টোকিও: আজকের যুগে বছরের ৩৬৫ দিনই প্রায় পৃথক পৃথক করে বিশেষ দিন হিসেবে পালন করার একটা প্রচলন হয়েছে। কোনও একটা দিন বিশ্ব মাতৃদিবস, কোনও একটা দিন হয়তো বা নারী দিবস। এরকম কত দিবস। এগুলি ভাল, বিষয়গুলি নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার হয়। কিন্তু নারী বা মেয়েদের নিয়ে প্রচারের জন্য বোধহয় ২০২১-এ এসে একটা নামই যথেষ্ট। নামটা Nino Salukvadze বা নিনো সালুকভাজে। জানি না, চিনতে পারলেন কিনা। তবে, এই ভদ্রমহিলা সম্পর্কে খানিকটা জানলেই আপনি যদি মহিলা হন তাহলে নিজেদের ক্ষমতার প্রতি আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। আর যদি পুরুষ হন, তাহলে নারীদের ক্ষমতার প্রতি আপনার আস্থা বাড়বে।


নিনো সালুকভাজের বয়স এখন ৫৩ বছর। তাহলে এরকম একজন মানুষকে নিয়ে কেন বলছি এমন কথা? কারণ, ২০২১-এর টোকিও অলিম্পিক্সের কথা ধরলে, তিনি টানা ৯টি অলিম্পিক্সের আসরে নামলেন! হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন নিনো ছাড়া এই পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনও মহিলাই এই কাজটি করতে পারেননি। একবার ভাবার চেষ্টা করুন, একজন খেলোয়াড়ের চোখে স্বপ্ন থাকে যে তিনি দেশের হয়ে অলিম্পিক্সে প্রতিনিধিত্ব করবেন। কিন্তু তা বলে কতবার? একবার? দু'বার? তিনবার? তা বলে ৯ বার! এরকম একটা অসাধ্য বা কল্পনাতেও আসে না, এমন কাজ করে ফেললেন নিনো।


১৯৮৮ সালে সোল অলিম্পিক্স দিয়ে শুরু করেছিলেন। তারপর একে একে ১৯৯২ তে বার্সেলোনা অলিম্পিক্স, ১৯৯৬-তে আটলান্টা অলিম্পিক্স, ২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিক্স, ২০০৪ সালে এথেন্স অলিম্পিক্স, ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিক্স, ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক্স, ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিক্সের পর ২০২০-তেও নয়। অতিমারীর কারণে এক বছর পিছিয়ে যাওয়া ২০২১-এর টোকিও অলিম্পিক্সেও অংশগ্রহণ করলেন নিনো। তিনি কিংবদন্তী না হলে, অনুপ্রেরণা না হলে আর কে হবেন!




১৯৮৮ সালের সোল অলিম্পিক্সে যখন অংশ নিয়েছিলেন নিনো, তখন তিনি ছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক। প্রথম অলিম্পিক্সে মোটেই খালি হাতে ফেরেননি। ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্ট থেকে জিতেছিলেন সোনা। শুধু তাই নয়। ২৫ মিটার স্পোর্টিং পিস্তল ইভেন্টেও জিতেছিলেন রুপো। অর্থাৎ, প্রথম অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ করেই দুটো পদক জিতে ফিরেছিলেন দেশে। এরপর অবশ্য তাঁকে পদকের জন্য বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষার অবসান হয় ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক্সে। ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে সেবার ব্রোঞ্জ পদক জেতেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে অবশ্য অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে জর্জিয়ার জীবনে। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভেঙে যায়। তাই ২০০৮-এ বেজিং অলিম্পিক্সে তিনি পদক জেতেন জর্জিয়ার একজন খেলোয়াড় হিসেবে।


২০০৮-এর ৮ বছর পর অর্থাৎ ২০১৬-তে আবারও ইতিহাস গড়লেন নিনো। রিও অলিম্পিক্সে এসে। পদক জিতে নয়। বরং এমন এক বিষয়ে গোটা পৃথিবীতে ইতিহাস গড়লেন, যে ইতিহাস মুছে দিয়ে নতুন ইতিহাস লেখা বোধহয় প্রায় অসম্ভব কাজ। কারণ, রিও অলিম্পিক্সে আর একা নিনো প্রতিনিধিত্ব করেননি জর্জিয়ার অলিম্পিক্স দলের, তাঁর সঙ্গে রিও অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ করলেন তাঁর ছেলে তোতনে ম্যাকাভারানি। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার দেখা গেল অলিম্পিক্সের আসরে একইসঙ্গে পদক জেতার জন্য লড়াই করছেন মা ও ছেলে। সেবার অবশ্য অলিম্পিক্স থেকে পদক জেতা হয়নি নিনোদের। তবে তাঁর আগে মা ও ছেলে মিলে বেশ কিছু পদক জিতেছিলেন বলেই না পেয়েছিলেন রিও অলিম্পিক্সের ছাড়পত্র।


এবার টোকিও অলিম্পিক্সেও যোগ দিয়েছেন নিনো। সবারই এক প্রশ্ন, ৯ টি অলিম্পিক্স টানা! প্রায় ৩৭ বছর ধরে একটানা শুটিংয়ের মতো কঠিন ইভেন্টে কীভাবে অংশ নিচ্ছেন তিনি? কখনও কখনও পদকও জিতছেন। রহস্যটা কী? এসব প্রশ্ন শুনে নিনো মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলছেন, 'ছোটবেলায় বাবা যখন অন্যদের শুটিং প্র্যাকটিস করাত, আমি কাছে যেতাম। বলত, এসব ছেলেদের খেলা। মেয়েদের নয়। তুমি অন্য কিছু খেলো। আমি বন্দুক-পিস্তলে হাত দিয়ে বুঝলাম, আসলে বিষয়টা অন্যরকম। শুটিং ছেলেদের বা মেয়েদের খেলা নয়। এটা কোনও অস্ত্রের খেলাও নয়। এটা একেবারে একটা মাইন্ড গেম বা মনস্তত্ত্বের খেলা। তাই শুটিংকে আঁকড়ে ধরলাম। আর জিততে থাকলাম। সবকিছুর অনুভূতি তো কথায় বলে প্রকাশ করা যায় না। কিছু অনুভূতি শুধুই অনুভব করারও। যেমন আমরা সন্তানের জন্ম দিয়ে করে থাকি। অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ করাটাও তেমন বিষয়। এই তো গত একমাস আমি রোজ স্বপ্ন দেখেছি যে, আমি টোকিও অলিম্পিক্সে ভাল পারফর্ম করছি। ব্যস, এইভাবেই তৈরি করি নিজেকে।'  


আপনি কি তাহলে পরের ২০২৪ অলিম্পিক্সেও যোগ দেবেন? নিনো লাজুক হাসি হেসে বলেন, 'মনে হচ্ছে না পারব বলে। সব কিছুরই একটা শেষ হয়। হতেই পারে টোকিও অলিম্পিক্সই আমার শেষ অলিম্পিক্স। কারণ, বয়স সত্যিই অনেকটা বেড়েছে। আমার দৃষ্টিশক্তি যতই ভাল হোক, চোখ দুটোও তো পুরনো হল। এবার মনে হচ্ছে থামতে হবে। দেখা যাক। আগে টোকিও অলিম্পিক্স শেষ করি। তারপর অবসরে এই বিষয়ে ভাবব।'


টোকিওতে তিনি পদক পেলেন কি পেলেন না, এটা আর আলোচনার বিষয় নয়। পরের অলিম্পিক্সে নিনো যোগ দেবেন কি খেলবেন না, সেটাও আর আলোচনার বিষয় নয়। মানুষ ৯টি অলিম্পিক্স টানা দেখতে পায় না। আর তিনি টানা ৯টি অলিম্পিক্সে কিনা অংশ গ্রহণ করলেন। তিনবার পদকও জিতলেন! নিনো সালুকভাজে নামটাই বিশ্বজুড়ে একটা আলোচনার বিষয়। এক জীবন্ত কিংবদন্তী, যাঁকে একটাই কথা বলার, তোমায় কুর্নিশ।