কলকাতা: সপ্তাহ তিনেক আগেই তাঁর দল হারিয়েছে এক সময় চিরশত্রু হয়ে ওঠা মুম্বই সিটি এফসি-কে। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (ISL) টানা আটটি ম্যাচে জিততে না পারার পর আসে সেই জয়, যা তাদের এনে দেয় প্রথম লিগশিল্ড। তিন সপ্তাহ কেটে গিয়েছে ঠিকই। অনেকেরই মনে হচ্ছে শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে আইএসএল ২০২৩-২৪-এর ফাইনালে ১৫ এপ্রিলের সেই হারের বদলা নিতে নামবে মুম্বই সিটি এফসি।

কিন্তু মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস (Antonio Lopez Habas) মনে করেন, সেই ম্যাচ আর এই ম্যাচের মধ্যে জমিন-আসমান ফারাক আছে। তাই তাঁর ধারণা, সেই ম্যাচের ছায়া এই ম্যাচে পড়বে না। শুক্রবার কলকাতায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, “গত ম্যাচের সঙ্গে এই ম্যাচের কোনও তুলনা হয় না। ওটা ছিল লিগের ম্যাচ, এটা ফাইনাল। ওদের যেমন এই ম্যাচ জেতার সুযোগ আছে, তেমনই আমাদেরও এই ম্যাচে জেতার সুযোগ আছে। তবে গত ম্যাচের মতোই খেলোয়াড়দের চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যাবে এই ম্যাচেও। কাল ম্যাচের মধ্যে ছোটখাটো ব্যাপারগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। একটা হলুদ কার্ড বা কারও চোট, এ রকম ছোটখাটো ঘটনা খেলার রঙ বদলে দিতে পারে”।

বদলা নয়, সাফল্য চাই

বদলা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে মোহনবাগান ও হাবাসেরও। তিন বছর আগে ২০২০-২১ মরশুমে লিগের শেষ ম্যাচে মুম্বইয়ের কাছে যেমন হেরে লিগের শীর্ষস্থান খুইয়েছিল তারা, তেমনই ফাইনালে হেরে কাপ জয়ের স্বপ্নও ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল তাদের। সেই হারের বদলা নেওয়ার সুযোগ। কিন্তু এই ব্যাপারেও একমত নন হাবাস। বদলার মনোভাব নিয়ে যে নামবে না তাঁর দল, তা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন তিনি।

এই প্রসঙ্গে বাগান-কোচ বলেন, “বদলা নেওয়ার কোনও ব্যাপার নেই। সে তো মাফিয়ারা নেয়। আমাদের সামনে আর একটা ম্যাচ বাকি, আমাদের হাতে একটা ভাল দল আছে। বিপক্ষও বেশ শক্তিশালী। আশা করি একটা ভাল আকর্ষণীয় একটা ম্যাচ হবে। কলকাতায় এটাই প্রথম ফাইনাল। তাই অন্যরকম হবে। এর আগে গোয়া, মুম্বইয়ে ফাইনাল খেলেছি। কিন্তু কলকাতা সবার চেয়ে আলাদা”।

মুম্বই সিটি এফসি-র সঙ্গে তাঁদের একটা অম্ল-মধুর সম্পর্ক ও স্মৃতি নিয়ে স্প্যানিশ কোচের বক্তব্য, “আমাদের ভাল ও মন্দ দু’রকম স্মৃতিই আছে। তবে সে সব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এখন আমাদের সামনে একটা সাফল্যের সুযোগ, যা অর্জন করতে পারলে একটা বৃত্ত পূর্ণ হবে। সেটাই করতে চাই আমরা। সারা মরশুম ধরে যে লক্ষ্য নিয়ে পরিশ্রম করেছি আমরা এ সেই লক্ষ্য। এটা পূরণ করা দরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর ছেলেদের বলে দিয়েছিলাম, ট্রফি জিততে গেলে কী কী করতে হবে। ওরা ঠিক সেই মতোই কাজ করেছে। সে জন্যই সাফল্য পেয়েছে”।

ফেভারিট তকমায় নারাজ

ঘরের মাঠে, নিজেদের সমর্থকদের সামনে ফাইনাল। তা সত্ত্বেও নিজেদের ফেভারিট বলতে রাজি নন আইএসএলের সবচেয়ে সফল কোচ। তিনি বলেন, “ফাইনালে কোনও ফেভারিট হয় না, আমি হতেও চাই না। কারণ, যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও মুভই ম্যাচের ইতিহাস বদলে দিতে পারে। এ রকম একটা ম্যাচে ফেভারিট বেছে নেওয়া খুবই কঠিন। যদিও আমাদের প্রচুর সমর্থক গ্যালারিতে থাকবেন। কিন্তু তারা তো মাঠে নেমে খেলবে না”।

তবে সমর্থকদের প্রতি তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। বলেন, “দলের সবাইকে তো বটেই, সমর্থকদেরও অভিনন্দন। সমর্থকদের ছাড়া এই জায়গায় পৌঁছনো যেত না। সে জন্য আমি খুশি। আর একটাই পাওনা বাকি আছে আমাদের। সেটা পেতে হবে”।

প্রতিপক্ষ সম্পর্কে তিনি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল। ফাইনালের আগেও তার অন্যথা হচ্ছে না। বলেন, “গত বছর মুম্বই সিটি এফসি অনেক উন্নতি করেছে ঠিকই। কিন্তু অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বেঙ্গালুরু, ওডিশা, কেরালার মতো সব দলকেও আমরা সমীহ করেছি। আসলে ফুটবলে এক মুহূর্তে ফয়সালা হয়ে যেতে পারে। তাই শুধু গোছানো খেলা, ভাল খেলোয়াড় নিয়ে সফল হওয়া যায় না। খেলোয়াড়দের অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়াটাও খুবই জরুরি। ফাইনালে জিততে গেলে সাফল্যের আকাঙ্খা থাকা খুবই জরুরি”।

নব্বই মিনিটেই হোক ফয়সালা

সেমিফাইনালের মতো ফাইনালেও তিনি ৯০ মিনিটেই ফয়সালা চান বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটসদের হেড কোচ। বলেন, “ম্যাচকে অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যেতে চাই না। ৯০ মিনিটেই শেষ করে আসতে চাই। পারলে ৪৫ মিনিটেই শেষ করে দিতাম। কিন্তু সে তো আর হবে না। এত পরিশ্রম, অনুশীলন, এই তীব্র আবহাওয়ার মধ্যে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট খেলাটা খুবই কঠিন। তবে প্রয়োজন হলে তো অতিরিক্ত সময় বা পেনাল্টিতে যেতে হতেই পারে। সে জন্যও প্রস্তুত থাকব আমরা। তবে এই ম্যাচের আগে খেলোয়াড়দের কৌশল, টেকনিক নিয়ে বোঝানোর চেয়ে তাদের সঙ্গে মানসিকতা, মানসিক শক্তি নিয়ে কথা বলাই ভাল”।

মরশুমের মাঝখানে এসে সমস্যা থেকে বার করে এনে লিগশিল্ড জিতিয়ে এখন কাপ জয়ের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন দলকে। কী ভাবে এমন অসাধ্য সাধন করেছেন, জানতে চাওয়া হলে হাবাস বলেন, কঠোর পরিশ্রম তো আছেই, এ ছাড়াও দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে তার প্রাপ্য সন্মান দিয়েছি, প্রত্যেকের যে জায়গা প্রাপ্য, তাকে সেই জায়গা দিয়েছি, প্রত্যেককে সমান চোখে দেখেছি। এ ভাবেই একটা ভাল দল গড়ে ওঠে এবং তখন কোচের কাজ হয় শুধু দলটাকে গুছিয়ে রাখা ও খেলোয়াড়দের ভাল খেলে সাফল্য অর্জন করতে সাহায্য করা”।


এখন আর দল নয়, পরিবার

ফাইনালের আগে যে বেশ তেতে রয়েছেন অধিনায়ক শুভাশিস বোস, তা বোঝা গেল তাঁর কথাতেও। অন্যদিন সাংবাদিক বৈঠকে যা যা বলেন, তার চেয়ে তিনি যেন একটু বেশিই স্পষ্ট ও আক্রমণাত্মক। বলেন, “আমাদের সামনে কাপ আছে। আমরা তৈরি এবং দলের প্রত্যেকের এই ম্যাচ জেতার ইচ্ছা প্রবল। ঘরের মাঠে সমর্থকদের সামনে খেলব আমরা। শুধু এগারো জন খেলোয়াড় খেলব না। কয়েক লক্ষ্য সমর্থকদের সমর্থন ও ইচ্ছাশক্তিও থাকবে আমাদের সঙ্গে”।

দলের মধ্যে ঐক্য নিয়ে গর্বিত শুভাশিস বলেন, “আমাদের ড্রেসিং রুমে কেউ মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লে, অন্যরা তাকে উজ্জীবিত করে তুলি। মরশুমের শুরুতে আমরা একটা দল ছিলাম, এখন মরশুমের শেষে এসে আমরা একটা পরিবার হয়ে উঠেছি। সে জন্যই শিল্ড জিততে পেরেছি। কালও আমরা পরিবার হিসেবেই মাঠে নামব এবং নিজেদের উজাড় করে দেব”।

এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “আমাদের দলের বৈশিষ্ট আমরা একসঙ্গে খেলি। দল একসঙ্গে ডিফেন্ড করে ও একসঙ্গে আক্রমণও করে। গোল হলে সেলিব্রেট করতে আমিও ছুটে যাই। গোল খেলে দিমিরও মন খারাপ হয়। কালও দল হিসেবেই খেলব এবং আশা করি সফল হব”।

আইএসএলে মুম্বই সিটি এফসি-র সঙ্গে মোহনবাগানের একটা চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হওয়া প্রসঙ্গে শুভাশিস বলেন, “গত চার বছর ধরেই মোহনবাগান ও মুম্বইয়ের মধ্যে লড়াই জারি আছে। অতীতে যা হয়েছে তাকে আমরা বদলাতে পারব না। কিন্তু বর্তমান আমাদের হাতে। নিজেদের সেরাটা দিয়ে বর্তমানে সফল হওয়াই আমাদের লক্ষ্য। তিন বছর আগেও যেমন দুই দলই শক্তিশালী ছিল, এবারেও তেমনই দু’পক্ষই শক্তিশালী। দু’দলের খেলোয়াড়রাও খুব ভাল। তাই মনে হয় ফাইনালে ভাল লড়াই হবে এবং দুই দলই নিজেদের সেরাটা দেবে। আমরা কোচের পরিকল্পনা অনুযায়ীই খেলব। সেরকম ভাবেই অনুশীলন করছি আমরা”।

নতুন ইতিহাস লেখার স্বপ্ন

আইএসএলের দ্বিমুকুট এবং মরশুমের ত্রিমুকুট (ডুরান্ড কাপ-সহ) তাঁদের প্রাপ্য বলে মনে করেন সবুজ-মেরুন দলনেতা। নতুন ইতিহাস লিখতে চান তিনি। বলেন, “গত আট মাসে দলের প্রত্যেকে কত পরিশ্রম করেছে, তা নিজের চোখেই দেখেছি। প্রতিদিন মাঠে গিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে সবাই। তাই আমাদের কাছে এই ট্রফি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর যদি তিনটে ট্রফি জিততে পারি আমরা, তা হলে এই বছরটা আমাদের কাছে স্বপ্নের বছর হয়ে থেকে যাবে। মোহনবাগানের মতো বিশাল ও ঐতিহাসিক ক্লাবের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় লিখতে পারব আমরা”।

যুবভারতীর ষাট হাজার সমর্থকদের আরও বেশি চিৎকার করার অনুরোধ করে শুভাশিস বলেন, “আশা করি, আমাদের সমর্থকেরাও নিজেদের একশো শতাংশ দেবে কাল। আমি চাই, কাল সবাই মিলে যত পারে জোরে চিৎকার করুক, গলা ফাটাক। ওরা যত চিৎকার করবে, আমরা তত উজ্জীবিত হয়ে উঠব”।

গ্যালারিতে চাই আরও চিৎকার

সমর্থকদের এই প্রাণোচ্ছ্বল রূপ মুগ্ধ করেছে অস্ট্রেলীয় তারকা ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটসকেও। তিনি বলেন, “সমর্থকদের জন্যই আমরা শিল্ড জেতার পরও কাপ জয়ের প্রেরণা পাচ্ছি। এরাই আমার দেখা সেরা সমর্থক। ওদের চিৎকারে মাঝে মাঝে মাঠে নিজেদের মধ্যে কথাও শুনতে পাই না আমরা। তাতে কোনও অসুবিধা নেই। ওরা আরও জোরে চিৎকার করুক”।

অস্ট্রেলিয়া থেকে কলকাতায় এসে যে ফুটবলকে আরও বেশি করে উপভোগ করছেন, তা জানিয়ে পেট্রাটস বলেন, “কলকাতায় এসে ফুটবল খুব উপভোগ করছি। এখন এই শহরটা আমার নিজের শহরের মতোই হয়ে গিয়েছে। কোচ আমার প্রতি যথেষ্ট আস্থা রেখেছেন। আমাকে মাঠে অনেক স্বাধীনতা দেন উনি। অবশ্যই মাঠে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনাকেও কাজে লাগাই। এ ভাবেই যতটুকু পারি করি”।

গতবারের ফাইনালে জোড়া গোলের নায়ক এ বারের ফাইনাল নিয়ে বলেন, “সতীর্থদের মতো নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব কাল। আমাদের দলের অনেকেই সারা মরশুম ধরে দলের প্রতি অবদান রেখেছে। এটা একটা ইতিবাচক ব্যাপার”। জনি কাউকো চলে আসার পর যে তিনি মাঠে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারছেন, তা স্বীকার করে পেট্রাটস বলেন, “কাউকো দারুন ফুটবলার। এই লিগে ও আগেও খেলেছে। ওর সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা বেশ ভাল। ওরসঙ্গে বোঝাপড়া করেই খেলি। তাতেই আরও আক্রমণাত্মক হতে পারছি। আশা করি কালও ওর সাহায্য পাব”। (তথ্যসূত্র : ISL Media)


আরও পড়ুন: কেন টি-২০ বিশ্বকাপের দলে নেই রিঙ্কু? কারণ ব্যাখ্যা করে দিলেন সৌরভ


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।