে হবে। তবে আমাদের রক্ষণ দুর্বল, এ কথা মানতে পারছি না। কারণ, আমাদের চেয়ে বেশি গোল খেয়েছে এমন অনেক (আটটি) দল রয়েছে এই লিগে'।
তিনি অবশ্য অন্য দলের পারফরম্যান্সের সঙ্গে নিজেদের পারফরম্যান্সের তুলনায় যেতে চান না। বরং প্রায় হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখলেন প্রতিপক্ষদের। বলেন, 'কারও সঙ্গে তুলনা করতে যাব না। কারণ, ক্রস, আক্রমণে লোক বাড়ানো, ভাল ফিনিশ করা, সেটপিসে সাফল্য, এগুলোতে আমরা অন্যান্য দলের চেয়ে পিছিয়েই আছি। এই জায়গাগুলোতে আমাদের আরও উন্নতি করতে হবে। এই ম্যাচের আগে যে দিন দশেক অনুশীলন করেছি আমরা, তাতে এইসব সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করেছি আমরা। আশা করি, কাল থেকে সবাই ইস্টবেঙ্গলের নতুন রূপ দেখবে'।
দুই উইংয়ে নন্দকুমার, মহেশের মতো নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়দের ছাড়াই কাল মাঠে নামতে হবে লাল-হলুদ বাহিনীকে। তার পরেও কী করে ধারালো আক্রমণের কথা বলছেন, জানতে চাইলে অস্কার বলেন, ওদের দু’জনকে পাব না ঠিকই। ফুটবলে এ রকম হতেই পারে। কিন্তু আমাদের হাতে বিষ্ণু আছে। ওর এই ম্যাচে খেলার সম্ভাবনা আছে। এর আগেও আমরা বিভিন্ন ম্যাচে নন্দ, মহেশের জায়গায় (পরিবর্ত হিসেবে) একাধিক খেলোয়াড়কে খেলিয়েছি। বিষ্ণু তাদের মধ্যে সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী, দক্ষ ও প্রত্যয়ী। তাই কাল প্রথম এগারোয় বিষ্ণুকে রাখব বলে ভেবে রেখেছি। আশা করি, কাল ম্যাচের পর বিষ্ণুর পারফরম্যান্স নিয়ে আপনারা আমাকে প্রশ্ন করবেন'।
কোচ যখন এই কথাগুলি বলছিলেন, তখন পাশেই বসে ছিলেন বিষ্ণু। তাঁকেও বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হল, যখন বললেন, 'কোচ আমাকে ও দলের সবাইকেই অনেক উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন, আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছেন। আশা করি, কাল সুযোগ পেলে নিজের সেরাটা দিতে পারব। সুযোগ পেলে গোলও করব। ইস্টবেঙ্গলের মতো ঐতিহ্যপূর্ণ ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়ে আমি খুবই খুশি। রিজার্ভ টিম থেকে সিনিয়র দলে দলে এসে সবার কাছ থেকেই খুব সাহায্য পাই। এ বার দলের জন্য কিছু করতে চাই'।
নর্থইস্টের প্রতিপক্ষদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় মরক্কান তারকা আলাদিন আজারেই, যিনি ইতিমধ্যেই ন’টি ম্যাচে ১১টি গোল করে ফেলেছেন। গত ম্যাচে পাঞ্জাব এফসি ছাড়া এর আগে প্রতি ম্যাচে গোল করেছেন তিনি। পাঞ্জাব-ম্যাচের আগে তিনটি ম্যাচের প্রতিটিতে দুটি করে গোল করেন তিনি। চারটি অ্যাসিস্টও দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ দলের ২১ গোলের মধ্যে ১৫টিতেই তাঁর অবদান রয়েছে। কোনও প্রতিপক্ষই তাঁকে আটকে রাখার রাস্তা খুঁজে পাননি।
কিন্তু তাঁকে অকেজো করার নীল নকশা রয়েছে অস্কারের কাছে। কী সেই ছক? 'আলাদিনকে অনেকে মিলে আটকাতে হবে। ও যে অঞ্চলে খেলে, সেই অঞ্চলে ওকে জায়গা দেওয়া যাবে না। ওকে নিয়ে আমাদের আলাদা কোনও পরিকল্পনা নেই। এ সবই সামগ্রিক পরিকল্পনার মধ্যেই পড়ে। কোনও ব্যক্তিগত মার্কিংয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী নই আমি। ওই জায়গায় যে-ই খেলুক, তাকে আটকানোর পরিকল্পনা একই থাকবে। সে যদি নাম্বার ৬-এর কাছ থেকে ঠিকমতো বল সরবরাহ না পায়, নম্বর ৯-এর সহায়তা যদি সে ঠিকমতো না পায়, তা হলে সে অকেজো হয়ে পড়বে'।
এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, 'কোনও একজন বা দু’জন খেলোয়াড়কে অকেজো করতে হলে তার চারপাশের খেলোয়াড়দের আটকে দিলে কাজ হয়। আমাদের এ ভাবেই ওদের আটকাতে হবে। যে দিক দিয়েই ওরা আক্রমণ করুক না কেন, ওদের আটকাতে হবে। ওদের আক্রমণে মূলত যে তিনজন থাকে (আজারেই, আলবিয়াখ ও জিথিন), তাদের অকেজো করে দিতে পারলেই বাজিমাত করা যাবে। কোনও একজনকে আটকালে হবে না'। কিন্তু তাদের আটকাবে কে? এই ব্যাপারে সমর্থকদের খুশির খবর দিয়ে কোচ বলেন, 'হেক্টর ইউস্তের চোট সেরে উঠেছে। কাল ও মাঠে নামার জন্য তৈরি আছে'।
কিন্তু তাঁর চিন্তা শুধু রক্ষণ নিয়ে নয়, আক্রমণ নিয়েও। তবে আশাবাদী অস্কার বলেন, 'ওড়িশার বিরুদ্ধে ও এএফসি কাপে আমরা ভাল ফুটবল খেলেছি। মহমেডানের বিরুদ্ধে আমাদের দুজন লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যাওয়ায় আমাদের পরিকল্পনা, কৌশল পুরোপুরি বদলাতে হয়। মরশুমের শুরুর চেয়ে এখন আমরা ভাল খেলছি। আমরা সুযোগ তৈরি করতে পারছি। প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকছি। প্রতিপক্ষ যদি ঘন ঘন কাউন্টার অ্যাটাক থেকে আমাদের বিরুদ্ধে গোল করে, তা হলে সেটা আমাদের বড় সমস্যা। প্রতিপক্ষের চেয়ে আমাদের বেশি সুযোগ তৈরি করতে হবে'।
এই বছরে (২০২৪) এখনও আমাদের ঘরের মাঠে অনেকগুলো ম্যাচ খেলতে হবে। ঘরের মাঠের সুবিধা কাজে লাগাতে পারি কি না আমরা, দেখা যাক। আমাদের দলে অনেক ভাল ভাল খেলোয়াড় আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের আজ যে জায়গায় থাকার কথা, আমরা সেই জায়গায় নেই।
অনেকে বলছেন, সম্প্রতি ভুটানে এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে বিদেশিদের সংখ্যায় কোনও বিধিনিষেধ ছিল না বলে সফল হতে পেরেছে ইস্টবেঙ্গল। আইএসএলে চারজনের বেশি বিদেশি খেলাতে না পারায় তারা ব্যর্থ হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে লাল-হলুদ কোচ বলেন, 'এএফসি কাপে আমরা পাঁচ বিদেশিকে নিয়েই বেশিরভাগ সময় খেলেছি, ছ’জনকে নিয়ে নয়। আমার মনে হয় না তার বদলে চারজন বিদেশিকে নিয়ে খেললে আমাদের খেলায় নাটকীয় কোনও পরিবর্তন আসবে। আমাদের ভারতীয় ফুটবলারদের নিয়ে আমি খুশি। এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে আমাদের প্রতিপক্ষরা অনেকেই আমাদের চেয়ে বেশি বিদেশি নিয়ে মাঠে নেমেছিল। তাতে আমাদের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। কারণ, ফুটবল দলগত খেলা'।
দলের ব্রাজিলীয় তারকা ক্লেটন সিলভাকে নিয়ে যে খুব একটা খুশি নন অস্কার, তা জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের তালাল, ক্লেটন ও দিমি একই ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু আইএসএলের যা নিয়ম, তাতে আমি তিনজনকে একসঙ্গে খেলাতে পারব না। একজন বিদেশি সেন্টার ব্যাক ও একজন বিদেশি মিডফিল্ডার রাখতে হবে মাঠে। তার পরে এই তিনজনের মধ্যে দুজনকে রাখা যাবে। আমার মনে হয় না এ জন্য দলের খেলায় খুব একটা পরিবর্তন হবে। সব দলকেই একই শর্ত মেনে খেলতে হয়। বিদেশিদের কী ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, তাদের কম্বিনেশন কতটা কার্যকরী হচ্ছে, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কতজন বিদেশি খেলছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়'।
তবে ক্লেটনকে ছন্দে ফেরানোর চেষ্টা চলছে বলে জানান কোচ। বলেন, 'ক্লেটনকে আমরা এখন ওর সেরা ছন্দে পাচ্ছি না। একসময় ক্লাবকে ও অনেক দিয়েছে। কিন্তু এ বার প্রাক মরশুম থেকেই ওর একটু সমস্যা হচ্ছে। ওকে আমরা ওর সেরা ফর্মে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি'।
(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)
আরও পড়ুন: পেনাল্টি মিস এমবাপের, ৮ ম্যাচ পরে মাদ্রিদকে হারাল লিভারপুল, জয় ডর্টমুন্ডের, গোলশূন্য ড্র জুভের e