কলকাতা: ফের শিল্ড জয়ের রাস্তায় প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে (Mohun Bagan Super Giant) আটকানো এখন যে কোনও দলের কাছেই কঠিনতম কাজ হয়ে উঠেছে। অনেকে প্রথমে গোল করে তাদের পিছিয়ে দিয়েও সফল হয়নি। দুর্দান্ত ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে হাসি মুখে মাঠ ছেড়েছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। সে রকমই এক দলের বিরুদ্ধে বুধবার মাঠে নামতে চলেছে গতবারের শিল্ডজয়ীরা। পাঞ্জাব এফসি, যারা প্রথম লিগের ম্যাচে এর গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে গেলেও শেষ পর্যন্ত তিন গোল খেয়ে হার মানতে বাধ্য হয়।
গত ছ’টি ম্যাচের মধ্যে পাঁচটিতেই কোনও গোল না খাওয়া এবং এর মধ্যে চারটিতেই জেতা মোহনবাগানের এ মরশুমে শিল্ড জেতার জন্য প্রয়োজন আর মাত্র দশ পয়েন্ট। বুধবারের ম্যাচ-সহ আর পাঁচটি ম্যাচ বাকি তাদের। এই পাঁচ ম্যাচে দশ পয়েন্ট পেলেই ফের লিগ শিল্ডের দখল নিতে পারবে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। তাই আপাতত তাদের পাখির চোখ সেই দিকেই।
শিল্ড অভিযানের শুরুতেই সমস্যা!
লিগ পর্বের শেষ পাঁচ ম্যাচে শুভাশিস বোসদের সামনে ‘মিশন লিগ শিল্ড’। তার পরে না হয় কাপ জয়ের জন্য ঝাঁপাবে তারা। কিন্তু এই মিশনের শুরুতেই সমস্যায় পড়েছে তারা। কার্ড সমস্যার জন্য খেলতে পারবেন না মাঝমাঠের নির্ভরযোগ্য তারকা আপুইয়া ও স্প্যানিশ সেন্টার ব্যাক টম অলড্রেড। চোটে কাবু অনিরুদ্ধ থাপা। তিন স্তম্ভ না থাকায় যে দল পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে একটু হলেও নড়বড় করবে, সে রকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। সমর্থকেরাও সেই দুশ্চিন্তাতেই রয়েছেন।
তবে এ মরশুমে মোহনবাগান যতবার এমন সমস্যায় পড়েছে বাগান-বাহিনী, প্রতিবারই তাদের রিজার্ভ বেঞ্চ তাদের ভরসা জুগিয়েছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে দুর্বল মনে হলেও সাফল্য তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। এ বার সেই একই ঘটনা ঘটবে এমনই আশা মোহনবাগান কোচ হোসে মোলিনার। তাঁর মতে, প্রথম দলের দু’জন খেলোয়াড় খেলতে পারবেন না বলে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। যারা বেঞ্চে বসে থাকে, তারাও প্রথম দলে খেলার যোগ্য। তাই পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে যদি গোলের সামনে অলড্রেজের জায়গায় দীপেন্দু বিশ্বাস দাঁড়ান বা মাঝমাঠে থাপা, আপুইয়ার জায়গায় সহাল আব্দুল সামাদ, দীপক টাঙরি বা অভিষেক সূর্যবংশী খেললেও খারাপ কিছু হবে বলে মনে হয়না হেড কোচের।
কিন্তু আলবার্তো রড্রিগেজও তো গত ম্যাচে খেলতে পারেননি। তিনি কি এই ম্যাচে খেলতে পারবেন? এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়ে মোলিনা জানিয়েছেন, আলবার্তো যখন দলের সঙ্গে পুরোপুরি অনুশীলন করছেন, তখন আশা করাই যায় তিনি খেলবেন। তবে তিনি না খেলতে পারলেও বাগানের পরিকল্পনা তৈরি। সেটাও মন্দ হবে না। আগেও যখন দুই স্প্যানিশ ডিফেন্ডার একসঙ্গে খেলতে পারেননি, তখনও এঁরাই শত্রুকে আটকানোর দুর্দান্ত কাজ করেছিলেন। আশিস রাই, দীপেন্দু, শুভাশিস ও আশিক কুরুনিয়ানের ডিফেন্স লাইন-আপ যে মন্দ নয়, তার প্রমাণ তাঁরা আগেও দিয়েছেন।
৮৩ শতাংশ গোলের সুযোগ নষ্ট!
মাঝমাঠ আর আক্রমণ নিয়ে তেমন চিন্তায় নেই মোহনবাগান শিবির। দুই বিভাগেই সেরা খেলোয়াড়রা প্রতি ম্যাচে রীতিমতো দাপুটে পারফরম্যান্স দেখাচ্ছেন। যদিও গোলের সুযোগ নষ্ট হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু কোচ মনে করেন, গোলের সুযোগ বেশি তৈরি হওয়াটা বেশি জরুরি। তা হলে গোলও আসবে। কিন্তু গোলের সুযোগই যদি না আসে, তা হলে তো গোলের সম্ভাবনাও কমে যাবে। এ পর্যন্ত ২১৪টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। গোল পেয়েছে ৩৬টি। অর্থাৎ ৮৩ শতাংশ গোলের সুযোগ তারা কাজে লাগাতেই পারেনি। এই পরিসংখ্যানে উন্নতি না করলে লিগ পর্বের শেষ পর্যায়ে সমস্যায় পড়তে পারে তারা।
আসলে তাদের স্ট্রাইকাররা নিয়মিত গোল করতে পারছেন না। জেমি ম্যাকলারেন বলুন বা জেসন কামিংস, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস—কেউই গোলের মধ্যে নেই। লিগের সর্বোচ্চ স্কোরারদের তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে মোহনবাগানের কোনও খেলোয়াড়ের নাম নেই। ১৪ নম্বরে ম্যাকলারেনের নাম আছে, যিনি ছ’গোল করেছেন বটে, কিন্তু গত চার ম্যাচে তাঁর কোনও গোল নেই। গত পাঁচটি ম্যাচে জেসন কামিংসও গোলহীন। কোচ অবশ্য আশাবাদী, তাঁরা গোলে ফিরবেন।
আর গত দু’মরশুমে ২২ গোল করা পেট্রাটস তো এ মরশুমে শেষ গোল করেছিলেন ২০ ডিসেম্বর, তাও পেনাল্টি থেকে। চলতি লিগে ওপেন প্লে থেকে একটিও গোল করতে পারেননি তিনি। দু’টি গোলই করেছেন স্পট কিকে। অথচ ৩২টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন তিনি। ২৩টি শট নিয়েছেন, যার মধ্যে ১২টিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তাঁর পারফরম্যান্সের রেখচিত্রে এই অবনমন আশা করতে পারেননি সমর্থকেরা।
বরং আশাতীত সাফল্য পেয়েছেন শুভাশিস, আলবার্তো, অলড্রেডরা। শুভাশিস ছ’গোল করে এখন দলের সর্বোচ্চ স্কোরারের জায়গায় ম্যাকলারেনের পাশেই। দলের ডিফেন্ডাররাই ৩৬টির মধ্যে ১৩টি গোল করেছেন। মনবীর সিং (৫), লিস্টন কোলাসো (৩) গোল পেলেও ধারাবাহিক নন। সুযোগ নষ্ট তারাও কম করেননি। তাতেই অবশ্য মোহনবাগানের বিজয়রথ ছুটছে ঝড়ের গতিতে। এই গতিরোধ করা পাঞ্জাবের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে অবশ্যই সন্দেহ আছে।
সদ্য জয়ে ফিরেই কঠিন পরীক্ষার মুখে
টানা সাতটি ম্যাচে জয়হীন থাকার পর সদ্য বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধে জয়ে ফিরেছেন লুকা মাজেনরা। প্রথম পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে চারটিতেই জয় দিয়ে তারা এ বার লিগ শুরু করেছিল। মুম্বই সিটি এফসি-কেও হারায় তারা। কিন্তু সাফল্যের ধারাবাহিকতা নেই তাদের। মহমেডান এসসি-কে ২-০-য় হারানোর পর থেকে টানা সাতটি ম্যাচে জয় না পাওয়ায় পয়েন্ট টেবলের ওপর থেকে ক্রমশ নীচের দিকে নেমে যায় তারা। টানা সাতটি জয়হীন ম্যাচের মধ্যে ইস্টবেঙ্গলের সেই স্মরণীয় ম্যাচও ছিল, যেখানে প্রথমার্ধে দু’গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষে হারতে হয় তাদের।
সে দিন চার নির্ভরযোগ্য সদস্যকে ছাড়াই মাঠে নামা ইস্টবেঙ্গলের ফর্মে থাকা পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে এমন নাটকীয় জয় ছিল চলতি লিগের অন্যতম সেরা অঘটন। ২১ ও ৩৯ মিনিটের মাথায় যথাক্রমে হাঙ্গেরিয়ান ফরোয়ার্ড আসমির সুলজিক ও আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার নর্বের্তো ভিদালের গোলে এগিয়ে যায় পাঞ্জাব। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে ইস্টবেঙ্গলের মেজাজ পুরো বদলে যায় এবং মাত্র ২২ মিনিটের মধ্যে চার-চারটি গোল করে অপ্রত্যাশিত জয় তুলে নেয় তারা।
মোহনবাগানের বিরুদ্ধে প্রথম লিগের ম্যাচেও পাঞ্জাব প্রায় একই ভাবে হেরেছিল। সে দিন বিরতিতে এক গোলে পিছিয়ে থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে তিন-তিনটি গোল করে ম্যাচ জিতে নেয় গতবারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়নরা। ১২ মিনিটের মাথায় রিকি সাবংয়ের গোলে এগিয়ে যায় পাঞ্জাব এফসি। দ্বিতীয়ার্ধে সম্পুর্ণ অন্য মেজাজে দেখা যায় মোহনবাগানকে। স্প্যানিশ ডিফেন্ডার রড্রিগেজ জোড়া গোল করেন। পাঞ্জাবের আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার পুলগা ভিদাল লাল কার্ড দেখেন সেই ম্যাচে। পেনাল্টি থেকে গোল করেন জেমি ম্যাকলারেন।
দলের ২৬টি গোলের মধ্যে দশটিতেই তাদের স্লোভেনিয়ান ফরোয়ার্ড লুকা মাজেনের অবদান রয়েছে। নিজে সাতটি গোল করেছেন ও তিনটি করিয়েছেন। নর্বের্তো ভিদালও পাঁচটি গোল করেছেন। সুলজিক ও মরজলাক চারটি করে গোল করেছেন। গোলের জন্য মূলত এঁদের দিকেই তাকিয়ে পুরো দল। পয়েন্ট টেবলে নয় নম্বরে থাকলেও সেরা ছয়ে যাওয়ার পুরো সুযোগ তাদের সামনে আছে। ছ’নম্বরে থাকা মুম্বই সিটি এফসি-র থেকে মাত্র পাঁচ পয়েন্ট দূরে তারা। সেই দিকে এগোতে চাইলে তাদের শেষ ছয় ম্যাচের কোনওটিতেই খালি হাতে ফিরলে চলবে না। বুধবার মোহনবাগানের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই সেই লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামবেন মাজেনরা।
চলতি আইএসএলে শেষ আটটি হোম ম্যাচেই জিতেছে মোহনবাগান। তার মধ্যে ছ’টিতেই তারা নিজেদের গোল অক্ষত রাখে। বুধবারও জিতলে আইএসএলে ঘরের মাঠে টানা সবচেয়ে বেশি জয়ের নজির ছোঁবে তারা, যা রয়েছে এফসি গোয়ার দখলে।
(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)
আরও পড়ুন: 'লোকজনের মেসি, পেলেকে পছন্দ হতেই পারে, তবে...', তিনি সবথেকে 'কমপ্লিট' ফুটবলার, দাবি রোনাল্ডোর