চন্দননগর: অভাব তাঁর নিত্যসঙ্গী। বাবা অসুস্থ। শয্যাশায়ী। সংসারের সব দায়ভারই কার্যত তাঁর একার কাঁধে। সারাদিন মুখ গুঁজে জীবন সংগ্রাম করে চলেছেন। নীরবে। বিনা অভিযোগে।
কিন্তু পাহাড়ের কথা শুনলেই তাঁর দুই চোখে যেন স্ফুলিঙ্গ। সাদামাটা চেহারায় জ্বলে ওঠে অসাধ্য সাধন করার সংকল্প। আত্মবিশ্বাস ঠিকরে বেরোয় চেহারায়।
তিনি পিয়ালি বসাক (Piyali Basak)। এক যাত্রায় এভারেস্ট (Mt Everest) ও লোৎসে (Mt Lhotse) জয় করে কার্যত অসাধ্য সাধনই করে ফেলেছেন চন্দননগরের (Chandannagore) কন্যা। কোনও প্রতিকূলতাই তাঁর পাহাড় জয়ের নেশা নষ্ট করতে পারেনি।
গঙ্গাপারের শহরের বাসিন্দা হয়েও হঠাৎ পাহাড়ে চড়ার নেশা হল কীভাবে? চন্দননগরের স্ট্র্যান্ডে বসে আড্ডার ফাঁকে এবিপি লাইভকে পিয়ালি বললেন, ‘পাঁচ বছর বয়সে কিশলয় বইয়ে তেনজিং নোরগে (tenzing norgay) ও এডমন্ড হিলারির (edmund hillary) এভারেস্ট জয়ের কাহিনি পরেই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, পাহাড়ই আমার জীবন। সেই থেকেই এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু।‘
পাহাড়ের ডাক তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। শৈশব থেকেই পাহাড়ে চড়ার শুরু। পিয়ালি বলছেন, ‘খুব ছোটবেলা পাহাড়ে যাওয়ার বায়না শুরু করেছিলাম। মা-বাবার সঙ্গে নেপালে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তেনজিং নোরগে শেরপার বাড়িও নেপালে। সেই কারণেই নেপালের প্রতি অমোঘ টান তৈরি হয়েছিল। ৬ বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে কেদার, গঙ্গোত্রী, গোমুখ, কাশ্মীর, বৈষ্ণোদেবী, অমরনাথ, রোটাং পাস, সান্দাকফু, ফালুট-সহ হিমালয়ের দুর্গম এলাকায় বেড়ানো শুরু। সেই থেকেই যেন পর্বতারোহণের শিক্ষা। হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের জোর বাড়তে শুরু করেছিল।‘
৯ বছর বয়সে অপূর্ব চক্রবর্তীর কাছে পর্বতারোহণের প্রথাগত শিক্ষা শুরু হয় পিয়ালির। ২০০৮ সালে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নেন। ‘প্রথমেই সিকিমের রেনক পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করি। ২০১০ সালে প্রি এভারেস্ট ট্রেনিংয়ে ডাক পাই। ২০১১ সালে এভারেস্ট অভিযানের সুযোগ থাকলেও বিভিন্ন কারণে পশ্চিমবঙ্গ যুক্ত হতে পারিনি। তাই আমারও এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নে ছেদ পড়ে। তবে সেই সময় শারীরিক পরীক্ষায় দেখা যায়, হাই অল্টিটিউডে আমার ফিটনেস দুর্দান্ত। যে কারণে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল‘, বলছিলেন পিয়ালি।
২০১০ সাল থেকে হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গে অভিযান শুরু। প্রথমে মুলকিনাথ, পরের বছর কামেদ শৃঙ্গে অভিযান, পরের বছর ভাগীরথী ২ অভিযান করেন পিয়ালি। ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের ভয়াবহ ক্লাউড বার্স্টে আটকে পড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পিয়ালি বলছেন, ‘২০১৩ সালে ভাগীরথী টু শৃঙ্গের কাছাকাছি গিয়ে ভয়ঙ্কর তুষারঝড়ে পড়েছিলাম। কোনও রকমে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসি। তুষারঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে ফেরার সেই অভিজ্ঞতা এবার এভারেস্ট আরোহণের সময় সাহায্য করেছে। সেই শিক্ষাই কাজে লাগিয়েছি পৃথিবীর উচ্চতম এভারেস্ট ও চতুর্থ উচ্চতম লোৎসে শৃঙ্গ জয়ের ক্ষেত্রে।‘
পেশাগতভাবে চন্দননগরের কানাইলাল বিদ্যামন্দিরের প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষিকা পিয়ালি। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আরোহণ করে ফিরেও অবশ্য স্বস্তি নেই। কেন? ‘কোনও কর্পোরেট সংস্থার সাহায্য পাইনি। কোনও স্পনসরশিপ পাইনি। অন্যান্য দেশের পর্বতারোহী যাঁরা ৮ হাজার মিটার উচ্চতার শৃঙ্গ অভিযানে যান, তাঁরা এলাহি সুযোগ সুবিধা পান। বিমানে করে যাতায়াত করেন। আমি ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে সফর করি। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, ট্রেনের টয়লেটের পাশে খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে সফর করেছি,’ বলছিলেন পিয়ালি।
পিয়ালি যোগ করলেন, ‘হিসেব কষে দেখেছিলাম, এভারেস্ট ও লোৎসে অভিযানের জন্য মোট খরচ লাগবে ৪১ লক্ষ টাকা। আমি তার আগে চারটে ৮ হাজার মিটার শৃঙ্গ আরোহন করেছিলাম। তার জন্য ৩৫ লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত ঋণ নেওয়া ছিল। তাই এবার আর কোনও ব্যাঙ্ক লোন পাইনি। তবে প্রচুর মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের জন্যই এভারেস্ট আরোহণ করতে পেরেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে আমিই প্রথম যে কোনও কর্পোরেট সংস্থা বা সরকারি সাহায্য ছাড়া এভারেস্ট জয় করে ফিরেছে। এখনও আমার ৬ লক্ষ টাকা বাকি রয়েছে। তাই এভারেস্ট জয়ের সার্টিফিকেট এখনও পাইনি।’
বিনা অক্সিজেনে এভারেস্ট জয়ের সংকল্প নিয়েছিলেন। যে নজির বিশ্বে আর কারও নেই। কিন্তু তার জন্য হাওয়ার গতিবেগ থাকতে হতো ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার। যখন অভিযান শুরু করেছিলেন পিয়ালি, আবহাওয়া মনোরম ছিল। কিন্তু অর্থাভাবে অনুমতিপত্র জোগাড় করতে পারেননি সেই সময়। সেই খবর জানাজানি হতে মানুষ সাহায্য পাঠাতে শুরু করেন। তাতেই সুরাহা হয়। মেলে ছাড়পত্র।
কিন্তু আবহাওয়া ততদিনে বিরূপ হতে শুরু করেছিল। ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন পিয়ালি। ‘তুষারঝড় শুরু হয়েছিল। যত ওপরে উঠছিলাম, তুষারঝড়ের তীব্রতা বাড়ছিল। অন্যান্য পর্বতারোহীরা অক্সিজেন নিয়ে ওপরে উঠছিলেন। তাঁরাও পরে হাল ছেড়ে দেন। আমি অক্সিজেন ছাড়া সারারাত আরোহণ করি,’ বলছিলেন পিয়ালি। যোগ করলেন, ‘তাপমাত্রা এতই কম ছিল যে, পিঠের ব্যাগে থাকা পানীয় জলও জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। তাই তেষ্টা পেলেও জল খেতে পারিনি।’
তারপর? ‘আমরা যখন হিলারি স্টেপে পৌঁছই, ঝড় ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছিল। ভীষণ বিপজ্জনক জায়গা। সেখানে পাথরে বরফ জমে কংক্রিটের মতো হয়ে রয়েছে। আইস ওয়ালে পায়ের ক্র্যাম্পন গাঁথতে পারছিলাম না। ৪-৫টি রক ওয়াল পেরিয়ে যেতে হয়। আমরা শৃঙ্গের কাছে প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিলাম। আর একশো মিটার বাকি। চারপাশে মৃতদেহ ঝুলছে। ওখান থেকে কারও মৃতদেহ নামিয়ে আনাও সম্ভব নয়। যে নামাতে যাবে, তারই প্রাণসঙ্কট হবে। সেই দৃশ্য দেখে ভয় লেগে গিয়েছিল,' বলছিলেন পিয়ালি। যোগ করলেন, 'সকাল ন’টার সময় আরোহণ শেষ হয়। কিন্তু তুষারঝড়ের এত দাপট যে, দিনের বেলাও রাতের মতো অন্ধকার।'
এভারেস্ট ও লোৎসে আরোহণ করতে মোট দেড় মাস সময় লেগেছে। তবে দুটো আক্ষেপ থেকে গিয়েছে পিয়ালির। এক, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য বিশ্বের সর্বোচ্চ বিন্দু, এভারেস্টে চূড়া থেকে পারিপার্শ্বিক দৃশ্য দেখতে পাননি। দুই, কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া কার্যত পুরো এভারেস্ট আরোহণ করে ফেললেও শেষ একশো মিটার অক্সিজেন সাপোর্ট নিতে হয়েছিল পিয়ালিকে। যে কারণে ফের এভারেস্ট আরোহণের সংকল্প ভেতর ভেতর তৈরি করে ফেলেছেন চন্দননগরের কন্যা।
পাহাড় থেকে নেমেই দৈনন্দিন জীবনের লড়াইয়ে ফের নেমে পড়েছেন পিয়ালি। বাবা তপন বসাকের হাত ধরে পাহাড় দর্শন শুরু। সেই বাবাই জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত। এমনই অবস্থা যে, পরিবারের কাউকে ঠিকঠাক চিনতেও পারেন না। পিয়ালি বলছেন, ‘আমি যে এভারেস্ট জয় করে ফিরলাম, বাবা তা জানতেও পারল না। আমি যদি ম্যাজিকের মতো কিছু জানতাম, তাহলে বাবাকে সারিয়ে তুলতাম।’
পুরো সাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখুন:
তুষারঝড়ও তাঁর স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। স্নো ব্লাইন্ডনেস, ক্লান্তিও হার মেনেছিল পিয়ালির ইচ্ছেশক্তির কাছে। যত বাধাই আসুক, পর্বতারোহণ না ছাড়ার শপথ নিচ্ছেন পিয়ালি। বলছেন, ‘অন্যান্য খেলায় হার-জিত রয়েছে। পর্বতাভিযানে জয়-পরাজয় মানে জীবন ও মৃত্যু। একটা ছোট ভুলেরও যেখানে ক্ষমা নেই। কেউ যদি সাহায্য না করে, বাবা-মাও পাশে না থাকে, তাও আমি পর্বতারোহণেই এগিয়ে যাব। নাহলে তো আমার পাহাড়ের প্রতি ভালবাসা মিথ্যে হয়ে যাবে। পাহাড়ই আমার সংসার। পাহাড় আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে চাই।’
আরও পড়ুন: কেএল রাহুলের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য আথিয়ার, জল্পনা কি বাড়ল আরও?