কলকাতা: ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (ISL) টেবলের তিন নম্বর থেকে শীর্ষে পৌঁছনোর সুযোগ এসেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের (MBSG) সামনে। যে শীর্ষস্থানে গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে রয়েছে ওড়িশা এফসির দখলে। সেই শীর্ষস্থান থেকে তাদের সরিয়ে দিতে গেলে শনিবার তাদেরই মাঠে তাদেরই হারাতে হবে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে। একই সঙ্গে টপকাতে হবে শুক্রবার চেন্নাইন এফসি-কে হারিয়ে দু’নম্বরে ওঠা মুম্বই সিটি এফসি-কেও।


টানা এগারোটি ম্যাচে অপরাজিত ওড়িশা এফসি। সেই ২৭ অক্টোবর কেরল ব্লাস্টার্সের কাছে ১-২-এ হেরেছিল তারা। তারপর থেকে আর কোনও ম্যাচে কেউ হারাতে পারেনি কলিঙ্গবাহিনীকে। এর মধ্যে তিনটি ম্যাচে তারা ড্র করেছে ঠিকই। কিন্তু হার মানেননি রয় কৃষ্ণা, দিয়েগো মরিসিও, আহমেদ জাহু, মুর্তাদা ফলরা। আবার এটাও ঠিক, যে তিনটি ম্যাচে তারা ড্র করে, তাদের মধ্যে একটি ম্যাচ ছিল এই মোহনবাগানেরই বিরুদ্ধে।


সেই ম্যাচে ওড়িশা এফসি-র মুখের গ্রাস কার্যত ছিনিয়ে নিয়ে ২-২ ড্র করে সবুজ-মেরুন শিবির। প্রথমার্ধে দু’গোলে এগিয়ে থাকা ওড়িশা তিন পয়েন্ট হাতছাড়া করে আরমান্দো সাদিকুর জোড়া গোলে। যে ম্যাচে ৩৫ বার ফাউলের বাঁশি বাজাতে হয় ও আটবার হলুদ কার্ড বার করতে হয় রেফারিকে, সেই ম্যাচে চোট পেয়ে বিরতির পর আর খেলতে পারেননি সবুজ-মেরুন শিবিরের দুই নির্ভরযোগ্য তারকা সহাল আব্দুল সামাদ ও অনিরুদ্ধ থাপা। 


ম্যাচের আগেই ওয়ার্ম-আপ করার সময় হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পান হুগো বুমৌস। থাপার জায়গায় নামা গ্ল্যান মার্টিন্সও চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের সেই ম্যাচ থেকেই মোহনবাগানের দুঃসময় শুরু হয়েছিল, যার পরিণতিতে বছরের শেষে টানা তিনটি ম্যাচে হারে তারা। ঘটনাবহুল সেই ম্যাচের পর বিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ে লাল কার্ড দেখতে হয় কোচ হুয়ান ফেরান্দোকেও। উত্তেজনার পারদ এতটাই চরমে উঠেছিল যে ওই ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে লাল কার্ড দেখতে হয় ওড়িশার ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড দিয়েগো মরিসিওকেও।


প্রথমার্ধে ৩১ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে ও স্টপেজ টাইমের তৃতীয় মিনিটে গোল করে ওড়িশাকে এগিয়ে দেন মরক্কোর মিডফিল্ডার আহমেদ জাহু। বিরতির পর ৫৮ মিনিটের মাথায় ও ইনজুরি টাইমের চতুর্থ মিনিটে দুটি গোলই শোধ করে দেন আলবানিয়ান ফরোয়ার্ড সাদিকু। শেষ পর্যন্ত না হারার মানসিকতাই এ দিন তাদের এক পয়েন্ট এনে দেয়। 


শনিবারও নিশ্চয়ই সেই কঠোর মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামবে গতবারের কাপ চ্যাম্পিয়নরা। গত ম্যাচে প্রথম দলের পাঁচজন খেলোয়াড়কে ছাড়াই মাঠে নেমেছিল। এই ম্যাচে মোহনবাগান শিবির কিন্তু অতটা দুর্বল নয়। তাদের পুরো দলই তৈরি ওড়িশার এগারো ম্যাচের অপরাজিত দৌড়ে থামাতে। 


কলকাতা ডার্বির পর সাতদিনের ব্যবধানে তিনটি ম্যাচ খেলতে হয় মোহনবাগানকে। সে জন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেককে খেলান হাবাস। শেষ দুটি ম্যাচেই চার-পাঁচটি করে পরিবর্তন করে প্রথম এগারো সাজান তিনি। এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে চারটি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামিয়েছিলেন। নর্থইস্টের বিরুদ্ধে চারটি পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামান হাবাস। জনি কাউকো, অভিষেক সূর্যবংশী, লিস্টন কোলাসো ও জেসন কামিংসকে শুরু থেকে খেলান আরমান্দো সাদিকু, অনিরুদ্ধ থাপা, আশিস রাই ও দীপক টাঙরির জায়গায়।


ওড়িশার বিরুদ্ধে হয়তো তাঁদের অনেকেই দলে ফিরবেন। নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি-কে যারা ওড়িশা এফসি-র মতো শক্তিশালী নয় বলছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই গত বুধবার এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে তাদের জয়ের খবর জানেন। সেই নর্থইস্টকে ৪-২ গোলে হারিয়েছিল যারা সেই মোহনবাগান এসজি যে ওড়িশার কাছেও মোটেই সোজা প্রতিপক্ষ হবে না, তা এক কথায় স্বীকার করে নিয়েছেন রয় কৃষ্ণাদের কোচ লোবেরা, যিনি এসে দলটারই চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। 


এই ওড়িশা এফসি-ই তাদের চতুর্থ ম্যাচের পর (ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে) লিগ টেবলের আট নম্বরে নেমে গিয়েছিল। তার পর থেকে চলতি লিগে তারা অপরাজিত রয়েছে। গত এগারোটি ম্যাচে তারা ক্রমশ লিগ টেবলে ওপর দিকে উঠেছে। বেঙ্গালুরু এফসি-কে ঘরের মাঠে হারিয়ে তারা প্রথমে সেরা ছয়ে প্রবেশ করে। জামশেদপুরে গিয়ে জিতে তারা চার নম্বরে উঠে আসে। তবে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ড্র তাদের ফের একধাপ নীচে (৫) নামিয়ে দেয়। 


পাঞ্জাব এফসি-কে হারিয়ে তারা ফের চারে উঠে আসে এবং জামশেদপুরকে হোম ম্যাচে হারিয়ে উঠে আসে তিনে। ঘরের মাঠে ব্লাস্টার্সকে হারিয়ে ওড়িশা উঠে আসে দুইয়ে এবং চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে হায়দরাবাদকে তাদের মাঠে তিন গোলে হারিয়ে উঠে আসে শীর্ষে। ফলে গত ম্যাচে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ড্র হলেও শীর্ষেই থেকে যায় তারা। এমনই রোমাঞ্চকর তাদের চলতি লিগের অভিযান। 


দুর্দান্ত ফর্মে আছেন ফিজিয়ান তারকা স্ট্রাইকার রয় কৃষ্ণা। ১৫টি ম্যাচ খেলে ১১টি গোল করেছেন তিনি। লিগের শুরুর দিকে টানা গোল পাওয়া ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড দিয়েগো মরিসিও ছ’টি গোল করেছেন। মরিসিও ক্রমশ কিছুটা ফিকে হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় রয় কৃষ্ণার রাজত্ব। প্রথম ছ’টি ম্যাচে মাত্র একটি গোল পাওয়ার পরে ফর্মে ফেরেন তিনি এবং ওড়িশার গত ন’টি ম্যাচের মধ্যে সাতটিতেই গোল পেয়েছেন মোহনবাগানের এই প্রাক্তনী। ব্লাস্টার্স, জামশেদপুর ও হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে জোড়া গোলও করেন। 


দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (৬), জেসন কামিংস (৬) ও আরমান্দো সাদিকু (৪) তাদের মোট গোলের অর্ধেকের বেশি করলেও সবুজ-মেরুন শিবিরে আরও দশজন স্কোরার আছে। তবে অ্যাসিস্টের দিক থেকে এগিয়ে আছেন অনেকেই। সহাল আব্দুল সামাদ ইতিমধ্যেই চারটি গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন। মনবীর, লিস্টন কোলাসোরা তিনটি করে অ্যাসিস্ট করেছেন। গত ম্যাচে একাই তিনটি গোলে অ্যাসিস্ট করেন জনি কাউকো। কোনও পক্ষেরই গোল করার লোকের অভাব নেই।  


রক্ষণেও দুই দলই যথেষ্ট শক্তিশালী। এ পর্যন্ত যেখানে ১৫ ম্যাচে ১৪ গোল খেয়েছে ওড়িশা, সেখানে মোহনবাগান ১৪ ম্যাচে ১৮ গোল খেয়েছে। কলিঙ্গবাহিনী যেখানে সাতটি ম্যাচে ক্লিন শিট বজায় রাখতে পেরেছে, সেখানে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড চারটির বেশি ক্লিন শিট রাখতে পারেনি। সে দিক থেকে দেখতে গেলে কার্লোস দেলগাদো, অময় রানাওডে, জেরি লালরিনজুয়ালা, নরেন্দর গেহলট, মুর্তাদা ফলদের রক্ষণ শুভাশিস বোস, ব্রেন্ডান হ্যামিল, হেক্টর ইউস্তে, আশিস রাই-দের রক্ষণের চেয়ে এগিয়ে। 


শনিবারের ম্যাচে কার্ড সমস্যার জন্য খেলতে পারবেন না লোবেরার মাঝমাঠে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তারকা আহমেদ জাহু, যা মোহনবাগান সমর্থকদের পক্ষে ভাল খবর হতে পারে। তবে জাহুর জায়গায় লেনি রড্রিগেজকে তাঁর ১৫০ তম আইএসএল ম্যাচে শুরু থেকে নামাতে পারেন ওড়িশার কোচ। এ ছাড়াও তাঁর হাতে এই জায়গায় খেলার জন্য প্রিন্সটন রেবেলো রয়েছেন।  


ইন্ডিয়ান সুপার লিগে আজ পর্যন্ত ওড়িশা এফসি কোনও ম্যাচে মোহনবাগানকে হারাতে পারেনি। তবে চলতি মরশুমে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছে তারা। গত ১১টি ম্যাচে অপরাজিত রয়েছে তারা। এর মধ্যে আটটি জয় ও তিনটি ড্র রয়েছে। একটানা এতগুলি ম্যাচে অপরাজিত থাকার নজির আগে ছিল না কলিঙ্গবাহিনীর। চলতি লিগে এই অপরাজিত দৌড়ই দীর্ঘতম। তিনটি ড্রয়ের মধ্যে অবশ্য দু’টিই তারা করেছে কলকাতার দলের বিরুদ্ধে (২-২ বনাম বাগান, ০-০ বনাম ইস্টবেঙ্গল)। প্রথমার্ধের শেষ ১৫ মিনিটে এ পর্যন্ত মোট ১২ গোল করেছে ওড়িশা এফসি, যা এই মরশুমে সর্বোচ্চ। এই সময়ে মাত্র একটি গোল খেয়েছে তারা, যা চলতি লিগে সবচেয়ে কম। 


আইএসএলে আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের বিরুদ্ধে সের্খিও লোবেরার সাফল্যের শতকরা হার ৮০ শতাংশ। দুই কোচের দল পাঁচটি আইএসএল ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে। লোবেরার দল জিতেছে চারটিতে, হাবাসের দল জিতেছে একটিতে। দুই কোচের শেষ তিন মুখোমুখিতে লোবেরা তিনবারই জয়ের হাসি হেসেছেন।    


চলতি মরশুমে অ্যাওয়ে ম্যাচ থেকে যত পয়েন্ট অর্জন করেছে মোহনবাগান, তার চেয়ে কম পয়েন্ট (১৩) তারা গত মরশুমে বাইরের ম্যাচগুলি থেকে অর্জন করেছিল। প্রথমার্ধের শেষ ১৫ মিনিটে এ পর্যন্ত মোট ৬ গোল করেছে মোহনবাগান এসজি, যা ওড়িশার এই পরিসংখ্যানের অর্ধেক। ৮৬ শতাংশ গোল তারা করেছে ওপেন প্লে থেকে, যা চলতি লিগে সর্বোচ্চ। ২৮টির মধ্যে ২৪টি এসেছে ওপেন প্লে থেকে। 


ইন্ডিয়ান সুপার লিগের পরিসংখ্যান এগিয়ে রেখেছে মোহনবাগান-কেই। চার মরশুমে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে মোট আটবার। তার মধ্যে চারবার জিতেছে কলকাতার দল। বাকি চারটিতে ড্র হয়। অর্থাৎ, ওড়িশা এফসি এখন অবধি আইএসএলে মোহনবাগানকে হারাতে পারেনি। ২০২০-২১ মরশুমে দু’বারই মোহনবাগান জেতে যথাক্রমে ১-০ ও ৪-১-এ। ২০২১-২২ মরশুমে দু’বারই ড্র হয়। প্রথম ম্যাচ গোলশূন্য ও দ্বিতীয় ম্যাচে ১-১ ফল হয়। ২০২২-২৩-এর প্রথম মুখোমুখিও গোলশূন্য ছিল। দ্বিতীয় লেগে মোহনবাগান জেতে ২-০-য় এবং প্লে অফেও তারা ওড়িশা এফসি-কে একই ফলে হারায়। চলতি মরশুমের প্রথম দ্বৈরথে ফল হয় ২-২। দুই দলের মুখোমুখিতে এ পর্যন্ত ১৬টি গোল হয়েছে। যার মধ্যে ১২টি দিয়েছে মোহনবাগান ও চারটি দিয়েছে ওড়িশা এফসি।  


(সৌজন্য: ISL Media)


আরও পড়ুন: বল হাতে যেন বুলেট! আকাশ দীপকে দলে নিতে জরুরি বৈঠক হয়েছিল সৌরভের সঙ্গে


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।