কলকাতা: তাঁকে ঈশ্বরজ্ঞান করে ক্রিকেট মাঠে কার্যত চষে বেড়ান ভক্ত। আদুর গায়ে তেরঙার প্রলেপ। প্রিয় নায়ককে দেখলেই স্লোগান, 'ভারত মাতা কী, জয়'।


তবু, চণ্ডীগড়ের রাম বাবু (Ram Babu) কোনওদিন কল্পনাও করেননি যে, টুর্নামেন্ট চলাকালীন তিনি যখন অসুস্থ, কার্যত মৃতপ্রায়, তখন ভক্তের ভগবান হিসাবে আবির্ভুত হবেন স্বয়ং নায়ক। প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে রণকৌশল সাজানোয় সাময়িক বিরতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন প্রাণরক্ষায়।


২০১৪ সালে বাংলাদেশের মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ঘটনা। তার আগে এশিয়া কাপে চোটের জন্য খেলেননি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি (MS Dhoni)। বিরাট কোহলি (Virat Kohli) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভারতকে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ধোনি অধিনায়ক হিসাবে ফেরেন। প্রিয় নায়ক তথা জাতীয় দলকে সমর্থন করতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন ধোনিভক্ত রামবাবুও। 'চণ্ডীগড় থেকে কলকাতা হয়ে বাসে ও স্টিমারে চেপে ঢাকায় পৌঁছেছিলাম। ধোনি স্যারই প্র্যাক্টিসের ফাঁকে ডেকে ম্যাচের টিকিট দিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচ দেখেছিলাম। তারপর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচ। তারপর অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা ছিল ভারতের। সব ম্যাচ দেখেছি। বুঝতেই পারিনি কখন শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে। ভীষণ জ্বর আসে। স্টেডিয়ামেই মাথা ঘুরে ২-৩ বার পড়ে যাই। টিম ইন্ডিয়ার ফিজিও নীতিন পটেল ওষুধ দেন। হাসপাতালে পরীক্ষা করাই। রিপোর্ট আশঙ্কাজনক ছিল,' মোবাইল ফোনে এবিপি লাইভকে ৮ বছর আগের গল্প শোনাচ্ছিলেন রাম বাবু।


কীভাবে জীবনরক্ষা হয়, সেটাও জানিয়েছেন তিনি। রাম বাবু বলেছেন, 'ধোনি স্যার জানতে পারেন যে, আমার শরীর খারাপ। ধোনি স্যার প্র্যাক্টিসের পরে আমাকে ডাকেন। সমস্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখেন। বলেন, এই শরীর নিয়ে ম্যাচ দেখছো কী কথা! আমি বলি, আর তো ২-৩তে ম্যাচ। আমরা চাই ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরব। পরের দিনই ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনাল। সেই ম্য়াচের টিকিটও ছিল। ধোনি স্যার বলেন, না রামবাবু, আগে শরীর। তুমি যদি বলো বাংলাদেশের হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি বলি, বাংলাদেশের ওষুধে আমার কাজ হচ্ছে না। ধোনি স্যার সন্ধ্যায় টিমহোটেলে যেতে বলেন।'


ভক্তের বিস্ময়ের তখনও বাকি ছিল। রামবাবুর কথায়, 'হোটেলে যেতেই ধোনি স্যার বলেন, আগে তোমার পাসপোর্ট দাও। আমি দিয়ে চলে আসি। পরে ভারতীয় দলের ম্যানেজার ফোন করে বলেন যে, ধোনি স্যার আমার জন্য বিমানের টিকিট কেটে দিয়েছেন। চণ্ডীগড়ের ফ্লাইট পরের দিনই। চণ্ডীগড়ে পৌঁছতেই চিকিৎসক দেখেই। বলেন, ধোনি স্যারকে ধন্যবাদ দিও, কারণ চিকিৎসা না হলে দুর্ঘটনা ঘটে যেত। তোমার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল।'


পরে ধোনির সঙ্গে দেখা করে প্রাণরক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ জানান রামবাবু। তাঁর কথায়, 'ধর্মশালায় ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচের সময় গিয়ে দেখা করি। ধন্যবাদ জানাই।' যোগ করছেন, '২০১৬ সালে এশিয়া কাপ দেখতে ফের বাংলাদেশে যাই। ধোনি স্যার দেখেই মজা করে বলেছিলেন, কীরে এবার আর কিছু হবে না তো! বলি না স্যার আমি ঠিক আছি। তারপর বাংলাদেশে এশিয়া কাপ জিতি। ধোনি স্যার বিমানের টিকিট থেকে শুরু করে হোটেল, সব ব্যবস্থা করে দিতেন।'


সেই ঘটনার পর রামবাবুর ধোনি-প্রেম আরও জমাট বেঁধেছে। বৃহস্পতিবার ৪১ বছর পূর্ণ করলেন ভারতের কিংবদন্তি অধিনায়ক। অন্যান্য বছর এই দিনে রাঁচিতে ধোনির বাড়িতে ফুল, কেক, মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়ে যান। এবার ধোনি লন্ডনে। তাই রামবাবু প্রিয় নায়কের জন্মদিন উদযাপন করছেন হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশের সীমান্তে রামপুরা গ্রামে। ধোনিভক্ত কিছু দুঃস্থ বাচ্চাদের সঙ্গে জন্মদিন পালন করছেন। রামবাবু বলছেন, 'গতবারও এখানে এসেছিলাম। ধোনি স্যার লন্ডনে। তাই রাঁচি যেতে পারিনি। এখানেই কেক কেটেছি, ধোনি স্যারের ছবি নিয়ে এলাকায় পদযাত্রা হয়েছে। সকলকে উপহার দেওয়া হয়েছে। বিলি করা হয়েছে মিষ্টি।'


ধোনির সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ কবে? রামবাবু বলছেন, 'আইপিএল থেকে চেন্নাই সুপার কিংস ছিটকে যাওয়ার পর শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল মুম্বইয়ের ট্রাইডেন্ট হোটেলে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম। বলেছিলেন, রাঁচির বাড়িতে এসো।আইপিএলের সময় ২ মাস মুম্বইয়ে ছিলাম। সিএসকে-র সব ম্যাচ দেখেছি।' রামবাবু যোগ করছেন, 'ভক্ত হিসাবে আমি চাই ধোনি স্যার আরও খেলুক। দীপক চাহারের ছিটকে যাওয়া, সুরেশ রায়নার না থাকা, নতুন দল, ধোনি স্যারের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া, সব মিলিয়ে আইপিএলে সিএসকে-র মরসুমটা ভাল যায়নি। তবে রবীন্দ্র জাডেজার হাত ঘুরে ফের ধোনি স্যারের হাতেই নেতৃত্ব। আমরা চাই উনি খেলা চালিয়ে যান।'


১৬ বছর হয়ে গেল ধোনিকে অনুসরণ করছেন রামবাবু। বলছেন, 'প্রথমে টিভিতে ওঁর খেলা দেখেছিলাম। মনে আছে, বাংলাদেশে  অভিষেক সিরিজে ধোনি স্যারের লম্বা চুল দেখে ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে ভাল লাগে। আমিও লম্বা চুল রেখেছিলাম। প্রথম ম্যাচে কোনও রান করার আগেই রান আউট হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর দেশের মাটিতে ২০০৭ সাল থেকে দিল্লি, মুম্বইয়ে, মোহালিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে, পরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশাখাপত্তনমে ধোনি স্যারের ম্যাচ মাঠে গিয়ে দেখি। ভারতে সব মাঠে হাজির হয়ে যেতাম। শুরুর দিকে দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হতো না। পরে এশিয়া জুড়ে সমস্ত ম্যাচ দেখেছি।'


ধোনির জন্মদিনে সুপারফ্যান বলছেন, 'কোনওদিনও বিরক্ত করিনি। শুধু সমর্থন করে গিয়েছি। দল প্র্যাক্টিসে যাওয়ার আগে মাঠে পৌঁছে যাই। দুশোর ওপর ওয়ান ডে ম্যাচ দেখেছি। ৩০-৪০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ৩০-এর ওপর টেস্ট দেখেছি। সঙ্গে আইপিএল। এশিয়ার মাটিতে কোনও ম্যাচ ছাড়িনি। ধোনি স্যারকে আমৃত্য সমর্থন করে যাব।'


আরও পড়ুন: লন্ডনে প্রি বার্থ ডে পার্টিতে সানাকে কেক খাইয়ে দিলেন সৌরভ, হাজির সস্ত্রীক সচিনও