গুয়াহাটি: প্রতি মরশুমে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (ISL 2024-25) এমন কিছু দ্বৈরথ দেখা যায়, যার আগে নড়েচড়ে বসেন ফুটবলপ্রেমীরা। দুই দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে এই দ্বৈরথগুলিতে উত্তেজনার পারদ রীতিমতো চরমে ওঠে। তেমনই এক তুমুল প্রতিদ্বন্দিতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ও নর্থইস্ট ইউনাইটেডের (Mohun Bagan vs NorthEast) মধ্যে, রবিবার সন্ধ্যায় যা ফুটবলপ্রেমীদের ফের মাতিয়ে দিতে পারে।
চলতি মরশুমে আইএসএলে দুই প্রতিবেশী রাজ্যের দলের মধ্যে এটি দ্বিতীয় লড়াই। প্রথমবার কী হয়েছিল, তা ভুলে যাওয়ার কথা নয় দুই দলের সমর্থকদের। তবু যাঁরা ভুলে গিয়েছেন, তাঁদের মনে করানো যেতেই পারে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে দুই দলই সেই ম্যাচে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। তার কয়েক সপ্তাহ আগেই ডুরান্ড কাপ ফাইনালেও তুমুল লড়াই হয়েছিল। চলতি লিগের প্রথম মুখোমুখিতে তার চেয়েও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় দুই পক্ষকে।
প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই দুই দলই গোল পায়। চার মিনিটের মাথায় মরক্কান মিডফিল্ডার মহম্মদ আলি বেমামের ও তার পাঁচ মিনিট পরেই বাংলার তরুণ ডিফেন্ডার দীপ্পেন্দু বিশ্বাস দুর্দান্ত গোল করে ১-১ করে ফেলেন। ২৪ মিনিটের মাথায় আর এক মরক্কান আলাদিন আজারেই দলকে ফের ২-১-এ এগিয়ে দেন। বিরতির পর ৬১ মিনিটের মাথায় মোহনবাগানের অধিনায়ক শুভাশিস বসু ফের সমতা আনেন এবং শেষে জেসন কামিংসের গোলে তাদের সেই মরিয়া লড়াই সফল হয়। প্রতিপক্ষের হাত থেকে ম্যাচ বের করে এনে সে দিন মরশুমের প্রথম জয় অর্জন করে তারা।
এ তো গেল একটা ম্যাচ। বাকি দশবারের লড়াইয়ে নর্থইস্ট জিতেছে মাত্র দু’বার। আইএসএলে এই দুই দলের খেলায় সব মিলিয়ে ৩৮টি গোল হয়েছে, যার মধ্যে মোহনবাগান দিয়েছে ২৪টি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, দুই দল যখন আইএসএলের আসরে মুখোমুখি হয়, তখন তা প্রায় যুদ্ধের পর্যায়ে চলে যায়।
প্রথম ম্যাচে কলকাতায় গিয়ে প্রায় জেতা ম্যাচ হাতছাড়া হয় তাদের। রবিবার ঘরের মাঠে সেই হারের বদলা নিশ্চয়ই নিতে চাইবে নর্থইস্ট। কিন্তু কাজটা মোটেই সোজা হবে না। গত তিন মাসে দুই দলেরই পারফরম্যান্সে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে নর্থইস্টকে যতটা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে, মোহনবাগানের বিজয়রথ এগিয়েছে ধারাবাহিক গতিতেই। নর্থইস্টের পরের ম্যাচে শুধু হারে তারা। তার পর টানা পাঁচটি ম্যাচে কেউ হারাতে পারেনি তাদের।
মোহনবাগানের কাছে হারার পর তিনটি ম্যাচের একটিতেও জিততে পারেনি নর্থইস্ট। অবশেষে ঘরের মাঠে জামশেদপুর এফসি-কে ৫-০-য় হারিয়ে জয়ে ফেরে তারা। সেই জয়ের পর দু’টি জয় ও একটি ড্র করে। কিন্তু গত ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের কাছে এক গোলে হেরে ফের ধাক্কা খায় পেদ্রো বেনালির দল। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের দিক থেকে তাই মোহনবাগানকে এগিয়ে রাখা যায়। কিন্তু ফুটবলে, বিশেষ করে আইএসএলে সেই ঝুঁকি নিতে বোধহয় কেউই চাইবে না।
টানা চার ম্যাচে অপরাজিত থাকার পর গত শুক্রবার ইস্টবেঙ্গল এফসি-র কাছে যেদিন হারে নর্থইস্ট, সে দিন আলাদিন আজারেই-কে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল লাল-হলুদ রক্ষণ। সে দিন নর্থইস্টকে সারা ম্যাচে একটির বেশি গোলে শট নিতে দেয়নি মশাল-বাহিনী। সদ্য সাসপেনশন থেকে ফেরা তাদের মরক্কান মিডফিল্ডার মহম্মদ আলি বিমামের দ্বিতীয়ার্ধে তিন মিনিটের ব্যবধানে দু’বার হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। ফলে তারা আরও দুর্বল হয়ে যায়, আর গোল শোধ করতে পারেনি।
ইস্টবেঙ্গলের মতো মোহনবাগানও যদি আলাদিনকে কড়া পাহাড়ায় রাখতে পারে, তা হলে অর্ধেক কাজ সেখানেই সেরে ফেলতে পারে তারা। কিন্তু দলের দুই নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার আলবার্তো রড্রিগেজ ও শুভাশিস বোস যেখানে কার্ড সমস্যার জন্য এই ম্যাচে খেলতে পারছেন না, তখন নর্থইস্টের আক্রমণ সামলানো তাদের পক্ষে কঠিন হতে পারে।
সব মিলিয়ে ২১ গোল করেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের দলটি, যা এ মরশুমে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। জামশেদপুর এফসি-কে ৫-০-য় হারায় তারা। তার আগে ফর্মে থাকা পাঞ্জাব এফসি-কেও হারায়, যে পাঞ্জাব এফসি মুম্বই সিটি এফসি-কে ৩-০-য় হারায়। দলের ২১ গোলের মধ্যে আলাদিন আজারেই একাই ১১টি গোল দিয়েছেন। বাকিদের মধ্যে আলবিয়াখ চারটি, গিলেরমো ফার্নান্ডেজ ও পার্থিব গগৈ দু’টি করে গোল করেছেন। শুভাশিস, রড্রিগেজদের জায়গায় দীপেন্দু বিশ্বাস, আশিক কুরুনিয়ানদের নামাতে পারেন মোলিনা। কিন্তু তাঁরা আলাদিন, জিথিন এমএস, পার্থিব, আলবিয়াখ, গিলেরমোদের তাঁদের ঘরের মাঠে আটকাতে পারবেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
সবুজ-মেরুন বাহিনীরও আক্রমণ বিভাগ কম ধারালো নয়। তাদের গোল করার লোকের অভাব নেই। এই ম্যাচে রক্ষণে এক বিদেশী না খেলতে পারায় ইচ্ছে করলে তিন অস্ট্রেলীয় অ্যাটাকার জেমি ম্যাকলারেন, দিমিত্রিয়স পেত্রাতোস ও জেসন কামিংস এবং দুর্দান্ত স্কটিশ মিডিও গ্রেগ স্টুয়ার্টকে একসঙ্গে নামিয়ে আক্রমণে ঝড় তুলে দিতে পারে মোহনবাগান। সঙ্গে লিস্টন কোলাসো ও মনবীর সিং তো রয়েছেনই। সেক্ষেত্রে তাদের রক্ষণের ওপর বেশি চাপ নাও পড়তে পারে। সে জন্য অবশ্য মাঝমাঠে আপুইয়া, সহাল আব্দুল সামাদ, অনিরুদ্ধ থাপাদের সঙ্ঘবদ্ধ থাকতে হবে।
ডিফেন্সের সমস্যা মিটিয়ে জয়ের ধারা বজায় রাখতে হোসে মোলিনা এই পন্থা অবলম্বন করবেন কি না, তা রবিবার সন্ধ্যার আগে জানার উপায় নেই। কিন্তু ছুটির সন্ধ্যায় ‘পূর্বের ডার্বি’-তে উত্তেজনার পারদ যে চরমে উঠবে, তা এখনই আন্দাজ করা যাচ্ছে।
আইএসএলে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে শেষ আট ম্যাচের মধ্যে সাতটিতেই হেরেছে নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি। ২০২২-এর ডিসেম্বরে একমাত্র জয়টি পায় তারা। নর্থইস্টের বিরুদ্ধে শেষ তিনটি ম্যাচের প্রতিটিতেই অন্তত তিন গোল করে দিয়েছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। সব মিলিয়ে আইএসএলে এ পর্যন্ত নর্থইস্টের বিরুদ্ধে ২৪ গোল করেছে গতবারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়নরা। সেটপিস থেকে এ বার মোট ৯টি গোল করেছে মোহনবাগান। একমাত্র ওডিশা এফসি (১০) তাদের চেয়ে বেশি সেটপিস গোল করেছে। লিস্টন কোলাসো এ পর্যন্ত নর্থইস্টের বিরুদ্ধে আটটি গোল করেছেন।
আইএসএলে ঘরের মাঠে শেষ ছ’টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে হেরেছে নর্থইস্ট। বাকি চারটিতে জিতেছে ও একটিতে ড্র করেছে তারা। গত দু’টি হোম ম্যাচে আটটি গোল করেছে তারা। কোচ হুয়ান পেদ্রো বেনালির প্রশিক্ষণে আইএসএল এ পর্যন্ত জেতার জায়গায় গিয়েও ৩১ পয়েন্ট খুইয়েছে গুয়াহাটির দলটি। এ মরশুমে পাঁচটি ম্যাচে জেতার জায়গায় গিয়েও পয়েন্ট খুইয়েছে তারা। এ মরশুমের প্রথম ম্যাচেও মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ২-১-এ এগিয়ে গিয়েও ২-৩-এ হারে তারা।
ইন্ডিয়ান সুপার লিগে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ১১ বার। মোহনবাগান জিতেছে আটবার, নর্থইস্ট দু’বার ও একবার ড্র হয়েছে। মোহনবাগানের দাপটের ধারাই এবারেও অব্যাহত থাকে না, ডুরান্ড কাপ ফাইনালের মতো ফের একবার সবুজ-মেরুন বাহিনীর বিরুদ্ধে নর্থইস্টই শেষ হাসি হাসে, সেটাই দেখার।
(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)
আরও পড়ুন: কোন পরিকল্পনায় চেন্নাইয়িন-বধ? ম্যাচ শেষে জানালেন ইস্টবেঙ্গল কোচ অস্কার ব্রুজোন