গোয়া: ডিসেম্বরের শেষ মানেই সৈকতনগরী গোয়ায় উৎসবের আমেজ। বড়দিন ও নববর্ষের উৎসবে মেতে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে গোয়ার মানুষ। দেশ ও বিদেশ থেকে এসে ভিড় করছেন হাজার হাজার পর্যটক। এই সময় রীতিমতো জমজমাট গোয়ায় আবার ফুটবল-উৎসবও চলছে সমান তালে। সব মিলিয়ে অসাধারণ এক পরিবেশ পশ্চিম উপকুলের এই সৈকতনগরীতে।


তিন বছর আগে এমনই এক দিনে এই শহরেই প্রাক্তন ক্লাব এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে (Mohun Bagan vs FC Goa) দুর্দান্ত এক গোল করে মোহনবাগানকে জিতিয়েছিলেন লিস্টন কোলাসো (Liston Colaco)। দিনটা ছিল ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১। ম্যাচের ২৩ মিনিটের মাথায় গোলটি পান কোলাসো। প্রতি ম্যাচের মতোই বাঁ দিক দিয়ে আক্রমণে উঠছিলেন তিনি। দীপক টাঙরির পাসে বাঁ দিকের উইংয়ে বল পেয়ে কোণাকুনি কিছুটা এগিয়ে বিপক্ষের বক্সের সামনে থেকে ‘বানানা কিক’ নেন। যা সোজা গোলে ঢুকে যায়।


তিন বছর আগের সেই ম্যাচের আগের দিন বলেছিলেন, বাবা-মায়ের ইচ্ছাপূরণের জন্য প্রাক্তন ক্লাবের বিরুদ্ধে গোল করতে চান এবং সে দিন সেই তাঁদের ইচ্ছাপূরণ করেছিলেন সেই স্বপ্নের গোলে। বাবা-মায়ের ইচ্ছাপূরণ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু মন ভরেনি কোলাসোর। কারণ, সেই দুর্দান্ত গোল দেখার লোক ছিল না গ্যালারিতে। কোভিডের কারণে তখন জৈব বলয়ের মধ্যে হয়েছিল আইএসএলের সেই ম্যাচ। তাই দুর্দান্ত গোল করলেও তা চাক্ষুষ করার কেউ ছিল না গ্যালারিতে। এ বার ফতোরদা স্টেডিয়ামের ভরা গ্যালারির সামনে গোল করার সুযোগ এসেছে তাঁর সামনে। এ সুযোগ ছাড়তে চান না তিনি।


একটা সময় এফসি গোয়াকে নিজের ঘর বলেই মনে করতেন তিনি। কিন্তু ফুটবলজীবনে সেখান থেকে তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেননি কোলাসো। ২০১৭-র অক্টোবর থেকে ২০২০-র ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলেন সেই ক্লাবে। এই তিন বছরে মাত্র ১৫০ মিনিট মাঠে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সেই কোলাসো যখন তাঁর মুকুটে একঝাঁক পালক নিয়ে এফসি গোয়ার মাঠে ফিরে আসেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। শুক্রবার সন্ধ্যায় যখন এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ফের ফতোরদা স্টেডিয়ামে নামবেন কোলাসো, তাঁর চোয়াল নিশ্চয়ই শক্তই থাকবে।


এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত একটিই গোল করেছেন ‘লোকাল বয়’ কোলাসো। তিন বছর আগের যে গোলটির কথা উল্লেখ করা হল। এ বার গোল করে নিজের শহরের ফুটবলপ্রেমীদের নিজের জাত চেনাতে চান তিনি। জামশেদপুর এফসি ও নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে সম্প্রতি দু’টি গোল করেছেন তিনি। দু’টিই ম্যাচের শেষ দিকে। শুক্রবারও সে রকমই কোনও গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করতে পারবেন ২৬ বছর বয়সী এই তারকা উইঙ্গার?


জন্মভূমিতে ফিরে চনমনে কোলাসো বলেন, 'গোয়ায় ফিরে আসতে পারলে খুবই ভাল লাগে। কালকের ম্যাচের জন্য আমি খুবই উত্তেজিত। এ মরশুমের শুরুটা ভালই করেছি। গতবারের তুলনায় এ বার ভাল খেলছি বলেই মনে হচ্ছে। সে জন্য আমি খুশি। এটা ধরে রাখতে হবে। ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আমাকে ফোকাসড থাকতে হবে'।


গোয়া থেকে কলকাতায় গিয়ে এখন তিনি সেখানকার সমর্থকদের নয়নের মণি। তবু দুই জায়গার অনুভূতি যে আলাদা, তা জানিয়ে কোলাসো বলেন, 'গোয়া আমার নিজের জায়গা। এখানে সময় কাটাতে ভাল লাগে। তবে মোহনবাগানেও এখন এরকমই অনুভূতি হয়। সমর্থকদের কাছ থেকে যে ভালবাসা পাই, তা অসাধারণ। ওখানে জীবন উপভোগ করছি আমি। গোয়ায় যখন খেলতাম, তখন চারপাশে অনেক আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা থাকত। তাই ভাল লাগত। কলকাতায় আমি কাউকেই চিনি না। তবু প্রতি ম্যাচে ও অনুশীলনে অনেকে আমাদের দেখতে আসে, রাস্তা ঘাটে দেখলে এগিয়ে এসে কথা বলে, সেলফি তুলতে চায়। গোয়ায় আমি ‘ঘরের ছেলে’। কলকাতাতেও এখন প্রায় তা-ই হয়ে গিয়েছি। তবে দুই জায়গায় দু’রকম অনুভূতি হয়'।


কলকাতার অচেনা পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মোহনবাগানে যখন প্রথম যোগ দিই, তখন জৈব বলয়ে খেলা হত। তাই গোয়াতেই ছিলাম। জৈব বলয়ের সময় কাটানোর পর যখন প্রথম কলকাতায় যাই, তখন ওখানকার পরিবেশ, সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হয়েছিল। কারণ, তার আগে আমি গোয়ার বাইরের কোনও ক্লাবে খেলিনি। তাই তখন সময়টা কঠিন ছিল। কিন্তু জীবনে চ্যালেঞ্জ তো নিতেই হয়। কিন্তু এখন আমি দিব্যি আছি। মোহনবাগানের সঙ্গে আমার চুক্তি ২০২৭ পর্যন্ত রয়েছে। তাই আপাতত ওখানেই থাকতে চাই। ওখানে আমি খুব ভাল আছি'।


মোহনবাগানে যোগ দেওয়ার পর আইএসএলের ২১-২২ মরশুমে আটটি গোল করেছিলেন কোলাসো। তিনটি অ্যাসিস্টও করেন। সে বার সব মিলিয়ে ১২টি গোল ও সাতটি অ্যাসিস্ট করেছিলেন। গত মরশুমে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে সাতটি গোল ও পাঁচটি অ্যাসিস্ট করেন তিনি। তার মধ্যে আইএসএলে ছিল চারটি গোল ও চারটি অ্যাসিস্ট। এ বার যে আরও ভাল খেলছেন, তা অনুভব করতে পারছেন তিনি। আরও ভাল কিছু করতে চান। সে জন্য অনেক পরিশ্রমও করেছেন বলে জানালেন কোলাসো। বলেন, 'এ বার আমি অফ সিজনে বসে থাকিনি। শুধুই অনুশীলন করেছি। গত মরশুমে আমার পারফরম্যান্সে যে যে ঘাটতি ছিল, সেগুলো মেটানোর চেষ্টা করেছি। তারই ফল পাচ্ছি এখন'।


এ জন্য মোহনবাগান কোচ হোসে মোলিনা তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন, তা স্বীকার করে কোলাসো বলেন, 'কোচ শুধু যে আমাকে সাহায্য করেছেন, তা নয়। দলের সবাইকেই আত্মবিশ্বাস জোগান। উনি জানেন আমাদের প্রত্যেকেই ভাল ফুটবলার, প্রত্যেকেই প্রতিভাবান। তাই উনি দলের ভারতীয় খেলোয়াড়দের খুবই উজ্জীবিত করেন ও আমাদের মধ্যে থেকে সেরাটা বের করে আনার চেষ্টা করেন'।


দলের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার ফলেও নিজেকে উন্নত করে তুলতে যে সুবিধা হয়েছে তাঁর, তা জানিয়ে কোলাসো বলেন, 'আমরা জানতে পারি না পরের ম্যাচে খেলব কি না। প্রত্যেক অনুশীলনে আমাদের ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়ে জায়গা ধরে রাখতে হয়। দলের মধ্যে দারুন একটা প্রতিযোগিতা রয়েছে। এটা দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের পক্ষে খুবই ভাল। এর ফলে আমরা প্রতি দিন আরও উন্নতি করি'।


আর কোচ মোলিনা তাঁর দলের নির্ভরযোগ্য ফুটবলার সম্পর্কে বলেন, 'মরশুমের শুরু থেকেই লিস্টনকে সাহায্য করেছি, যাতে ও নিজেকে মেলে ধরতে পারে। শারীরিক ভাবে তো বটেই, আমার স্টাইলের সঙ্গে যাতে ও মানিয়ে নিতে পারে, সেই চেষ্টাও করেছি। ওর গত মরশুমের পারফরম্যান্স নিয়ে কিছু বলতে পারব না। কারণ, আমি তখন ছিলাম না। তবে শুধু লিস্টন নয়, উইঙ্গাররা প্রত্যেকেই আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লিস্টন খুবই আগ্রাসী ও গতিময় উইঙ্গার। দ্রুত বক্সে ঢুকে গোল করতে পারে'।


শুক্রবার নিজের শহরে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ। সঙ্গে ভারতীয় দলের কোচ মোনালো মার্কেজের সামনে ভাল পারফৎম্যান্স দেখানোর চ্যালেঞ্জ। কেমন লাগছে, সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'নিজের শহরের মানুষের সামনে খেলা সব সময়ই আমার কাছে স্পেশ্যাল। মানোলো মার্কেজের প্রশিক্ষণে আমি খেলেছি। আমি ওঁকে চিনি। আমার ধারণা, ওঁকে আলাদা করে বোঝাতে হবে না আমার পারফরম্যান্স কেমন। উনি খুব ভাল করেই তা জানেন। আমি বেশি উত্তেজিত আমার নিজের শহরের লোকেদের সামনে খেলতে পারব বলে'।


(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)


আরও পড়ুন: ম্যাকস্যুইনি বাদ, ৭০ বছরে কনিষ্ঠতম ব্যাটারকে টেস্ট অভিষেক ঘটানোর সুযোগ দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া!