কুন্তল চক্রবর্তী, কলকাতা:  ভালচার্স স্ট্রিট! ব্রিসবেনের এই প্রান্ত থেকে লাল বল হাতে ছুটে আসছে অস্ট্রেলিয়ার কোনও ফাস্ট বোলার। এই দৃশ্য অনেক ক্রিকেটারেরই রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। সুবিশাল গাব্বা স্টেডিয়াম যেন ব্যাটসম্যান-ক্রিকেটারদের গিলতে আসে। অজি  ক্রিকেটেই একটা কথা প্রচলিত রয়েছে, এখানে বিদেশের ক্রিকেটাররা যখন ব্যাট করতে নামবেন, তখন অজি ফাস্ট বোলাররা চিল-শকুনের মতো ছিঁড়ে খাবেন।  এরসঙ্গে ভালচার্স স্ট্রিট এন্ড কথাটা অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ। ব্রিসবেনের  গাব্বায় সিডনির ক্রিকেট রোমান্টিকতা, মেলবোর্নের ইতিহাসের হাতছানি বা  অ্যাডিলেডের বিনোদনের মানসিকতার কোনও জায়গা নেই। ব্রিসবেন এক অর্থে ভয়ের স্মৃতির উদ্রেক করে। এই স্টেডিয়ামেই সিরিজের প্রথম ম্যাচে দুরন্ত ১৪৪ রান করেছিলেন তৎকালীন ভারতীয় দলের অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তখন ব্রেট লি অজি পেস অ্যাটাক চিন মিউজিক শোনানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। কিন্তু সে সব থোড়াই কেয়ার করে সৌরভের সাহসী ইনিংসে ব্রিসবেনের ভয় কাটিয়ে দিয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই সিরিজ অল্পের জন্য জিততে পারেনি সৌরভের দল। ড্র করে ফিরেছিল টিম ইন্ডিয়া। এবার শুধু ভয় কাটিয়ে ওঠায় নয়, সেই ব্রিসবেনেই অজি ক্রিকেট সংস্কৃতিকেই যেন হ্যাঁচকা টান মারল ভারতের ভাঙাচোরা দল। কারণ, অস্ট্রেলিয় ক্রিকেট সংস্কৃতি একটা সাধারণ কোন স্টেডিয়াম নেই। সেখানেই পূর্ণ শক্তির অস্ট্রেলিয়া দলকে হারাল ভারত।  অস্ট্রেলিয়ার সেরা তিন পেসার, স্পিনার ও ব্যাটসম্যানরা সিরিজে খেলেছিলেন। এর আগের সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবার অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর কোচ রবি শাস্ত্রী বলেছিলেন, এই জয় ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ের থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তখন তাঁর ওই কথায় অনেকেই হেসেছিলেন। কারণ, সেই সিরিজে পূর্ণ শক্তির অস্ট্রেলিয়া দল খেলেনি। ছিলেন না স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, দু-একজন সেরা বোলারও খেলেননি। বলা হচ্ছিল, ভাঙাচোরা দলকে হারিয়ে এতটা বাগড়ম্বর কিসের!


কিন্তু এখানে অস্ট্রেলিয়ার সেরা দলকে হারিয়ে দিল ভারতের ভাঙাচোরা দল। দলে নেই চার সেরা বোলার, দুই স্পিনার, সেই সঙ্গে কোহলি দলে নেই। এরপরও পূর্ণশক্তির অস্ট্রেলিয়াকে সিরিজে হারাল ভারত। এটাই প্রমাণ করল ভারত রিজার্ভ বেঞ্চ কতটা শক্তিশালী।

সেইসঙ্গে আজিঙ্কা রাহানেকে নিয়েও একটা আলোচনা শুরু হয়ে গেল। টেস্ট ক্রিকেটে ঠাণ্ডা মাথার অধিনায়কের কথা বলা হয়। শুধুমাত্র চেঁচালে বা শরীরে আগ্রাসন ফুটিয়ে তুললেই যে ভালো ক্যাপ্টেন হওয়া যায়, তা কিন্তু নয়। রাহানে বারেবারেই তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে চলতি সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট বা ভারতের মাঠে সিরিজে ধর্মশালা টেস্টের কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে ডু অর ডাই ম্যাচে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে কুলদীপ যাদবের অভিষেক ঘটিয়েছিলেন রাহানে। ম্যাচে চার উইকেট নিয়ে ম্যাচ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন কুলদীপ। টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়কত্বের সুযোগ পেলেই নিজেকে প্রমাণ করছেন রাহানে। ফলে ভেতরে ভেতরে কোথাও কোথাও বিরাট কোহলির সঙ্গে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু হয়ে যাবে এবং এনিয়ে আলোচনা শুরু হওয়াটাই স্বাভাবিক।

ব্রিসবেনের ম্যাচে ১৮৬ রানে ছয় উইকেট পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে এমন কামব্যাক দেখে সমস্ত বিশেষজ্ঞই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন যে,  এই জয় ভারতের প্রথম সেরা পাঁচ টেস্ট জয়ের মধ্যে থাকবে।

প্রথম টেস্টে ভারতের ৩৬ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর ক্রিকেটারদের টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি আবেগ আইপিএল-প্রজন্মের ক্রিকেটারদের নেই বলে সমালোচনা উঠেছিল।  এই সমালোচনা কিন্তু ভুল প্রমা করল ভারতীয় দল। টেস্ট ক্রিকেটই যে অগ্রাধিকার, তাঁরা তা ফের প্রমাণ করেছেন ভারতের তরুণ ক্রিকেটাররা।

সবমিলিয়ে বলা যায়, ক্রিকেটের পাওয়ার হাউস অস্ট্রেলিয়াকে ধাক্কা দিল ভারত।  প্রমাণ  করল, যে কোনও পরিস্থিতিতে, যে কোনও দল নিয়ে জিততে পারে ভারত। যে ক্ষমতা ৯০ বা ২০০০-এর শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার ছিল। উল্টে এর কারণ হতে পারে আইপিএল। কারণ, আইপিএলে ভারতের তরুণ ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তারকাদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার খেলার যে ভীতি তরুণ ক্রিকেটারদের থাকে, তা আইপিএল খেলার সময়ই কেটে যাচ্ছে।

টেস্ট ক্রিকেটে যে ভারত এখন অন্যতম সেরা দল তা আরও একবার প্রমাণিত হল। সেইসঙ্গে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা রাহানেকে পাদপ্রদীপের আলোয় ফের নিয়ে এল এই সিরিজ। শুধু একজন ক্রিকেটার হিসেবে নয়, একজন তথা তথা অধিনায়ক হিসেবে।