কলকাতা: ঘরের মাঠে আধিপত্য ফিরিয়ে এনে শনিবার জামশেদপুর এফসিকে (Jamshedpur FC) ৩-০-য় হারাল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট (Mohun Bagan Super Giant)। লিগ টেবলে এত দিন শীর্ষে থাকা বেঙ্গালুরু এফসি-কেও টপকে গেল তারা। দুই দলেরই পয়েন্ট সংখ্যা সমান (১৭) হলেও গোলপার্থক্যে এগিয়ে যাওয়ায় এক নম্বরে উঠে পড়ল গতবারের লিগশিল্ড চ্যাম্পিয়নরা। মোহনবাগানের গোলপার্থক্য যেখানে আট, সেখানে বেঙ্গালুরুর এই সংখ্যা সাত। তৃতীয় স্থানে থাকা নর্থইস্ট ইউনাইটেডের সংগ্রহ ১৫। তবে তারা সেরা দুই দলের চেয়ে একটি ম্যাচ বেশি খেলেছে।
গত দুই ম্যাচে দশ গোল খেয়ে শোচনীয় হারের মুখ দেখা জামশেদপুর এফসি এই ম্যাচেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সারা ম্যাচে দাপুটে ফুটবল খেলে প্রতিবেশী রাজ্যের দলকে কার্যত কোণঠাসা করে রাখে মোহনবাগান এসজি। সারা ম্যাচে যেখানে আটটি শট গোলে রাখে সবুজ-মেরুন বাহিনী, সেখানে দু’টির বেশি শট লক্ষ্যে রাখতে পারেনি ইস্পাতনগরীর দল। ৬৪ শতাংশ বল তাদেরই দখলে ছিল।
শনিবার বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে প্রায় ৩১ হাজার সমর্থকের সামনে ম্যাচের ১৫ মিনিটের মাথায় গোলের খাতা খোলেন টম অলড্রেড। বিরতির ঠিক আগে বাড়তি সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে চলতি লিগের প্রথম গোল করে ব্যবধান বাড়িয়ে নেন লিস্টন কোলাসো। দ্বিতীয়ার্ধে ৭৫ মিনিটের মাথায় অনায়াসে তৃতীয় গোল করেন অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড জেমি ম্যাকলারেন। ৮৩ মিনিটের মাথায় কোলাসোর শট পোস্টে ধাক্কা না খেলে হয়তো চার গোলে জিততে পারত মোহনবাগান। তবে এই ব্যবধানই তাদের শীর্ষে তোলার পক্ষে যথেষ্ট।
এ দিন আশিস রাইয়ের জায়গায় দীপেন্দু বিশ্বাস ও অনিরুদ্ধ থাপার জায়গায় দীপক টাঙরিকে প্রথম এগারোয় রেখে ৪-২-৩-১-এ দল সাজায় মোহনবাগান এসজি। অন্যদিকে, প্রথম এগারোয় পাঁচটি পরিবর্তন করে দল নামায় জামশেদপুর এফসি।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার প্রবণতা দেখা যায় মোহনবাগানের খেলায়। ঘনঘন আক্রমণে ওঠে তারা। ম্যাকলারেনকে রেখে পিছন থেকে সমানে গোলের সুযোগ তৈরি করার চেষ্টা করেন মনবীর, কোলাসো ও পেট্রাটসরা। দুই সাইড ব্যাক শুভাশিস, দীপেন্দুরাও মাঝে মাঝে ওভারল্যাপে ওঠেন। প্রতি আক্রমণে উঠলেও জামশেদপুরের কোনও আক্রমণই দানা বাঁধেনি।
ম্যাচের ১৫ মিনিটের মাথায় প্রথম কর্নার পেয়েই তা থেকে গোল পেয়ে যায় সবুজ-মেরুন বাহিনী। কর্নারের পর বল বক্সের বাইরে এলে তা ফের বক্সের মধ্যে পাঠান টাঙরি। তা হাভিয়ে সিভেরিওর পা ও আলবার্তো রড্রিগেজের মাথা ছুঁয়ে পৌঁছয় টম অলড্রেডের কাছে। তাঁর ডান পায়ের জোরালো শট বারের নীচ দিয়ে গোলে ঢুকে পড়ে (১-০)।
এই গোলের তিন মিনিট পরেই সমতা আনার সুযোগ পেয়ে যান হার্নান্ডেজ। কিন্তু ছ’গজের বক্সের মাথা থেকে নেওয়া তাঁর হেড বারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। তবে প্রতিপক্ষকে আর সুযোগ না দিয়ে ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে সবুজ-মেরুন বাহিনী। ২৫ মিনিটের মাথায় পেট্রাটসের গোলমুখী শট আটকে দেন গোলকিপার আলবিনো গোমস। এর চার মিনিট পরে বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢোকা কোলাসো কঠিন কোণ থেকে গোলে শট নিলেও তা ফের আটকে দেন গোমস।
আশুতোষ মেহতা, মহম্মদ শ্যানন, জর্ডান মারের মতো প্রথম দলের খেলোয়াড়রা এ দিন শুরু থেকে না খেলায় জামশেদপুরের আক্রমণের বেশিরভাগ চাপটাই পড়ে হার্নান্ডেজের ওপর। হাভিয়ে সিভেরিও মাঠে থাকলেও তাঁকে ততটা কার্যকরী মনে হয়নি। অনিকেত যাদব, নিখিল বার্লাদেরও তেমন বিপজ্জনক লাগেনি। মাঝমাঠ থেকে গোলের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন রে তাচিকাওয়া। বেশিরভাগ সময়ই প্রত্যক্ষ ভাবে আক্রমণে উঠতে পারেননি তিনি। প্রথমার্ধে তাদের একটিও শট লক্ষ্যে ছিল না।
রক্ষণেও এ দিন ইস্পাতকঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি ইস্পাতনগরীর দল। বাগান বাহিনী বারবার তাদের রক্ষণে চিড় ধরিয়ে তাদের গোল এলাকায় হানা দেয়। প্রথমার্ধে তাদের হাফ ডজন শট লক্ষ্যে ছিল। প্রথমার্ধে তিন মিনিটের বাড়তি সময়ে যে গোলটি করে ব্যবধান বাড়ান কোলাসো, সেই গোলের সময় পাঁচজন ডিফেন্ডার তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারেননি। নাগাড়ে একাধিক অসাধারণ ড্রিবল করে বক্সের মাঝখান থেকে বাঁ পায়ে চলতি লিগের প্রথম গোলটি করেন তিনি (২-০)।
গত মরশুমে ১৫ এপ্রিল মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে আইএসএলের শেষ গোলটি করেছিলেন কোলাসো। তার পর মোট ২৭টি শট গোলে রেখেও জালে জড়াতে পারেননি। ২৮তম চেষ্টায় অবশেষে গোল পেলেন তিনি। ধৈর্য্য ধরে কঠোর পরিশ্রম করে গিয়েছেন এত দিন ধরে। অবশেষে তারই ফল পান এদিন।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে মহম্মদ শ্যানন ও প্রণয় হালদারকে নামায় জামশেদপুর এফসি। তাতে অবশ্য খুব একটা লাভ হয়নি তাদের। মোহনবাগানের দাপট এই অর্ধেও বজায় ছিল। ইস্পাতনগরীর দল প্রথমবার গোলে শট রাখে ম্যাচের ৫০ মিনিটের মাথায়, যখন বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শট নেন তাচিকাওয়া। দুর্দান্ত দক্ষতায় সেই জোরালো শট রুখে দেন বিশাল কয়েথ। চলতি লিগে তাঁর ২৫তম সেভ এটি।
প্রথমার্ধে গোলের জন্য যতটা মরিয়া ছিল মোহনবাগান, দ্বিতীয়ার্ধে তাদের ততটা মরিয়া লাগেনি। বরং বলের দখল বাড়িয়ে ম্যাচে আধিপত্য বজায় রাখাই ছিল তাদের কৌশল। তবে তা যে ছিল ঝড়ের আগের নৈঃশব্দ, তা বোঝা যায় ৭৫ মিনিটের মাথায়, যখন তৃতীয় গোল করেন জেমি ম্যাকলারেন।
গোল পাওয়ার জন্য মরিয়া জামশেদপুর যখন হাইলাইন ফুটবল খেলতে ব্যস্ত, তখন সেন্টার লাইন থেকে দূরপাল্লার থ্রু হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন টাঙরি। সেই বল ধরে কার্যত ফাঁকা এলাকা দিয়ে বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়েন মনবীর। তাঁর সামনে গোলকিপার ছাড়া ছিলেন আর একজন ডিফেন্ডার। বাইলাইনের সামনে গিয়ে গোলের সামনে ম্যাকলারেনের উদ্দেশে ছোট্ট স্কোয়ার পাস দেন মনবীর। ছোট্ট টোকায় জালে বল জড়াতে কোনও ভুল করেননি অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপার (৩-০)। আইএসএলে মোহনবাগানের হয়ে এই নিয়ে ১৭তম অ্যাসিস্ট করলেন মনবীর, আইএসএলে সবুজ-মেরুন জার্সিতে যে রেকর্ড আর কারও নেই।
তৃতীয় গোলের আট মিনিট পর ফের ব্যবধান বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ পান কোলাসো। বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢুকে গোমসের বিরুদ্ধে ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে গোলে কোণাকুনি শট নিলেও তা ডিফেন্ডার স্টিফেন এজের পায়ে লেগে পোস্টে ধাক্কা খায়। ততক্ষণে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন হাভিয়ে হার্নান্ডেজরা। পাঁচ মিনিটের বাড়তি সময়েও লড়াইয়ে ফেরার মতো অবস্থা ছিল না তাদের।
(তথ্য: আইএসএল মিডিয়া)
আরও পড়ুন: গোল করলেন রোনাল্ডো, তাও লিগ মরশুমের প্রথম পরাজয় এড়াতে পারল না আল নাসর