সন্দীপ সরকার, কলকাতা: বৃহস্পতিবার তাঁর ব্যাটের চাবুকে কলকাতা নাইট রাইডার্স (KKR) শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে গিয়েছিল। ১৩ বলে হাফসেঞ্চুরি করে আইপিএলের (IPL) ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। নীতীশ রানার প্রথম ওভারেই নিয়েছিলেন ২৬ রান। তাঁর ৪৭ বলে অপরাজিত ৯৮ রানের ইনিংস কেকেআরের প্লে অফের স্বপ্নকে ভেন্টিলেশনে পাঠিয়ে দিয়েছে।


যশস্বী জয়সওয়ালের (Yashasvi Jaiswal) আত্মবিশ্বাস দেখে মুগ্ধ বিশেষজ্ঞরা। অথচ এই যশস্বীই ব্যর্থতায় এমন ভেঙে পড়েছিলেন যে, কোচের কাছে গিয়ে আবেগ গোপন করতে পারেননি। কেঁদেও ফেলেছিলেন। শুরু হয়েছিল তাঁর নতুন লড়াই।


২০২০ সালে আইপিএলে অভিষেক যশস্বীর। সেবার মাত্র ৩ ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন। ৪০ রান করেছিলেন বাঁহাতি ব্যাটার। নিজের ফর্ম মেনে নিতে পারেননি। টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পরই দৌড়েছিলেন শৈশবের কোচ জ্বালা সিংহের কাছে। শুক্রবার মুম্বই থেকে ফোনে জ্বালা বলছিলেন, 'অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলে আসার পর ২০২০ সালে প্রথমবার আইপিএলে সুযোগ পায়। কিন্তু সেই আইপিএলে ব্যর্থ হয়েছিল যশস্বী। ৩ ম্যাচে মাত্র ৪০ রান করে। ভীষণ হতাশ ছিল। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। আমার কাছে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।'


সেখান থেকে কোন মন্ত্রে ছাত্রকে পাল্টে দিলেন জ্বালা? যশস্বীর গুরু বলছেন, 'পরের পর্বের প্র্যাক্টিস শুরু করাই। তখন লক ডাউন চলছে। মুম্বইয়ে সব মাঠ বন্ধ ছিল। আমার গ্রামের বাড়ি গোরক্ষপুরে ওকে নিয়ে যাই। ২০১৩ সাল থেকে ও আমার বাড়িতেই থাকত। গোরক্ষপুরে সিমেন্টের পিচ বানিয়ে ১৫ গজ দূর থেকে হার্ড প্লাস্টিক বলে থ্রো ডাউন দিয়ে ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করিয়েছি। সামনের পায়ে ড্রাইভ থেকে শুরু করে বাউন্সারে স্কোয়্যার কাট, পুল, হুক সব প্র্যাক্টিস করিয়েছি। তারপর সেন্টার উইকেট নিয়ে গিয়ে ছয় মারা প্র্যাক্টিস করিয়েছি। তাতেই ওর ব্যাটের ধার বেড়েছে।'


যশস্বী উত্তরপ্রদেশ থেকে মুম্বই যান ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু চোখভর্তি স্বপ্ন নিয়ে এরকম কত কিশোরই মুম্বইয়ে যান। তারপর হারিয়েও যান। যশস্বীকে হারিয়ে যেতে দেননি জ্বালা। বলছিলেন, '১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩। সেদিনই প্রথম ওকে দেখেছিলাম। তখন যশস্বীর বয়স মাত্র ১২ বছর। আজাদ ময়দানে তাঁবুতে থাকত। মাঠকর্মীদের সঙ্গে। আমারও একটা সময় এই জীবন কেটেছে। ওর খেলা দেখে ভাল লেগে যায়।' আজাদ ময়দানে অঞ্জুমান স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন যশস্বী। 'আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। ঊর্দু না জেনে ঊর্দু মাধ্যম স্কুলে পড়বে কেন! ওকে রিজভি স্প্রিংফিল্ড স্কুলে ভর্তি করি। ২০১৩ সাল থেকে সান্তাক্রুজে আমার বাড়িতে থাকা শুরু করে। ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত আমার বাড়িতে থাকত,' বলছিলেন জ্বালা।


যশস্বীর ব্যক্তিগত কোচ যোগ করলেন, 'অনেক গল্প শোনা যায় যে, ও নাকি ফুচকা বিক্রি করত। ২০১৩ সাল পর্যন্ত আজাদ ময়দানে থাকত। তখনও ক্রিকেটার হওয়ার সফর শুরু হয়নি। মাঠের পাশে অনেক ছোট স্টল ছিল। সেখানে কাউকে কাউকে সাহায্য করেছে মাত্র। যশস্বীদের অভাবের সংসার। বাড়িতে ২ ছেলে, ২ মেয়ে। ওর বাবা ২০১৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র ৬ বার মুম্বইয়ে এসেছে। যশস্বী নিজে কোনওদিন ফুচকা বিক্রি করেনি। নিজের সন্তানের মতো ভালবেসেছি ওকে। সবরকম সুযোগ সুবিধা দিয়েছি।'


কেরিয়ারের প্রথম আইপিএলে ব্যর্থতার পর যশস্বীকে আগলে রেখেছিলেন জ্বালা। বলছিলেন, 'অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের পর ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব একটা রান পাচ্ছিল না। তবে ওর দ্বিতীয় আইপিএলের আগে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বলের লাইনে গিয়ে খেলো। ক্রিকেটীয় শট খেলো। অনূর্ধ্ব ১৯ স্তরের বোলারদের সঙ্গে আইপিএল খেলা বোলারদের অনেক তফাত। আচমকা অনেক ভাল বোলারদের খেলতে হচ্ছিল। মানসিকভাবে সমর্থন করতাম। ছোট থেকে দেখছি। জানি কোন ২-১টা জিনিস বললে কাজ হবে। সেটাই তুলে ধরেছিলাম,' বলছিলেন জ্বালা। যোগ করলেন, 'আমি ওকে ওয়াসিম জাফরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। জাফরও ওকে ব্যাটিং নিয়ে পরামর্শ দেয়। দিলীপ বেঙ্গসরকর ব্রাদার ইউনিয়ন ক্লাবে খেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দিলীপ বেঙ্গসরকারের অ্যাকাডেমির হয়ে ইংল্যান্ডেও গিয়েছে। মুম্বই ক্রিকেট সংস্থাও পাশে দাঁড়িয়েছে। ইন্ডিয়ান অয়েল সংস্থাও পাশে থেকেছে।'


ক্রিকেটের বাইরে আর কী করতে পছন্দ করেন যশস্বী? জ্বালা বলছেন, 'ক্রিকেট ওর প্রাণ। মাঠই ওর জীবন। খুব যে সিনেমা দেখে বা বই পড়ে তা নয়। ট্যুর থেকে ফিরলে সারারাত আড্ডা মেরেছি। ও চা বানাত সকলের জন্য। আমার পাও টিপে দিয়েছে। ভীষণ শ্রদ্ধা করে।' ইডেনে ছাত্রের ব্যাটিং ঝড় দেখে খুশি ছোটবেলার কোচ। জ্বালা বলছেন, 'আমি খুব খুশি। কোচ হিসাবে, ওর বাবা হিসাবে। হ্যাঁ, আমি ওকে নিজের ছেলেই মনে করি।'


মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি। কেকেআরের বিরুদ্ধে রেকর্ড হাফসেঞ্চুরি। এবারের আইপিএলে তো নবজন্ম হয়েছে ছাত্রের? জ্বালা বলছেন, 'এবারের আইপিএলে নিজের সেরা ছন্দে রয়েছে ও। ভয়ডরহীন ব্যাটিং করছে। ওর চোখ দেখে বুঝতে পারছি। জানে কোন বল কোথায় মারতে হবে। ওর জাজমেন্ট দুর্দান্ত। সেই জন্যই রান পাচ্ছে।'


সামনে দেড়শো রানের লক্ষ্য। অনেকে ওপেনারই হয়তো এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি না নিয়ে ব্যাটিং করতে চাইত। কিন্তু প্রথম বল থেকে আক্রমণের রাস্তা বেছে নেন যশস্বী। নীতীশের প্রথম ওভারে ২৬ রান নিয়ে কেকেআরের মনোবল দুমড়ে দেন। জ্বালা বলছেন, 'ওকে সব সময় বলতাম, প্রথম ওভার আর প্রথম বল থেকে প্রতিপক্ষ বোলিংকে আক্রমণ করতে হবে। প্রথম ওভারই বিপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করার সেরা সময়। রাজস্থান রয়্যালসের কোচিং স্টাফ ওর পাশে আছে। ওকে খোলা মনে ব্যাটিং করার স্বাধীনতা দিয়েছে। আউট হওয়ার ভয় পায় না। টিম ম্যানেজমেন্টের সেই আস্থা ওকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।'


ইডেনের ইনিংসের পর ছাত্রের সঙ্গে কথা হয়েছে? জ্বালা বলছেন, 'হয়েছে। তবে টুর্নামেন্ট চলাকালীন খুব বেশি কথা বলি না। কুমার সঙ্গকারার মতো কিংবদন্তি রাজস্থানের কোচ। তাই আমি বাইরে থেকে বেশি কথা বলতে চাই না। শুধু বলেছিলাম, এটা তোমার চতুর্থ আইপিএল। তুমি নতুন নও। আরও ভাল খেলতে হবে।'


ছাত্রের ব্যাটে যেন নিজের অপূর্ণ স্বপ্নকে বাস্তব রূপ পেতে দেখছেন জ্বালা।



আরও পড়ুন: ১৩ বলে ৫০! আইপিএলে রেকর্ড যশস্বীর, অল্পের জন্য রক্ষা পেল যুবরাজের কীর্তি