কলকাতা: দীর্ঘ ১৩ বছর পর রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে বাংলা। শেষবার ট্রফি জয়? সেও ৩০ বছর আগে। ১৯৮৯-৯০ মরসুমে। ইডেনে ফাইনালে কোশেন্টের বিচারে দিল্লিকে হারিয়ে।


সোমবার থেকে রাজকোটে সৌরাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়ার আগে অবশ্য বাংলাকেই সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসাবে বেছে নিচ্ছেন প্রাক্তন অধিনায়কেরা। সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক মলহোত্র, সাবা করিমরা জানিয়ে দিচ্ছেন, চাপমুক্ত হয়ে ম্যাচটা উপভোগ করতে পারলেই ৩০ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হবে। ট্রফি ঢুকবে বাংলা শিবিরে।

বাংলা শেষবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সম্বরণের নেতৃত্বে। বাংলা-সৌরাষ্ট্র ম্যাচের আগের দিন সম্বরণ বলছেন, ‘ছেলেরা এই মরসুমে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলছে। হারা ম্যাচ জিতেছে। বাংলাই এগিয়ে রয়েছে ফাইনালে।’ ছেলেদের কী পরামর্শ দেবেন? সম্বরণ বলছেন, ‘মাঠে নেমে করে দেখাও। অনেকদিন হয়ে গেল ট্রফিটা অধরা। ভাল ক্রিকেট খেলো। ম্যাচটা উপভোগ করো।’ যোগ করছেন, ‘ব্য়াটিংয়ে টপ অর্ডার ধারাবাহিকতা দেখাতে পারছে না। অনুষ্টুপ মজুমদারের অসাধারণ ব্যাটিং আর লোয়ার মিডল অর্ডারে শাহবাজ আমেদের লড়াইয়ে এতদিন উতরে যাওয়া গিয়েছে। তবে এবার উপরের দিকের ব্যাটসম্যানদের রান করতেই হবে।’

সৌরাষ্ট্রের কোচ কারসন ঘাউড়ির সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব সম্বরণের। ফাইনালের আগে ফোনে কথা হয়েছে। সম্বরণ বলছিলেন, ‘কারসন বলছিল রাজকোটে ব্যাটিং সহায়ক উইকেট হয়েছে। দুদলের ব্যাটসম্যানরাই সুবিধা পাবে। তবে বোলিংয়ের জন্যই ফেভারিট বাংলা।’

বাংলার আর এক প্রাক্তন অধিনায়ক অশোক মলহোত্রও এগিয়ে রাখছেন অভিমন্যু ঈশ্বরণদের। বলছেন, ‘সৌরাষ্ট্রের ঘরের মাঠে খেলা। তবু বাংলাই জিতবে। কঠিন পরিস্থিতিতে দল দারুণ খেলেছে। অন্তত দুটো ম্যাচ প্রায় খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতেছে। দল আত্মবিশ্বাসে ফুটছে।’ তিনি কোচ থাকাকালীন বাংলা রঞ্জি ট্রফির সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল। মলহোত্র বলছেন, ‘সেবারের সঙ্গে এখনকার দলের অনেক তফাত। এবার ড্রেসিংরুম অনেক বেশি সংঘবদ্ধ।’

দলের পাল্টে যাওয়া আবহের নেপথ্যে কোচ অরুণ লালকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন মলহোত্র। বলছেন, ‘পিগি (অরুণের ডাকনাম) দারুণ কাজ করছে। পরিশ্রমী। ওর প্রশিক্ষণে ছেলেরা খুব খেটেছে।’ একসঙ্গে খেলার সময় তাঁর সঙ্গে অরুণের সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিল বলে শোনা যায় না। বরং ময়দানের আনাচকানাচে এখনও দুজনের সম্পর্কের শীতলতা নিয়ে নানা কাহিনি শোনা যায়। যদিও মলহোত্র বাংলার কোচ থাকাকালীন অরুণকে ডেকেছিলেন ছেলেদের উৎসাহ দিতে। এবার কি আপনার সঙ্গে অরুণের কথা হয়েছে? মলহোত্র বলছেন, ‘এর মধ্যে কথা হয়নি। তবে পিগি মানসিকভাবে ভীষণ কঠিন। ও থাকা মানে গোটা শিবির টগবগ করবে। ভীষণ ইতিবাচক, লড়াকু চরিত্র। বাংলাও ওর আদর্শ মেনেই খেলছে।’

ফাইনালের আগে ছেলেদের কী পরামর্শ দেবেন? বাংলার শেষ রঞ্জি জয়ী দলের অন্যতম সদস্য মলহোত্র বলছেন, ‘টস জিতলে আগে ব্যাটিং করে নাও। ফাইনালের মতো বড় ম্যাচে শুরুতে ব্যাট করে বড় রান চাপিয়ে দিতে পারলে প্রতিপক্ষ কেঁপে যায়। আর চেতেশ্বর পূজারাকে নিয়ে ভেবো না। আমরাও তো ঋদ্ধিমান সাহাকে পাচ্ছি। কর্নাটকের হয়ে কে এল রাহুল-মণীশ পাণ্ডে-করুন নায়ার খেলেছিল। ওদের তো একপেশেভাবে হারিয়েছি।’ মলহোত্র যোগ করছেন, ‘বরং নিজেদের টপ অর্ডার ব্যাটিং নিয়ে ভাবুক। অভিমন্যু, অভিষেক রামনরা রান পাচ্ছে না। মনোজ তিওয়ারি ধারাবাহিক নয়। ফাইনালে ওদের রান করার পালা।’

বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক সাবা করিমও ফেভারিট বেছে নিচ্ছেন অভিমন্যুদেরই। জাতীয় দলের প্রাক্তন উইকেটকিপার মুম্বই থেকে ফোনে বললেন, ‘ছেলেরা দারুণ খেলছে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এটাকে ফাইনাল হিসাবে দেখো না। আর পাঁচটা ম্যাচের মতো ভেবে মাঠে নামো। তাতে বাড়তি চাপ পড়বে না। দলে অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। সাপোর্ট স্টাফেরাও ভীষণ অভিজ্ঞ। বাংলাই ফেভারিট। অনেক কঠিন পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচ জিতেছে। সেমিফাইনালটাই যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।‘

চেতেশ্বর পূজারার অন্তর্ভুক্তি সৌরাষ্ট্রের ব্যাটিংকে শক্তিশালী করবে মেনে নিয়েও সাবা কর্নাটক ম্যাচের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। বলছেন, ‘কর্নাটকের ব্যাটিংটা ভাবুন। কে এল রাহুল-সহ কত বড় বড় নাম ছিল। তাদেরও হারিয়েছে বাংলা। আমাদের বোলাররা দুরন্ত ফর্মে। কে খেলল আর কে খেলল না, সেসব ভাবার দরকারই নেই। ‘

দলের কোন ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছে? প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক সাবা বলছেন, ‘দলগত সংহতি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ম্যাচ জিতেছে। যার থেকে বোঝা যায় ছেলেরা কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ব্যাটিং টপ অর্ডার মাঝে মধ্যে ব্যর্থ হলেও মিডল ও লোয়ার মিডল অর্ডার পারফর্ম করেছে। বোলাররা ছন্দে। ফাইনালে ঠিক এভাবেই খেলে যেতে হবে।‘

সাবা কৃতিত্ব দিচ্ছেন অরুণ লালকেও। বলছেন, ‘পিগির ঝুলিতে অফুরন্ত অভিজ্ঞতা। সকলকে খুব অনুপ্রাণিত করতে পারে। গেম রিডিং দুরন্ত। ঘরোয়া ক্রিকেট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রয়েছে। দলের ফিটনেসের ছবিটাই পাল্টে দিয়েছে। পরিকল্পনা করে এগিয়েছে। ছেলেরা ওর তত্ত্বাবধানে পরিশ্রম করেছে। পুরো দল এখন অনেক ইতিবাচক। পিগি জানে ছেলেদের শক্তি আর দুর্বলতা। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করেছে। দলটাকে এক সূত্রে গেঁথেছে। এই বাংলা এখন প্রতিপক্ষ শিবিরে ভয় ধরাচ্ছে।‘

দীপ দাশগুপ্ত অবশ্য সতর্ক করছেন বাংলা শিবিরকে। কারণ? ‘সৌরাষ্ট্র ঘরের মাঠে খেলবে। রাজকোটের উইকেট, পরিবেশ-পরিস্থিতি ওরা অনেক ভাল বোঝে। তাই ওদের সুবিধা হবে’, মহিলাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচের ধারাভাষ্য দেওয়ার ফাঁকে মুম্বই থেকে ফোনে বলছিলেন দীপ। তাঁর নেতৃত্বেই ২০০৬-০৭ মরসুমে শেষবার রঞ্জি ফাইনালে খেলেছিল বাংলা। তবে সেই ম্যাচে মুম্বইয়ের কাছে হারতে হয়েছিল। দীপ বলছেন, ‘বাংলার ক্রিকেটারদের বলব, ফাইনাল খেলতে নামছো এভাবে ভেবো না। আর পাঁচটা সাধারণ ম্যাচ ভেবেই নামো। জানি সেটা কঠিন। তবে চাপমুক্ত থাকা যাবে।’

জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার যোগ করলেন, ‘এই ম্যাচে আলাদা কিছু করার দরকার নেই। যেভাবে খেলছে, সেভাবেই এগোক। গোটা মরসুম ভাল ক্রিকেট খেলেছে ছেলেরা।‘ সৌরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দিচ্ছেন দীপ। বলছেন, ‘ওরা শক্তিশালী দল। সবচেয়ে বড় কথা, ৫ বছরের মধ্যে ৩ বার ফাইনাল খেলছে। বড় ম্যাচের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাংলার এই দলের একমাত্র মনোজ ছাড়া আর কারও রঞ্জি ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা নেই। সৌরাষ্ট্রকে হারাতে হলে বাংলাকে ভাল খেলতে হবে।’