কলকাতা: স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ না করলেও, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ফুটবল মাঠকে বেছে নিয়েছিলেন অসংখ্য বাঙালি। তাঁদের অন্যতম ছিলেন ‘চিনের প্রাচীর’ গোষ্ঠ পাল। তিনি মোহনবাগানের হয়ে ফুটবল ছাড়াও ক্রিকেট, হকি ও টেনিস খেলতেন। পরিবারের লোকজন বলেন, ‘গোষ্ঠ পাল ছিলেন জেল না খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি কোনওদিন ইংরেজদের চাকরি করেননি। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও, মহাত্মা গাঁধীর আন্দোলনকে সমর্থন করে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাননি। তাঁর ফুটবল মাঠ থেকে সরে যাওয়াও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই। ১৯৩৬ সালে একটি ম্যাচে ব্রিটিশ রেফারির ক্রমাগত পক্ষপাতিত্বমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তিনি মাঠে শুয়ে পড়েন। এই ঘটনার জেরে তাঁকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেয় আইএফএ। সে কথা জানতে পেরেই তিনি খেলা ছেড়ে দেন।’


১৯৪৭ সালে যখন স্বাধীনতা এল, সেদিন কী করেছিলেন গোষ্ঠ পাল? তাঁর ছেলে নীরাংশু পাল জানালেন, ‘আমার তখন ৬ বছর বয়স। এখনও মনে আছে, সেদিন বাবা বলেছিলেন, আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি খুব আনন্দ করছিলেন। মাকে বাবা বলেছিলেন, ‘আজ ভাল করে রান্না করো।’ সেদিন কী কী রান্না হয়েছিল, সব মনে না থাকলেও, এটুকু মনে আছে, ইলিশ আর পায়েস রান্না করেছিলেন মা। আমরা তখন শোভাবাজারে থাকতাম। পাড়ার ছেলেদেরও ডেকে খাইয়েছিলেন বাবা। তিনি তখন মোহনবাগানের ফুটবল সচিব। সে বছরই দ্বিতীয়বার আইএফএ শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হয় মোহনবাগান। ফাইনালে হারায় ইস্টবেঙ্গলকে। ফলে বাবার আনন্দ একটু বেশিই হয়েছিল।’

বাবা সম্পর্কে নীরাংশুবাবু আরও জানালেন, ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে বাবার কোনওদিন কথা না হলেও, তাঁর প্রতি বাবার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। বাবার জন্ম ১৮৯৬ সালের ২০ অগাস্ট। ফলে তাঁর বয়স নেতাজির কাছাকাছিই ছিল। বাবার মুখে শুনেছিলাম, একদিন তাঁদের খেলা দেখতে গিয়েছিলেন নেতাজি। খেলা শেষ হওয়ার পর সে কথা জানতে পেরে মোহনবাগানের প্রথম সভাপতি এবং পরবর্তীকালে কংগ্রেস সভাপতি হওয়া ভূপেন বসুকে বাবা বলেছিলেন, ‘আপনারা সুভাষের সঙ্গে আর ঝগড়া করবেন না। তাহলে স্বাধীনতা পেতে সুবিধা হবে।’ বাবা বলতেন, নেতাজি থাকলে দেশের চেহারা অন্যরকম হত, দেশভাগ হত না। নেতাজির সঙ্গে কোনওদিন কথা না হলেও, গাঁধীজি ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাবার ভাল সম্পর্ক ছিল। বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার সময় আশুতোষবাবুর সঙ্গে বাবার আলাপ হয়। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে। সেখানে দু’বার গিয়েছিলেন গাঁধীজি। সেই সময় তাঁর সঙ্গে বাবার আলাপ হয়।’

গোষ্ঠ পাল সম্পর্কে আরও একটি অসাধারণ ঘটনার কথা জানিয়েছেন তাঁর ছেলে। নীরাংশুবাবুর কথায়, ‘১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার আগে পর্যন্ত আমার ঠাকুমা ফরিদপুরেই থাকতেন। দেশভাগের পর তিনি যখন কলকাতায় আসছিলেন, তখন গোয়ালন্দ ঘাটে বাকি সবার মতো তাঁর বাক্সও তল্লাশি করছিলেন পুলিশকর্মীরা। ঠাকুমার বাক্সে ছিল বাবার একটি ছবি। সেটি দেখে এক পুলিশকর্মী জিজ্ঞাসা করেন, কার ছবি? ঠাকুমা জবাব দেন, ‘আমার পোলা।’ তখন সেই পুলিশকর্মী জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনার ছেলের নাম কী?’ ঠাকুমা বলেন, গোষ্ঠ পাল। সে কথা শুনে ওই পুলিশকর্মীর চোখ কপালে উঠে যায়। তিনি নিজেই ঠাকুমার বাক্স বন্ধ করে তাঁকে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে তুলে দেন। শিয়ালদা স্টেশনে ঠাকুমাকে নিতে গিয়েছিলেন বাবা। তাঁকে ঠাকুমা বলেন, ‘আমার পোলারে এত লোক চেনে! আমি তো জানতামই না।’ ঠাকুমার কথা শুনে বাবা হেসেছিলেন।’

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ, পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে গোষ্ঠ পালের সুসম্পর্ক ছিল। কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় তাঁর খেলা দেখতে যেতেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। সে কথা মনে রেখে তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর নিজে পদ্মশ্রীর জন্য গোষ্ঠ পালের নাম মনোনীত করেছিলেন। বাবার কথা বলতে গিয়ে তাই নীরাংশুবাবু যেমন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, তেমনই তাঁর গর্বও হয়।