কোচি: জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হাজার ৩৪ মানুষের বন্যায় একটাই রঙ দেখা যাচ্ছিল রবিবার, হলুদ। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও যে কয়েকশো মানুষ সাদা-সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে এটিকে মোহনবাগানের হয়ে গলা ফাটাতে এসেছিলেন, তা বোঝা গেল ম্যাচের একেবারে শেষে, যখন অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার দিমিত্রিয়স পেট্রাটস তাঁর হ্যাটট্রিকটি পূর্ণ করে ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ৫-২-এ জয় ছিনিয়ে নিলেন।   


কেরালা ব্লাস্টার্সের ঘরের মাঠে নেমে তাদের হারিয়ে আসা যে কতটা কঠিন, তা ন’দিন আগেই টের পেয়েছিল কলকাতার আরেক দল ইস্টবেঙ্গল এফসি। একেই এগারো জন দুর্ধর্ষ ফুটবলারের মুখোমুখি হওয়া, তার ওপর গ্যালারিতে হাজার হাজার সমর্থকের উল্লাস ও চিৎকার। এই দুইয়ের বিরুদ্ধে খেলেও যে তাদের বিরুদ্ধে দাপুটে জয় পাওয়া যায়, তা রবিবার দেখিয়ে দিল গত হিরো আইএসএলের সেমিফাইনালিস্ট এটিকে মোহনবাগান।


এ দিন শুরু থেকেই এটিকে মোহনবাগানকে অপ্রত্যাশিত রকমের চাপে ফেলে দেয় কেরালা ব্লাস্টার্স এবং ছ’মিনিটের মধ্যে গোলও পেয়ে যায় তারা। সাধারণত শুরু থেকে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলা সবুজ-মেরুন শিবিরকে সেই সুযোগ না দিতেই তারা শুরু থেকে আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং তার ফলও পায় ব্লাস্টার্স। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে যে ছবিটা পুরো উল্টে দিয়ে শেষ হাসি হাসবে তাদের প্রতিপক্ষ, তা বোধহয় কেউই ভাবতে পারেনি।


গত ম্যাচে জোড়া গোলের নায়ক ইউক্রেনের ইভান কালিউঝনির গোলেই এগিয়ে যায় ব্লাস্টার্স। ডানদিক দিয়ে ওঠা সহাল আব্দুল সামাদের নিখুঁত ক্রস পেয়ে গোলের সামনে তা আলতো টোকায় গোল করে দেন ইভান (১-০)। শুরু থেকেই প্রচন্ড চাপে থাকা সবুজ-মেরুন রক্ষণকে এই আকস্মিক আক্রমণে প্রায় আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়।


তবে শুরুতে গোল খেয়ে ভেঙে পড়েনি সবুজ-মেরুন বাহিনী। পাল্টা আক্রমণে উঠতে থাকে তারা। রক্ষণও ততক্ষণে অনেকটা গোছাতে শুরু করে দেয়। ৯ মিনিটের মাথাতেই গোল শোধ করার সুবর্ণ সুযোগ পায় তারা। হুগো বুমৌস বিপক্ষের বক্সের ডান দিক থেকে বল বাড়ালে, তা ট্যাপ করে গোলে পাঠান পেট্রাটস। কিন্তু ততক্ষণে কোনও অজানা কারণে সহকারী রেফারি ফ্ল্যাগ তুলে অফসাইডের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।


গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালিয়ে যান বুমৌসরা। ১৫ মিনিটের মাথায় আশিস রাই একটি লং বল পাঠান বিপক্ষের বক্সে থাকা কাউকোর উদ্দেশ্যে। তাঁর গোলমুখী হেড সোজা গোলকিপার প্রভসুখন গিলের হাতে জমা হয়ে যায়।


চেষ্টা চালাতে থাকা মনবীররা ২৬ মিনিটের মাথায় সমতা এনে ফেলেন। এ বারও সেই বুমৌসের পাস থেকেই গোল হয় এবং তা পেয়ে যান দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। বাঁদিকের উইং দিয়ে বল নিয়ে উঠে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েন বুমৌস এবং নিখুঁত ক্রস দেন ‘দিমি’-কে। হরমিপাম রুইভা তাঁকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। নিখুঁত শটে জালে বল জড়াতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড (১-১)।


স্কোর ১-১ হয়ে যাওয়ার পরে ফের নড়েচড়ে বসে হলুদ-বাহিনী। ‘মানিয়াপ্পড়া’-সহ কেরলের ফুটবলপ্রমীদের একাধিক ঝাঁক গ্যালারি থেকে ঢাক-ঢোল-কাঁসর নিয়ে তাদের সঙ্গ দিতে শুরু করে। ৩২ মিনিটের মাথায় কর্নার থেকে হেডে গোল করার দুরন্ত সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেন জিকসন সিং। সহাল ও ইভান কালিউঝনি মাঝখান দিয়ে ঘন ঘন আক্রমণে উঠে বিপক্ষের রক্ষণে ত্রাস সৃষ্টি করার চেষ্টা শুরু করেন।


কিন্তু ততক্ষণে নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরুর করেছেন প্রীতম কোটাল, ব্রেন্ডান হ্যামিলরা। ব্লাস্টার্সের ঘন ঘন আক্রমণ আটকে দিচ্ছিলেন তাঁরা। শুধু রক্ষণ নয়, আক্রমণেও আরও আগ্রাসী ও শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে ওঠে কলকাতার দল। ব্লাস্টার্সের রক্ষণের দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে প্রতি আক্রমণ থেকে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে শুরু করে তারা।


ডান উইং দিয়ে ওঠা মনবীর সিং যে অনবদ্য গোলটি তৈরি করে দেন জনি কাউকো-কে, সেই গোলেই ৩৮ মিনিটের মাথায় এগিয়ে যায় এটিকে মোহনবাগান। ডান উইং থেকে বক্সের মধ্যে কোণাকুনি পাসে বল বাড়িয়ে দেন মনবীর এবং কাউকো ঠিক সেই দিকেই এগোচ্ছিলেন। নিখুঁত টাইমিংয়ের ফলে একেবারে সঠিক জায়গায় বল পেয়ে যান তিনি এবং সোজা গোলে শট নেন, যা আটকানো সম্ভব হয়নি গিলের পক্ষে (১-২)।


প্রথমার্ধের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে আদ্রিয়ান লুনা দূরপাল্লার শট আটকে দেন সবুজ-মেরুন গোলকিপার বিশাল। সহাল-ইভান জুটি মাঝখান দিয়ে আক্রমণে ব্যর্থ হওয়ায় দুই উইং দিয়ে আক্রমণকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে তারা। কিন্তু তাও অবরুদ্ধ করে দেন প্রীতমরা।


প্রথম ৪৫ মিনিটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বল দখলের পরিসংখ্যান ৫০-৫০ থাকার পরে যখন দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হয়, তখনও ব্লাস্টার্স সমর্থকদের শব্দব্রহ্ম এতটুকু কমেনি। হলুদ জার্সিধারীদের পায়ে বল পড়লেই তাদের আওয়াজ প্রায় আকাশ ছুঁতে চাইছিল। তাতেও অবশ্য দমানো যায়নি বুমৌস, কাউকো, পেট্রাটস, মনবীর, কোলাসোদের।   


এক গোলে এগিয়ে থাকা দলের রক্ষণকে আরও আঁটোসাঁটো করতে আশিককে তুলে নিয়ে শুভাশিস বোসকে নামান ফেরান্দো। বার্তাটা ছিল খুবই স্পষ্ট, আর গোল খাওয়া চলবে না। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই নিজেদের গোলের সামনে পাহাড়া দেওয়া শুরু করেন। ফলে সাহাল, ইভানরা বক্সের মধ্যে ঢুকতে না পেরে দূরপাল্লার শটে গোলের চেষ্টা শুরু করেন।


৫৯ মিনিটের মাথায় যে ঘটনা ঘটে, তাকে অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। এ জন্য গোলকিপার বিশালকেও কৃতিত্ব দিতে হবে অনেকটাই। জেসেল কার্নেইরোর ক্রস হ্যামিল বারের ওপর দিয়ে ক্লিয়ার করতে যওয়ায় যখন তা নিজ গোল না হয়ে বারে লেগে ফিরে আসে, তখন গোললাইনের ছ’গজ দূর থেকে নেওয়া লুনার জোরালো হেড আটকে দেন বিশাল। সেই বল শেষ পর্যন্ত বক্সের ডানদিকে ইভান পেয়েও তা গোলে রাখতে পারেননি।


এই অনবদ্য সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে না পারায় কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়ে ব্লাস্টার্স। তাদের রক্ষণেও ফাটল দেখা যায়। ফলে তৃতীয় গোলটি খেয়ে যায় তারা। পিছন থেকে বুমৌসের পাসে পাওয়া বল নিয়ে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েন কোলাসো এবং তা নিখুঁত ভাবে গোলের সামনে পেট্রাটসকে প্রায় সাজিয়ে দেন তিনি। এ বারও ভুল করেননি পেট্রাটস (১-৩)।


ব্লাস্টার্সের ঘরের মাঠে ৩-১ করে ফেলার পরে আর বেশি ঝুঁকি নেননি এটিকে মোহনবাগান কোচ। এমনিতেই দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে নামিয়েছিলেন শুভাশিসকে। ৬৪ মিনিটের মাথায় দীপক টাঙরির জায়গায় নামান লেনি রড্রিগেজকে এবং ৭১ মিনিটে ফ্লোরেন্তিন পোগবা নামেন হুগো বুমৌসের জায়গায়। ফলে শেষ ২০ মিনিট নিজেদের গোলের সামনে প্রায় দেওয়াল তুলে দেয় সবুজ-মেরুন ব্রিগেড।


রক্ষণ আঁটোসাঁটো করার চেষ্টা করলেও সেই রক্ষণের ফাঁক দিয়েই দ্বিতীয় গোল করে ফেলে ব্লাস্টার্স। তবে যিনি এতক্ষণ ধরে দলকে তাঁর অসাধারণ দক্ষতায় বাঁচিয়ে এসেছেন, সেই গোলকিপার বিশাল কয়েথের ভুলেই কেপি রাহুলের দূরপাল্লার শট গোলে ঢুকে যায়। বাঁ দিক দিয়ে ওঠা রাহুলের দূরপাল্লার শট বিশালের হাত ও পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে ঢুকে যায় গোলে (২-৩)।


দ্বিতীয় গোল পেয়ে আক্রমণের ধার বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন কেরলের দলের ফুটবলাররা। কিন্তু সমতা আনার জন্য মরিয়া ব্লাস্টার্স অল আউট হতে গিয়ে নিজেদের রক্ষণকে কার্যত পাহাড়াহীন করে তোলে। এই সুযোগই কাজে লাগিয়ে পরপর দু’টি গোল করে জয় সুনিশ্চিত করে ফেলে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড।


নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার দু’মিনিট আগে যখন মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে লেনি ও পেট্রাটস বল দেওয়া-নেওয়া করতে করতে দৌড়ে শুরু করেন প্রতিপক্ষের গোলের দিকে, তখন ব্লাস্টার্সের অর্ধে হাতে গোনা কয়েকজন ছিলেন। বক্সে ঢোকার আগে লেনিকে গোলের পাস বাড়ান পেট্রাটস এবং নিখুঁত টোকায় গোলকিপার গিলকে পরাস্ত করে জালে বল জড়িয়ে দেন লেনি (২-৪)।


গ্যালারিতে থাকা হাজার ৩৪ ব্লাস্টার্স সমর্থকের চিৎকার কার্যত থেমে যায় এই গোলের পর থেকেই। ছ’মিনিট বাড়তি সময় পাওয়ায় তাঁরা ফের আশাবাদী হয়ে উঠলেও সেই বাড়তি সময়কে কাজে লাগিয়ে নেয় এটিকে মোহনবাগানই। এ বার পেট্রাটসের হ্যাটট্রিক গোল। আগের গোলটি থেকেও শিক্ষা নিতে পারেনি হলুদ বাহিনী। ফের রক্ষণ প্রায় ফাঁকা রেখে গোল করতে ছুটে যায় তারা। এ বার লিস্টন ও পেট্রাটসের যুগলবন্দী।


মাঝমাঠ থেকে কোলাসোকে বল বাড়ান লেনি। সেই বল নিয়ে প্রায় বিনা বাধায় প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে লিস্টন ডানদিকে পেট্রাটসকে বল বাড়ান এবং তখন তাঁর সামনে ফাঁকা গোল ছাড়া আর কিছুই ছিল না (২-৫)। এই গোলের পরই প্রথমবারের জন্য গুটি কয়েক সবুজ-মেরুন সমর্থকের চিৎকার শোনা যায় কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে।


এটিকে মোহনবাগানের পরের ম্যাচই কলকাতা ডার্বি। তার ১৩ দিন আগে এই অসাধারণ জয়, তাদের যে কতটা অক্সিজেন জোগাল, তা ২৯ তারিখের মহাম্যাচেই বোঝা যাবে।