কলকাতা: 'ভাই তোর ঠিকানা দিস... আমি আজীবন ইস্টবেঙ্গল! কিন্তু তুই আমার ভাইকে কাঁধে নিয়েছিস! বিজয়ার দিন, যতদিন বেঁচে আছি... তোর মাকে প্রণাম করে আসব। জয় মোহনবাগান! জয় ফুটবল!'


যাঁর উদ্দেশে সোমবার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টটি করেছেন অভিনেতা দেবদূত ঘোষ (Debdut Ghosh), লাইনগুলি শুনে সেই শিলাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Shiladitya Banerjee) চোখে জল। গলা ধরে আসছে কথা বলার সময়। তিনি যে এরকম নায়কের সম্মান পাবেন, ভাবেননি। তিনি মনে মনে বিশ্বাস করেন, বীরপুজো পাওয়ার মতো কিছুই করেননি। যেটুকু করেছেন, তা মানবিকতার জন্য। নিজের মা, বোন, স্ত্রীর কথা ভেবে। মানুষের কথা ভেবে। সভ্যতার কথা ভেবে। সমাজের কথা ভেবে।


কে এই শিলাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়? ছাপোষা চেহারা। কথাবার্তায় নেই কোনও বিশেষত্ব। কট্টর মোহনবাগান ভক্ত। রবিবার রাত থেকে যিনি বীরের মর্যাদা পাচ্ছেন।


আর জি কর কাণ্ডের পর পুলিশ নিরাপত্তা দিতে পারবে না, এরকম কারণ দেখিয়ে ডুরান্ড কাপে ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান (East Bengal vs Mohun Bagan) ডার্বি ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। তাতেই প্রতিবাদে ফেটে পড়েন দুই দলের সমর্থকেরা। অভিযোগ ওঠে, বড় ম্যাচের গ্যালারিতে আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের এককাট্টা হয়ে ওঠার খবর আগাম পেয়েই ম্যাচের নিরাপত্তা দিতে না পারার অজুহাত দেয় প্রশাসন। যে কারণে ডার্বি বাতিল করার সিদ্ধান্ত। তবে তাতে কণ্ঠরোধ করা যায়নি। আর জি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ে সল্ট লেকের যুবভারতী স্টেডিয়ামের সামনে। সেই প্রতিবাদে গলা মেলান মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা। ছিলেন মহমেডান ভক্তরাও। স্লোগান ওঠে, 'দুই গ্যালারি এক স্বর, জাস্টিস ফর আর জি কর।'


সেই প্রতিবাদের মুহূর্তেই এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থককে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শিলাদিত্য। সেই ছবি রাতারাতি ভাইরাল। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। সকলের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের সমর্থকদের সৌভ্রাতৃত্বের বিরল সেই দৃশ্য।


ঘটনার পরের দিন সকালে এবিপি আনন্দকে শিলাদিত্য বলছিলেন, 'আমার খুব সহজ দুটো কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমার সল্ট লেকে যুবভারতী স্টেডিয়ামের সামনে প্রতিবাদ জমায়েতে না যাওয়ার ৯৯টা কারণ ছিল। কিন্তু আমি গিয়েছিলাম আমার বোনের কথা ভেবে। আর জি কর হাসপাতালের নির্যাতিতা চিকিৎসক তো আমার বোন। আমি কোনও রাজনীতিতে নেই। খেলা ভালবাসি। মাঠের ছেলে।' যোগ করলেন, 'আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ করার সময় কেউ যেন না ভাবেন যে, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান শত্রু। এরকম বেনজির ঘটনার প্রতিবাদে আমরা সব সময় এককাট্টা। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান হাতে হাত মেলালে সব কিছু সম্ভব।'


ঠিক কী ঘটেছিল রবিবার? 'যখন প্রতিবাদ করছিলাম, আমার স্ত্রীর ওপর একজন পুরুষ পুলিশ লাঠিচার্জ করেন। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ওঁকে বলি, আপনি নিজেও জানেন যে, আপনি ভুল করছেন। আমাদের প্রতিবাদ তো নিজেদের স্বার্থে নয়, আপনারও দিদি-বোনের জন্য। মোহনবাগানের পতাকা ধরে কাঁদছিলাম,' বলছিলেন শিলাদিত্য।


ইস্টবেঙ্গল সমর্থককে কাঁধে তুলে নেওয়াটা কি পূর্বপরিকল্পিত? শিলাদিত্য বলছেন, 'সেই সময় মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা আলাদা আলাদা জটলায় প্রতিবাদ করছিল। আচমকাই আমার মনে হয়, কেন আমার কাঁধে উঠে আরও জোরাল কণ্ঠে স্লোগান দেবে না ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকেরা? সেই ভাবনা থেকেই ওই ইস্টবেঙ্গল সমর্থককে কাঁধে তুলে নেওয়া। আমি চিনতামও না ওঁকে। পরে আমাদের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় জানলাম, ওই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের নাম রোহন গুহ। আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। আমি অ্যাকসেপ্টও করেছি।'


রবিবার রাত থেকে শিলাদিত্য-রোহনের সেই ছবি নিয়ে পাড়ার মোড়ে মোড়ে আলোচনা। শিলাদিত্যর ফোন উপচে পড়ছে মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপে। শিলাদিত্য বলছেন, 'মেরিনার্স বেস ক্যাম্প আলট্রাসের সদস্য আমি। আমার পরনে হয়তো মোহনবাগানের জার্সি ছিল। কিন্তু হৃদয়ে ছিল ন্যায়বিচারের দাবি।'


কসবার হালতুতে ভাড়াবাড়িতে থাকেন। স্ত্রী ঈশিতার সঙ্গে সন্ধ্যায় হালতু মোড়ে টেবিল পেতে পোলাও-মাংস বিক্রি করেন। রবিবার সন্ধ্যা সাতটায় সস্ত্রীক বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ফিরে সাড়ে সাতটায় দোকান খুলেছিলেন। শিলাদিত্য বলছিলেন, 'আমার বাবা পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গত ৭০ বছরের মোহনবাগানের সব খেলার সব খবর পেপার কাটিং করে রাখা আছে। বাবা-দাদু সকলেই মোহনবাগান ভক্ত। দাদা কর্মসূত্রে মুম্বইয়ে থাকে। তবে ও-ও খেলা ভালবাসে।' যোগ করলেন, 'উচ্চ মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি। অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে জল বয়েছি। অনটনের কারণেই সংসারের হাল ধরতে আর পড়াশোনা করতে পারিনি।'


আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদের জন্য ডার্বির মঞ্চ বেছে নেওয়া কি নতুন এক দিগন্ত খুলে দিয়ে গেল? শিলাদিত্য বেশি কঠিন করে ভাবতে চান না। বলছেন, 'আজন্ম দেখে আসছি, সব কিছুতে রাজনীতির রং লাগে।  চাইব, যেন এই ঘটনার অপরাধীদের খুঁজে বার করে চরম শাস্তি দেওয়া হয়। এতে যেন রাজনীতি জড়ানো না হয়। আমি মনে করি সকলের প্রতিবাদ করা উচিত। আমরা কারও বিরুদ্ধে নই। শুধু ন্যায়বিচার চাই। কাল যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁরা সকলে নিরস্ত্র ছিলেন। সারা বছর খেলা দেখতে মাঠে যান। আমি বেশিরভাগকেই চিনি। আমার চোখের সামনে একজন বৃদ্ধকেও কাল পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে। এর চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারত না।'


খেলার টানে, ফুটবলের প্রেমে, মোহনবাগানকে ভালবেসে বাংলাদেশ, ভুবনেশ্বর, জামশেদপুরেও গিয়েছেন শিলাদিত্য। বলছেন, 'আমি যেখানে থাকি, সেটা ইস্টবেঙ্গলের ডেরা। কিন্তু কোনওদিন অসম্মান পাইনি। ছোট থেকে সকলের ভালবাসা পেয়েছি। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরাও সব সময় ভালবেসেছেন। সেখান থেকেই হয়তো প্রতিবাদ কর্মসূচির সময় মনে হয়েছে, ইস্টবেঙ্গল সমর্থককে কাঁধে তুলে নিই।'


সাদামাটা যুবক বেশি হইচই চান না। বলছেন, 'নায়কের মতো কিছুই করিনি। মানুষের যা করা উচিত, তাই করেছি।'