কলকাতা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “সেই সব স্বপ্ন এখনও বাতাসে উড়ে বেড়ায়, শোনা যায় নিঃশ্বাসের শব্দ, আর সব মরে স্বপ্ন মরে না…”


শুভজিৎ পাল। এক সময় বাংলার উদীয়মান ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম সেরা প্রতিভা মনে করা হতো। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে নজরকাড়া পারফরম্যান্স, বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটে সাফল্য়, অনূর্ধ্ব ১৯ ভারতীয় দলে সুযোগ, বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফি অভিষেক। পুরোটাই যেন উত্তরণের কাহিনী। তবে রঞ্জি অভিষেক সুখের হয়নি। ইডেনে তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-দীপ দাশগুপ্তদের দলের হয়ে ওপেন করে দুই ইনিংসেই ব্য়র্থ। রান সাকুল্যে ৩। বাংলা দলের প্রথম একাদশে আর সুযোগ পাননি। হতাশা থেকেই আরও অনেকের সঙ্গে বিতর্কিত ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ বা আইসিএলে নাম লেখানো। পরে সেখান থেকে ক্রিকেটের মূল স্রোতে ফিরতে চেয়েছিলেন। পারেননি। তাঁর আচরণ নিয়েও অনেক অভিযোগ উঠেছে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে ঝড়। সামলাতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা। অ্যাসিডের দহনে শ্বাসনালী দলা পাকিয়ে যাওয়া।


যমে-মানুষে টানাটানির পর প্রাণরক্ষা হয়েছে বাংলার এক সময়ের সাড়া জাগানো উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের। শুভজিৎ পাল এখন ক্রিকেটের বাইশ গজ থেকে অনেক দূরে। কার্যত একাকী। সৌরভ-দীপ-রোহন গাওস্করদের সঙ্গে খেলা ক্রিকেটার এখন ক্রিকেটকেই ভুলে থাকতে পছন্দ করেন।


বাইপাস সংলগ্ন আনন্দপুরের নাজিরাবাদে শুভজিতের বাড়িতে এখন ক্রিকেটের চিহ্নমাত্র নেই। ক্রিকেট নিয়ে বাড়িতে কোনও আলোচনাও হয় না। ক্রিকেট সরঞ্জাম? 'বেশিরভাগই উঠতি ক্রিকেটারদের দিয়ে দিয়েছি। ওদের কাজে লাগবে। ফেলে রেখে নষ্ট করার তো কোনও মানে হয় না,' যেন একরাশ যন্ত্রণা বুকে চেপে বললেন সুজিত পাল। শুভজিতের বাবা।অ্যাসিডের জ্বালায় ভোকাল কর্ড পুড়ে গিয়েছে। তারপর থেকে আর কথা বলতে পারেন না এক সময় বাংলার সাড়া জাগানো ক্রিকেটার। ঠোঁট নাড়েন। মুখ দিয়ে সামান্য যেন আওয়াজ বেরোয়। তবে এতটাই ক্ষীণ যে, শোনা যায় না বললেই চলে। ফিসফিসে স্বর আর ঠোঁট ও মুখের নড়াচড়া দেখে অনুমান করে নিতে হয়। গলার ক্ষত ঢাকতে স্কার্ফ পরে থাকেন। বিশেষ পরিচিত ছাড়া ফোন ধরেন না বড় একটা। গলা ছেড়ে কথা বলতে পারেন না যে! বরং হোয়াটসঅ্যাপে স্বচ্ছন্দ। মতামত আদান-প্রদানের জন্য মোবাইলে টাইপ করাই এখন শুভজিতের কাছে সেরা বিকল্প।


এই অবস্থা কী করে হল? 'আট বছর আগে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। গলায় অ্যাসিডের বোতল খালি করে দিয়েছিলাম,' বলছিলেন শুভজিৎ। তাঁর বাবা যোগ করলেন, 'ওর বাঁচার আশা ছিল না। ৪০ দিন আইসিইউতে ভর্তি ছিল। কলকাতা ছাড়াও বেঙ্গালুরু, মুম্বই ও হায়দরাবাদে চিকিৎসা হয়েছে। ২৫-৩০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। একটা সময় ভেবেছিলাম সিএবি-র কাছে সাহায্য চাইব...।'



আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন কেন? শুভজিৎ বলছেন, '২০১২ সালে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রত্যেক মানুষেরই একটা নতুন স্বপ্ন থাকে। আমারও ছিল। তবে সম্পর্কে সমস্যা তৈরি হয়। স্ত্রী আমাকে না জানিয়ে গর্ভপাত করিয়েছিল। সেই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারিনি। সেই সঙ্গে অবসাদ। হাসপাতালে যখন বাঁচার জন্য লড়াই করছি, তখন ডিভোর্সের চিঠি পাঠিয়েছিল।' তবে এখন তাঁর উপলব্ধি, আত্মহননের চেষ্টা করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। অবসাদের কারণ কী? 'আর সুযোগ পেলাম না। ক্রিকেটটা চালিয়ে যেতে পারলাম না,' বলছেন শুভজিৎ।


ঋদ্ধিমান সাহার আগে রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার হয়ে অভিষেক। তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে ইডেনে দু'ইনিংসেই ব্যর্থ। প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৩ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ০। সবুজ উইকেটে বাংলার ব্যাটিং বিপর্যয় হয়েছিল। তামিলনাড়ুর কাছে ২২২ রানে হেরে গিয়েছিল বাংলা। শুভজিতের কাছে বাংলার প্রথম একাদশের দরজা আর কখনও খোলেনি।



তাঁর বাবা সুজিত বলছেন, 'প্রথম ম্যাচেই আমার ছেলে ব্য়র্থ হয়েছিল। রান পায়নি। কিন্তু তা বলে আর একটা সুযোগ ও পেত না? কত ছেলে তো নিজেদের প্রমাণ করার জন্য ৫-৬টা করে ম্যাচ পায়। সুযোগ না পেয়ে ও মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিল।' এরপরই আইএসএলে যোগদান। তবে ফিরেও এসেছিলেন। রোহন গাওস্কররা ক্রিকেটের মূল স্রোতে ফিরে এলেও, আর সুযোগ পাননি শুভজিৎ। হারিয়েই যান। সুজিত বলছেন, 'ওরও দোষ ছিল। কিছু আচরণগত সমস্যা ছিল। কিন্তু আর একটা সুযোগ প্রাপ্য ছিল।'


সুজিতবাবুর আক্ষেপ, 'ডব্লিউ ভি রামন শুভজিৎকে উইকেটকিপার হিসাবে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলার নির্বাচকেরা বলেছিলেন, ওর তো বয়স কম। পরে খেলবে। অথচ সে বছরই অম্বাতি রায়ডু, সুরেশ রায়না, ইরফান পাঠান-সহ ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ দলে যাদের সঙ্গে খেলেছিল তারা রাজ্য দলের হয়ে খেলে। ২০০২ সালে ইংল্যান্ড সফরে ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ দলের একটাই সেঞ্চুরি ছিল আর সেটা এসেছিল শুভজিতের ব্যাট থেকে। উইকেটকিপার হিসাবে ৩২টি শিকার ছিল। অনূর্ধ্ব ১৯ বিভাগের বাংলার সেরা ক্রিকেটার। বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটের সেরা খেলোয়াড়, ভিজি ট্রফিতে ডাবল সেঞ্চুরি। ওর নেতৃত্বে ৩২ বছর পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভিজি ট্রফি জিতেছিল। আইসিএলে শেন বন্ডের মতো বিশ্বের সেরা পেসারদের বিরুদ্ধে খেলেছে। হাফসেঞ্চুরি করেছে। ব্যাটিং নিয়ে ব্রায়ান লারার সঙ্গে কথা বলেছে। সেই ছেলে বাংলায় ফিরে টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও সুযোগ পাবে না? সেরা ছন্দে থাকতে থাকতে সুযোগ পেল না।'


ক্রিকেট মাঠের কারও সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ নেই শুভজিতের। ময়দানে যান না। ২০১৩ সালে টাউন ক্লাবের হয়ে শেষ সিএবি-র টুর্নামেন্ট খেলেছিলেন। আপনার পরিচিতরা বলেন, আপনি নাকি যোগাযোগ রাখেননি? শুভজিৎ বলছেন, 'কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। আমি কী বলছি সেটা কেউ বুঝতে পারে না। তাই অস্থির হই। নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি।'


মাঠের লোকেরা তো লড়াইয়ের জন্যই পরিচিত। আপনি হাল ছেড়ে দিলেন কেন? শুভজিৎ বলছেন, 'এখনও লড়াই করি। তবে সেটা বাঁচার জন্য। নিজের জন্য। ক্রিকেটের জন্য নয়। ক্রিকেটের বাইরেও একটা জীবন আছে।' ক্রিকেট অন্ত প্রাণ ছিলেন। একটা সময় বড় ম্যাচের আগের দিন রাতে ঠিক মতো ঘুমোতে পারতেন না উত্তেজনায়। 'ছটফট করতাম। সারাক্ষণ ভাবতাম, কী করে খেলব, কী করব। কতক্ষণে মাঠে নেমে পড়ব তর সইত না। এখন আর ইচ্ছেই করে না,' শূন্য দৃষ্টিতে বলছিলেন শুভজিৎ।


মাঠে ফিরতে ইচ্ছে করে না? শুভজিৎ বলছেন, 'কখনও কখনও করে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয়।' নিজের অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গিয়েছে। ছোটদের শিখিয়ে, তালিম দিয়ে সেগুলি পূরণ করতে ইচ্ছে করে না? শুভজিতের জবাব, 'প্রথমে ভাবিনি, তবে এখন একটু আধটু চিন্তা আসছে। অনেকেই বলছে কোচিং করানোর কথা।' টিভিতে খেলা দেখেন না। আইপিএলেও আগ্রহ নেই। কেন? চরম অভিমানে যেন বলছেন, 'আমি ক্রিকেট খেললে ওদের মতোই খেলতাম, ওদের সঙ্গেই খেলতাম। ওদের খেলা কেন দেখব?'


এখন জীবন সীমাবদ্ধ শুধু বাড়ি আর অফিসে। স্মৃতি বলতে কিছু ফিকে হয়ে যাওয়া ছবি, ধুলো পড়া ট্রফি আর নিজের উইকেটকিপিং গ্লাভস। শুভজিৎ পালকে ময়দানের অনেকেই দেখতে চায়। শুভজিৎ নিজে কী চায়? এক সময় বাংলা ক্রিকেটের সাড়া জাগানো নাম বলছেন, 'ময়দান যদি আমাকে আমার মতো করে গ্রহণ করে, তবে শুভজিৎ পাল ফিরতে তৈরি। নিজে খেলে, বড় কোচেদের প্রশিক্ষণে যা শিখেছি, তা ছোটদের শেখাতে পারলে খুব খুশি হব।'