ভারতীয় দল থেকে যাঁর নিজেকে সরিয়ে নেওয়া সে দিন সৌরভ-রাহুলদের জায়গা খুলে দিয়েছিল, বক্তা তিনি! সেই ছিয়ানব্বই জুনে ফিরে গেলেন স়ঞ্জয় মঞ্জরেকর। গৌতম ভট্টাচার্য-র মনে হল যেন লর্ডস ড্রেসিংরুমে বসে কাহিনি শুনছেন।


...কথা বলছিলাম অজয় জাডেজা আর আমি। আলোচনাটা হচ্ছিল সৌরভকে নিয়ে। তখন নাইন্টি সিক্সের ইংল্যান্ড ট্যুরটা সবে শুরু হয়েছে। আমরা যা বলছিলাম তার  মর্মার্থ: লাক থাকলে মানুষ কী ভাবে কত দূর চলে আসতে পারে।

ট্যুরের দু’-তিনটে ম্যাচ হতে না হতে আলোচনাটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। বদলে গিয়ে দাঁড়াল ইস ট্যুর মে ইসকা কুছ স্পেশাল হোনেওয়ালা হ্যায়। এগুলো টিপিক্যাল ক্রিকেট ড্রেসিং রুমের কথাবার্তা। ক্রিকেটাররা যখনই চোখের সামনে দেখে কেউ আস্তে আস্তে গুটিপোকা থেকে ক্রমে ডানা মেলছে, তখন সে ক্রমশ অনুধাবন করতে পারে এর পরটা কী হতে যাচ্ছে। বাইরের পৃথিবী বোঝার আগেই তার আন্দাজটা সেট হয়ে যায়।

ট্যুরে সৌরভ খুব তাড়াতাড়ি দারুণ ক্রিকেট খেলতে শুরু করে দিয়েছিল। বলটা দেরিতে খেলছিল। শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়ছিল। সিম বোলিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও অস্বচ্ছন্দে ভুগছিল না। মনেই হচ্ছিল এর বড় বড় রান করা শুধু সময়ের অপেক্ষা।

সৌরভকে প্রথম খেলতে দেখি ১৯৯০তে। দেখে দারুণ লেগেছিল। আমার যত দূর মনে পড়ছে নাইন্টিটু-র অস্ট্রেলিয়া ট্যুরের আগে আমি, দিলীপ বেঙ্গসরকর আর রবি শাস্ত্রী মিলে ওকে নিয়ে একটা মিনি বৈঠকও করি। এখানে আমি বলতে চাই মুম্বই ক্রিকেট সম্পর্কে যতই ধারণা চালু থাক যে, এরা প্রাদেশিক, বাস্তব ঠিক উল্টো। আমি দেখেছি মুম্বই ভারতবর্যের সেই ক্রিকেট রাজ্য যে ট্যালেন্টকে সব সময় কুর্নিশ করে। সে ট্যালেন্ট যে রাজ্যেরই হোক। আমার মনে আছে রাহুল দ্রাবিড় আমার আন্ডারে রেস্ট অব ইন্ডিয়ার হয়ে একটা দারুণ ইনিংস খেলেছিল। ম্যাচটা হয়েছিল পাতিয়ালা কী লুধিয়ানায়। ওটা খুব সম্ভবত চুরানব্বইয়ের কথা। আমার কেরিয়ার শেষের দিকে। কিন্তু ওই ইনিংসের কথাটা আমি অনেককে বলে বেড়িয়েছিলাম যে বেঙ্গালুরু থেকে একটা ছেলে দেখছি। এ অনেক দূর যাবে।

যেটা বলছিলাম, সৌরভকে নিয়ে আমাদের মিনি বৈঠকের বিষয়বস্তু ছিল, ছেলেটা দারুণ ব্যাট করে। কিন্তু কত দূর যাবে? কাম্বলি সে সময় মুম্বই ক্রিকেটের খুব বড় নাম। লোকে সচিনকে দূরে রেখেও দ্বিতীয় নাম হিসেবে ওর কথা বলত। আমাদের কিন্তু কখনও মনে হয়নি কাম্বলি ব্যাটসম্যান হিসেবে সৌরভের চেয়ে ভাল। কাম্বলির টেস্টে দু’টো ডাবল হান্ড্রেড আছে। টেস্ট অ্যাভারেজ পঞ্চাশের ওপর। কিন্তু আমরা বরাবরই জানতাম ও দেশের মাঠে ভাল। বিদেশে বল সিম করতে শুরু করলে বা সুইং করলে সৌরভ ওর চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে।

সৌরভ নিয়ে আমাদের প্রশ্নচিহ্ন ছিল, ওর টেম্পারামেন্ট। ক্রিকেটে টেম্পারামেন্ট একটা মস্ত বড় জিনিস। ট্যালেন্টের সঙ্গে ওটাকে যোগ করে করে এগোতে হয়। যার পরেরটা নেই, সে শুধু প্রথমটা সম্বল করে এগোলে কিছু দূর গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। সৌরভ যখন নাইন্টি টু-র অস্ট্রেলিয়া সফরে আমাদের সঙ্গে গেল, তখন ওর রুমমেট ছিল দিলীপ বেঙ্গসরকর। দিলীপের তত দিনে একশো টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে। ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেনসিও করে নিয়েছে। অথচ আমরা গল্প শুনতাম যে, রুমে সৌরভ নাকি ছিল বক্তা, আর শ্রোতা দিলীপ। পুরো সফর জুড়েই তাই।



এ রকম জুনিয়রকে আমরা আগে কখনও দেখিনি। ভারতীয় ড্রেসিং রুমে জুনিয়র বলতে চিরকালীনভাবে বুঝিয়েছে, একটু নরম, বিনীত, কম কথার, লাজুক প্রোটোটাইপ।  সচিন ও আমাদের আগের যে ব্যাচটা,  মানে কপিল-দিলীপরা, তারা বোধহয় জুনিয়রদের মধ্যে একটু বিনীতভাব পছন্দও করত।

অথচ সৌরভ এল সম্পূর্ণ একটা অন্য হাওয়া নিয়ে। লজ্জা-টজ্জার কোনও ব্যাপার নেই। প্রথম দিন থেকে কনফিডেন্ট। মনের কথা খুলে বলে। সব সময় নিজস্ব পয়েন্ট অব ভিউ রয়েছে।

এই অ্যাটিচিউড দেখে সবাই খুব প্রীত হয়েছিল বলতে পারি না। আমার কোনও সমস্যা হয়নি। আমার এ রকম ব্যতিক্রমী অ্যাটিচিউড বেশ ভাল লাগে। সচিনেরও তাই। কিন্তু বাকিরা গলে গিয়েছিল বললে ভয়ঙ্কর মিথ্যে বলা হবে। আসলে এই কনফিডেন্স আমরা কারও মধ্যে আগে দেখিনি। আর একটা সাধারণ ধারণা ছিল ও বাড়তি ব্যাকিং নিয়ে এসেছে।

এই ব্যাকিং নিয়ে আসা ধারণাটা সৌরভের মোটেই উপকার করেনি। ধারণাগুলো বাড়তে বাড়তে এমন চেহারা নিয়েছিল যে, কেউ মনে রাখেনি প্রথম দিন থেকেই ও ভাল ব্যাটসম্যান। সব বড় বড় ম্যাচে রান করেছে। মুম্বই বা ওয়েস্ট জোন ম্যাচে আমাদের এগেনস্টে তো সব সময় রান করত।

ছিয়ানব্বইয়ের সফরে অবশ্য যাবতীয় নেগেটিভ ইমেজারিকে ও নিজের ব্যাটিং দিয়ে মুছে দিল।

সিধু ফিরে গেল সেকেন্ড ওয়ান ডে-র পর। একটা বিরাট নাটক হয়ে গেল ওর ফিরে যাওয়া নিয়ে। তবে সিধু থাকলেও মনে হয় না সৌরভের টিমে ঢুকতে অসুবিধা হত বলে। সিধু থাকলে ওপেনিং স্লটটা ও নিত। বিক্রম রাঠোর বা অজয় জাডেজার কেউ বাদ পড়ত। আমি হঠাৎ করে ইনজিওর্ড হয়ে গেলাম ফার্স্ট টেস্টের পর। এজবাস্টনে ছিল ফার্স্ট টেস্ট। সেখানে সেকেন্ড ইনিংসে গোড়ালিটা ঘুরে যায়। তাই রানার নিয়ে ব্যাট করতে এসেছিলাম। লর্ডসে সেকেন্ড টেস্ট থেকে সরে যাওয়া ছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না।

পরবর্তী কালে অনেকে আমাকে বলেছেন, তুমি না খেলায় সৌরভের দলে ঢুকতে সুবিধে হয়েছিল। আমি তা মনে করি না। ও যা খেলছিল, তাতে এমনিতেই ঢুকত।

নতুন ব্যাটসম্যান যখন বিদেশ সফরে যায়, তার এমনিতেও দলে ঢোকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। উপমহাদেশের বাইরে টেস্ট মানে ধরে নেওয়া যায়, ব্যাটিং স্লটে জায়গা খুলবে। কোথাও না কোথাও অতর্কিতে সুযোগ এসে যাবে। হোম সিরিজে যা হয় না। হোমে সবাই মোটামুটি এত রান করে যে জায়গাই খোলে না। সুতরাং সৌরভ যে ফর্মে ছিল, তাতে ভেজা ওই ইংল্যান্ড সিরিজে জায়গা খোলা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। রাহুলকেও দারুণ ট্যালেন্টেড লাগত। কিন্তু সৌরভ যেন সে বার আরও বেশি ফর্মে ছিল।

ইংল্যান্ড সফর দু’রকমের হয়। একটা গ্রীষ্মের প্রথমার্ধে। একটা দ্বিতীয়ার্ধে। ক্রিকেট রসিকেরা জানেন ফার্স্ট হাফ অব দ্য সামার ইন ইংল্যান্ড ইজ অলওয়েজ ডিফিকাল্ট। পরিবেশ তখন ভেজা ভেজা থাকে। বল বেশি সিম করে। ভারি হাওয়ায় অনেক বেশি সুইং করে। সেকেন্ড হাফ অব সামার থাকে তুলনামূলকভাবে শুকনো আর গরম। তখন পরিবেশটা অনেক ব্যাটিং উপযোগী হয়ে যায়। কিন্তু নাইনন্টি সিক্সে আমরা গিয়েছিলাম গ্রীষ্মের প্রথমার্ধে। ওই ট্যুরে দারুণ ব্যাট করে ছিল সচিন। কিন্তু সচিনের তখন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে সাত বছর হয়ে গিয়েছে। সিনিয়র ব্যাটসম্যান। অত বড় প্লেয়ার, সে তো রান করবেই।

জুনিয়রের কাছে সেই পারফর্ম্যান্স দুম করে কে ভাববে? আজ ভাবলে অবাক লাগে ওই কঠিন পরিবেশে সৌরভ কী দারুণ মানিয়ে নিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিল ইংলিশ পরিবেশে ও ছোট থেকে বড় হয়েছে। নাইনন্টি টু-তেও খুব ভাল ব্যাট করত। কিন্তু আবিষ্কার করি এই চার বছরে সৌরভ আরও উন্নতি করেছে। যদি পুরনো সেই ফুটেজ দেখেন, দ্রুত চোখে পড়বে প্রত্যেকটা ডেলিভারি চট করে ও জায়গায় চলে গিয়েছে। কখনও মনে হয়নি শটের জন্য তাড়াহুড়ো করছে। বা সমস্যায় পড়ছে। আমি জানি না আমাদের ক্যাপ্টেন আজহার কী ভাবে ওর পারফর্ম্যান্স দেখেছিল। কিন্তু আমরা ওয়েস্ট জোন প্লেয়াররা রাতারাতি মোহিত হয়ে যাই। আবার বলি, মুম্বই ক্রিকেটের ঘরানাটাই তাই। দিল্লি আমাদের এত বড় শত্রু ছিল জাতীয় ক্রিকেটে। তবু রঞ্জিতে দিল্লি আমাদের হারিয়ে দিলে আমরা মুক্ত কন্ঠে ওদের প্রশংসা করেছি। তার পর বার করার চেষ্টা করে গেছি কীসে হারিয়ে দিয়ে গেল? কেউ ভাল ব্যাট করছে জানলে, সেই সময়কার সোনার মুম্বই একটাই প্রশ্ন করত, পেস কেমন খেলে? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, সেখানেই সে সার্টিফিকেট পেয়ে গেল।

লর্ডসে সৌরভের ইনিংস ভারতীয় ড্রেসিং রুমে অন্তত মুম্বইকরদের জন্য একটাই জিনিস তৈরি করেছিল — রেসপেক্ট। সে দিন আমায় কেউ মনে করাচ্ছিলেন ইউটিউবে সেঞ্চুরির পরের ক্লিপে নাকি আমায় দেখা যায়। লর্ডস ব্যালকনির সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যারা গাঙ্গুলিকে চিয়ার করছিল তাদের মধ্যে। আমার অনেস্টলি মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, টেন্টব্রিজে সেকেন্ড টেস্ট হান্ড্রেডটা লর্ডস টেস্টেরই এক্সটেনশন ছিল। যেন ওটা হওয়া অনিবার্যই ছিল।

আমরা ওই দু’টো হান্ড্রেডে জাস্ট হা হয়ে যাই। সেই যুগে একটা ছেলে বিদেশে জীবনের প্রথম দু’টেস্টে দু’টো হান্ড্রেড করছে ভাবাই যেত না। আমার তো মনে হয় আজহারের জীবনের প্রথম তিন টেস্টে তিনটে সেঞ্চুরির চেয়ে জোড়া টেস্টে সৌরভের জোড়া সেঞ্চুরি কোনও অংশে কম নয়। বরঞ্চ প্লেয়ারদের কাছে তার মূল্য আরও অনেক বেশি। আমরা আলোচনা করতে শুরু করি, আরে বাবা দু’টো করে ফেলল। রাহুলের ইনিংসগুলোও খুব ভাল ছিল। রাহুল নিয়েও আলোচনা শুরু হয়ে যা, এই ছেলেটাও আগামী দশ বছর দেশের হয়ে থাকবে।

আমার মনে আছে ১৯৯৭-য়ে ইডেন গার্ডেন্সে কোনও একটা টেস্ট ম্যাচ হচ্ছিল। আমি আর আরশাদ আয়ুব মিলে গল্প করছিলাম। সামনে দিয়ে সৌরভ যাচ্ছিল। ও চলে যাওয়া মাত্র আরশাদ বলল, এই ছেলেটা কিন্তু আমাদের  সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। আমি ঘাড় নাড়লাম।

আজও ঘাড় নাড়ছি। সৌরভ ওর ট্যালেন্টের সঙ্গে টেম্পারামেন্ট আর অদম্য মানসিকতা মিশিয়ে যা অ্যাচিভ করেছে, আমরা সেটা ভাবতেই পারিনি। আমি তো বলব ওভার অ্যাচিভ করেছে। আজ স্বীকার করে নিচ্ছি ওর সে দিনের কনফিডেন্সটা ভুল করে অ্যারোগেন্সের ছোঁয়া মনে হয়েছিল। সৌরভকে আসলে আমরা কুড়ি বছর আগে ধরতেই পারিনি।