কলকাতা: বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে ভারত বিদায় নেওয়ার পর পাঁচদিন কেটে গিয়েছে। এখনও বিষণ্ণতা কাটছে না ভারতীয় ক্রিকেটমহলে। বিপর্যয় নিয়ে নিরন্তর কাটাছেঁড়া চলছে। প্রশ্নের মুখে নির্বাচকদের ভূমিকাও। প্রাক্তন নির্বাচকদের চোখেও ধরা পড়ছে এমএসকে প্রসাদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচকমণ্ডলীর পরিকল্পনায় একাধিক খামতি।


ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপ জেনেও অজিঙ্ক রাহানেকে উপেক্ষিত হতে দেখে বিস্মিত দিলীপ বেঙ্গসরকার। জাতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক বেঙ্গসরকার প্রধান নির্বাচকের দায়িত্বও সামলেছেন। তিনি নির্বাচক প্রধান থাকাকালীনই জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই বেঙ্গসরকার সোমবার মোবাইল ফোনে বললেন, ‘রাহানেকে না দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। শিখর ধবন চোট পেয়ে ছিটকে যাওয়ার পরও ওকে ডাকা যেতে পারত। ইংল্যান্ডের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে রাহানে আদর্শ বিকল্প হতে পারত। ইংল্যান্ডে ওর রেকর্ড ভাল। টেকনিক ভাল। কাউন্টি ক্রিকেট খেলছে বলে আবহাওয়ার সঙ্গেও সড়গড় ছিল। ব্যাটিং অর্ডারের চার নম্বর জায়গায় ওকে ভাবা যেতেই পারত।’

অম্বাতি রায়াডুকে পরিবর্ত ক্রিকেটারের তালিকায় রাখা হলেও বিশ্বকাপে ডাক পাননি। টুর্নামেন্ট চলাকালীন আচমকা অবসর ঘোষণা করেন রায়াডু। তাঁর সঙ্গে অবিচার হয়েছে বলে সোচ্চার হয়েছেন গৌতম গম্ভীর, যুবরাজ সিংহের মতো তারকারাও। জাতীয় দলের প্রাক্তন নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও মনে হচ্ছে, রায়াডুর সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। বাংলার রঞ্জি ট্রফি জয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বলছিলেন, ‘রায়াডুকে যদি বিশ্বকাপের দলে নাই রাখা হয়, তাহলে টুর্নামেন্টের আগে পর্যন্ত ওকে খেলিয়ে যাওয়া হল কেন!  বিজয় শঙ্করকে চার নম্বরে খেলানোটাও নির্বাচকদের পরিকল্পনার অভাব বলেই মনে হয়েছে। তামিলনাড়ুর হয়েও ও ছয় বা সাতে ব্যাট করে। সেই শঙ্করকে কীভাবে বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে, তাও আবার ইংল্যান্ডের মাটিতে চারে খেলিয়ে দেওয়া হল!’ সম্বরণ আরও বললেন, ‘রাহানে বা শ্রেয়স আইয়ারের মধ্যে একজনকে দলে রেখে ব্যাটিং অর্ডারের চারে খেলানো উচিত ছিল। রাহানের দক্ষতা নিয়ে সংশয় তো নেই-ই। শ্রেয়সও ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিতভাবে দেড়শো বলে দেড়শো রান করা ব্যাটসম্যান।’

একই সুর রাজা বেঙ্কটের গলায়। ২০১১ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে দেশের মাটিতে বিশ্বজয়ের সময় রাজা ছিলেন জাতীয় নির্বাচকমণ্ডলীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিনিধি। সোমবার তিনি বলছিলেন, ‘বিশ্বকাপের পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করতে হয়। নির্বাচক থাকাকালীন আমরাও চার বছর আগে থেকে বিশ্বকাপের নীল নকশা তৈরি করে ফেলেছিলাম। সেই ভাবেই ক্রিকেটারদের দলে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সবরকম পারমুটেশন-কম্বিনেশন দেখে নেওয়া হয়েছিল। জানি না বর্তমান নির্বাচক কমিটির পরিকল্পনায় কোনও খামতি ছিল কি না। তা নাহলে শঙ্করকে চার নম্বরে ভাবা হল কেন। ওকে ছোট করছি না। তবে নিজের রাজ্য দলেই ছয় বা সাতে ব্যাট করে শঙ্কর। ৫০ ওভারের ক্রিকেট আর টি-টোয়েন্টির মধ্যে অনেক তফাত। ওয়ান ডে-তে এমন একজনকে দরকার হয়, যাকে কেন্দ্র করে ইনিংস গড়ে ওঠে। রাহুল দ্রাবিড় যে কাজটা বছরের পর বছর ধরে করত।’ রাজা যোগ করলেন, ‘ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপ বলে ওখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতিতে সফল হতে পারে এমন ক্রিকেটারকেই চার নম্বরের জন্য ভাবা উচিত ছিল। রাহানে সেরা পছন্দ হতে পারত। শ্রেয়সকেও নেওয়া যেতে পারত। দলের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৩জনের নির্বাচন নিয়ে কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবে দুটি জায়গা নিয়ে আরও ভাবা যেত।’

বিরাট কোহলিদের সেমিফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার পর নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকা নিয়ে অনেকেই অসন্তুষ্ট। পাঁচ নির্বাচকের মধ্যে দুজন দল নির্বাচনী বৈঠকে উদাসীন থাকেন বলেও বিভিন্ন মহলের অভিযোগ। জাতীয় দলের প্রাক্তন উইকেটকিপার তথা জাতীয় নির্বাচকমণ্ডলীর এক সময়কার প্রধান কিরণ মোরে সরাসরি এই বিতর্কে ঢুকতে চাননি। তবে মোবাইল ফোনে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বললেন, ‘নির্বাচক কমিটিতে মতভেদ থাকবেই। তবে সকলের মত প্রকাশ করাটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।’ প্রধান নির্বাচক হিসাবে তরুণ ধোনিকে ভারতীয় দলে নিয়েছিলেন। সেই মোরে বলছেন, ‘ধোনিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। তবে ওকে চার নম্বরে খেলানো যেতে পারত। তাহলে আরও খোলা মনে ব্যাটিং করতে পারত ও।’

এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব কীভাবে? প্রত্যেকেই তারুণ্যের দর্শনে জোর দেওয়ার কথা বলছেন। বেঙ্গসরকার বলছেন, ‘দেশে অনেক তরুণ প্রতিভা রয়েছে। তাদের সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। পৃথ্বী শ, শুবমান গিলরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভাল খেলবে।’ মোরে বলছেন, ‘এই দলের অনেকেই রয়েছে যারা পরের বিশ্বকাপে খেলবে না। তাদের পরিবর্তে এখন থেকে পৃথ্বী, শুবমান, শ্রেয়সদের সিনিয়র দলে খেলানো উচিত।’ সম্বরণ আবার বলছেন, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, কেন উইলিয়ামসনের মতো তারকারা নিয়মিতভাবে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে। আমাদের বিরাট বা রোহিত শেষ কবে রঞ্জি খেলেছে অনেকে মনে করতে পারবেন না।’ রাজার গলাতেও এক সুর। বলছেন, ‘তারকাদেরও ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়মিতভাবে খেলতে বলা হোক।’

আর নেতৃত্ব? ওয়াসিম জাফরের মতো কেউ কেউ তো সীমিত ওভারের ক্রিকেটে রোহিত শর্মাকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলছেন? তাতে অবশ্য সায় নেই বেঙ্গসরকার-মোরে-রাজাদের। সকলেই বলছেন, ‘বিরাটই অধিনায়ক থাকুক। ওই সেরা পছন্দ।’