কলকাতা: ২২ জুন। বাঙালির মনে দিনটি অমর হয়ে রয়ে গিয়েছে। হয়তো, থাকবেও। সমস্ত উপেক্ষার জবাব দিয়ে এ দিনই যে গর্জে উঠেছিল বেহালার বীরেন রায় রোডের এক বাঁহাতির চওড়া ব্যাট। ভারতে ক্রিকেটের নন্দনকানন বলা হয় যে ইডেন গার্ডেন্সকে, সেখানে খেলে বেড়ে ওঠা ছেলের টেস্ট অভিষেক এবং চোখধাঁধানো সেঞ্চুরি কি না বিশ্ব ক্রিকেটের মক্কা নামে পরিচিত ঐতিহাসিক লর্ডসে! এ যেন একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার গল্প। যে চিত্রনাট্যের পরতে পরতে নাটকীয়তা।


২০ জুন, ১৯৯৬। লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেক হয়েছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। বাঙালিরা তখনও হয়তো ভাবতে পারেননি যে, তার দুদিনের মধ্যেই অপেক্ষা করে রয়েছে আরও এক মাহেন্দ্রক্ষণ। যে দিন লর্ডসে ক্রিস লুইস, ডমিনিক কর্ক ও অ্যালান মুলালির পেস ত্রয়ীকে কার্যত নির্বিষ করে দিয়ে সেঞ্চুরি করবেন সৌরভ। আজ, ২২ জুন, মঙ্গলবার সৌরভের সেই মাইলফলকের ২৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। সৌরভের সেই ১৩১ যে শুধু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চাপ কাটিয়ে ভারতকে ম্য়াচ ড্র করতে সাহায্য করেছিল তাই নয়, টিম ইন্ডিয়ার অন্দরে বিশ্বাস গেঁথে দিয়েছিল যে, হ্যাঁ আমরাও পারি।


সেই সফরে বার্মিংহামে প্রথম টেস্টে মাইক আথারটনের ইংল্যান্ডের কাছে ৮ উইকেটে হেরে গিয়েছিল ভারত। দ্বিতীয় টেস্টেও দেশের মাটিতে ফেভারিট তকমা দেওয়া হচ্ছিল ইংল্যান্ডকে। লর্ডসে টস জিতে স্যাঁতস্যাঁতে পিচের ফায়দা তোলার লক্ষ্যে ইংল্যান্ডকে প্রথম ব্যাট করতে পাঠিয়েছিলেন ভারত অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিন। শুরুতেই মাইক আর্থারটনকে কোনও রান করার আগেই এলবিডব্লিউ করে দেন জাভাগাল শ্রীনাথ। স্কোরবোর্ডে কোনও রান যোগ হওয়ার আগেই ফিরে যান ব্রিটিশ অধিনায়ক। অপর ওপেনার অ্যালেক স্টুয়ার্টকেও তুলে নেন শ্রীনাথ। ইংল্যান্ড ৬৭ রানে ২ উইকেট হারায়। আজহারের টস জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত তখন সফল বলেই ধরে নিয়েছেন সকলে।


বল হাতে ছাপ রাখেন সৌরভও। তাঁর মিডিয়াম পেসে বিক্রম রাঠৌরের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন নাসের হুসেন। গ্রেম হিককেও তুলে নেন সৌরভ। বেঙ্কটেশ প্রসাদের বলে ফিরে যান রনি ইরানি। ইংল্যান্ডের স্কোর ১০৭/৫। চেপে ধরেছে ভারত।


কিন্তু নাটকের তখনও বাকি ছিল। ব্যাট হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন গ্রাহাম থর্প ও ইংরেজ উইকেটকিপার জ্য়াক রাসেল। থর্প ৮৯ রানে ফিরলেও রাসেল সেঞ্চুরি (১২৪) করেন। ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ের লেজ মুড়িয়ে দেন প্রসাদ। তবে, কোণঠাসা অবস্থা থেকেও প্রথম ইনিংসে স্কোরবোর্ডে ৩৪৪ তোলে ইংল্যান্ড।


সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় দ্বিতীয় দিনের শেষ সেশনে যখন ব্যাট করতে নামেন, মাত্র ২৫ রানের মধ্য়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছেন রাঠৌর। ক্রিজে অপরাজিত যিনি, সেই নয়ন মোঙ্গিয়ার আবার দেশের বাইরে ইনিংস ওপেন করার অভিজ্ঞতা নেই। ২৪ রান করে ফেরেন তিনি। দ্বিতীয় দিনের শেষে ভারতের স্কোর ৮৩/২। সকলের নজর সচিন তেন্ডুলকরের দিকে। ততদিনে ক্রিকেটবিশ্বে নিজের পরিচিতি গড়ে ফেলেছেন মাস্টার ব্লাস্টার। তিনি যে বিরল প্রতিভা, ব্যাটিং গ্রহের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, মেনে নিয়েছেন ক্রিকেট পণ্ডিতরা। দ্বিতীয় দিনের শেষে ১৬ রানে অপরাজিত সচিন। সৌরভের নামের পাশে ২৬ ব্য়াটিং।


২২ জুন ব্যক্তিগত ৩১ রানের মাথায় সচিনের ফিরে যাওয়া। তার সামান্য পরে ফিরলেন অধিনায়ক আজহারও। কিন্তু, যাঁর উইকেট সবচেয়ে সহজলভ্য মনে হয়েছিল ইংরেজ বোলারদের কাছে, সেই নবাগত বাঁহাতি সৌরভ দাঁড়িয়ে গেলেন ক্রিজে। সেট হয়ে। লাঞ্চ ব্রেকে সৌরভ অপরাজিত ছিলেন ৬৫ রানে। মনঃসংযোগে যাতে চিড় না ধরে, সেই জন্য মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে কোনও খাবার খাননি সৌরভ। সেই কোন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ব্যাট করতে নেমেছেন। খিদে পায়নি? জানতে চেয়েছিলেন হতবাক সতীর্থরা। সৌরভ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। খেতে গিয়ে যদি মনঃসংযোগ নড়ে যায়!


ইংল্যান্ডের স্যুইং বোলিং সহায়ক পরিবেশ। পিচে সবুজ আভা। ইনস্যুইং, আউটস্যুইং, বাউন্সার, কিছুই বাদ যাচ্ছে না। কিন্তু ক্রিজে অটল সৌরভ। ততক্ষণে তাঁর একের পর এক চোখধাঁধানো কভার ড্রাইভ বাউন্ডারি লাইনে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। পরবর্তীকালে যে শট নিয়ে রাহুল দ্রাবিড়ের ঐতিহাসিক উক্তি, 'অফসাইডে প্রথমে ঈশ্বর, তারপরেই সৌরভ।' ঘটনাচক্রে, ২৫ বছর আগের লর্ডসের সেই টেস্ট ছিল দ্রাবিড়েরও অভিষেক ম্যাচ। যে ম্যাচে ৯৫ রান করেছিলেন পরবর্তীকালে ভারতীয় ব্য়াটিংয়ের 'দ্য ওয়াল' হয়ে ওঠা দ্রাবিড়।


তবে থামানো যায়নি সৌরভকে। সেঞ্চুরি করে ইতিহাস তৈরি করেন। দশম ভারতীয় হিসাবে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি। আর অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করায় ভারতীয়দের মধ্যে সপ্তম। লর্ডসে অভিষেক টেস্ট খেলতে নেমে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেন সৌরভ। তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৭ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ক্রিজে ছিলেন। অ্যালান মুলালির বলে বোল্ড হওয়ার আগে ৩০১ বলে ১৩১ রান করেন। নিউজ়িল্যান্ডের ডেভন কনওয়ে কয়েকদিন আগে না ভাঙা পর্যন্ত যা ছিল লর্ডসে টেস্ট অভিষেকে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর। সৌরভের ইনিংসে ছিল ২০টি চার।


আর প্রত্যেকটি রান, প্রত্যেক বাউন্ডারিতে যেন লুকিয়ে ছিল সমস্ত অভিযোগ আর অবজ্ঞার জবাব। ১৯৯২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের পর ব্রাত্য হয়ে পড়া, তিনি নাকি নিজেকে মহারাজ ভাবেন আর যে কারণে টুয়েলভথ ম্যান হয়ে জল বইতে অনীহা, তিনি নাকি পরিশ্রমবিমুখ, প্র্যাক্টিসেও খুব বেশি খাটতে চান না, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে তাঁকে নিয়ে অনেক কানাঘুষো, অভিযোগের পাহাড়। যে অভিযোগ হয়তো প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত করত বেহালার ২৩ বছর বয়সী যুবককে। হয়তো তাঁর ক্রিকেট স্বপ্নকে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত। কিন্তু সৌরভ যে অন্য় ধাতুতে গড়া। অভিযোগ, সমালোচনা, বিতর্ক তাঁকে যেন আরও উদ্বুদ্ধ করে, সেরাটা বার করে আনে। বাড়িয়ে তোলে সংকল্প। আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে যেন রোজ তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নেয়, আই অ্য়াম হেয়ার টু স্টে... আমিই সেরা...।


লর্ডসে ভারত প্রথম ইনিংসে তুলেছিল ৪২৯ রান। আয়োজক দেশের চেয়ে ৮৫ রানে এগিয়ে গিয়েছিল ভারত। দ্বিতীয় ইনিংসে একটি উইকেটও নেন সৌরভ। সব মিলিয়ে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি ও তিন উইকেট। ম্যাচ ড্র করে প্রতিপক্ষ শিবিরে পাল্টা বার্তা দিয়ে রাখে ভারত। লর্ডসে রুদ্ধশ্বাস চিত্রনাট্যের ক্লাইম্যাক্স এসেছিল ২২ জুন। যেদিন ব্যাটেই সমস্ত উপেক্ষার জবাব দিয়েছিলেন সৌরভ। দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর হয়তো আরও আগেই সুযোগ প্রাপ্য ছিল। লর্ডসে তাঁর ব্যাটের শাসন দেখে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক জেফ বয়কট নামকরণ করে ফেলেন, 'প্রিন্স অফ ক্যালকাটা'...


কলকাতার যুবরাজ।