চেন্নাই: মাস ছয়েক আগে তাঁর পরিচিতি ছিল হাতে গোনা, আর এই মুহূর্তে ডাউন আন্ডার থেকে সিরিজ জিতে ফিরতে আসমুদ্রহিমাচল তাকিয়ে তাঁর দিকে। টি নটরাজন। কয়েকবছর আগে যিনি জুতো জোগাড়ের জন্য ভাড়ায় ক্রিকেট খেলতেন, সেই বাঁ হাতি পেসারই গত ৪৪ দিনের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের হয়ে তিন ফর্ম্যাটেই অভিষেক করে ফেলেছেন।


নটরাজনের ধূমকেতুর ন্যায় উত্থান দেখে প্রাক্তন ক্রিকেটাররা দেশের তরুণ ক্রিকেট তুর্কিদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ক্রমাগত নিজের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব। সুযোগ কবে আসবে ভেবে আশাহত না হয়ে নিজের চেষ্টাটুকু চালিয়ে যাওয়ার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা।

প্রথমে গত বছরের ২৬ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়াগামী চারজন নেট বোলারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন, তারপর ৯ নভেম্বর বরুণ চক্রবর্তীর চোটের জেরে তাঁর বদলি হিসেবে টি-২০ স্কোয়াডে সুযোগ, নেটে ভালো পারফরম্যান্সের জেরে ওডিআই স্কোয়াডেও অন্তর্ভুক্তি।

আর ডিসেম্বরের শুরুতেই মেন ইন ব্লু-র জার্সিতে জোড়া অভিষেক। ২ ডিসেম্বর ওডিআই অভিষেকে ২ উইকেট, তার ঠিক দুদিন বাদে ৪ ডিসেম্বর টি২০ অভিষেকে ৩ উইকেট। সীমিত ওভারে পারফরম্যান্সের সুবাদেই ৯ ডিসেম্বর টেস্ট সিরিজের জন্য নেট বোলার হিসেবে অস্ট্রেলিয়াতেই তাঁকে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত।

উমেশ যাদবের চোটের জেরে নতুন বছরের শুরুতেই টেস্ট স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্তি। আর ১৫ জানুয়ারি টেস্ট অভিষেক। প্রথমদিনে ২টি সহ প্রথম ইনিংসে ৩ শিকার। যার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে শতরানকারী মার্নাস লাবুশেনের উইকেট।

সালেম থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে চিন্নাপামাট্টি গ্রামে দরিদ্র এক পরিবারে জন্ম নটরাজনের। বাবা পাওয়ার মিলে ও মা মাংসের দোকানে কাজ করে কোনওক্রমে সংসার চালাতেন। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট অনুরাগ থাকলেও ২০১১ থেকে পেশাদার হওয়ার মানসিকতা নিয়ে লড়াই শুরু। ছোটবেলায় বই, খাতা কেনার সমস্যা থেকে পরে খেলার সরঞ্জাম, আর্থিক দুরবস্থায় কোনওটাই সেভাবে হয়ে ওঠেনি।

বোলার হওয়ার জেরে খুব প্রয়োজনীয় ছিল ভালো জুতো। একসময় তাই অর্থ নয়, ভালো জুতোর বদলে ভাড়ার খেলা শুরু করেন নটরাজন। যে কাজ করার মাঝেই হঠাৎ প্রথম স্বপ্নপূরণ। অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের কোনও ক্রিকেট না খেলে সরাসরিই তামিলনাড়ুর হয়ে ২০১৪ সালে রঞ্জি খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু রঞ্জি অভিষেকের পর প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে। যা শুধরে নিতে বেশ খানিকটা ঝক্কি পোহাতে হয় তাঁকে। কিন্তু সেই ধাক্কা সামলে ফের প্রবলভাবে ফিরে আসেন তিনি। তারপর ক্রমাগত ভালো পারফরম্যান্সে দৌলতে নির্বাচকদের নজরে পড়েন। ২০১৭ সালে তাঁকে কেনে কিংস ইলেভেন পঞ্জাব। সেখানে সুযোগ পাননি, মাঝে হয় কনুইয়ের অস্ত্রোপচার।

যার পর তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগে ভালো খেলার সুবাদে দলে নেয় সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। যেখানে মুথাইয়া মুরলীধরণের সঙ্গ পান। সুযোগ না পেয়ে হতাশ থাকা নটরাজনকে বোঝান ভুবনেশ্বর কুমার। হাল না ছেড়ে নিজের কাজ চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দেন। আর যার সুবাদেই এবারের আইপিএলে সুযোগ পেয়ে কাজে লাগানো।

কয়েকমাস আগে হয়ে যাওয়া ত্রয়োদশ আইপিএলের আগে সেভাবে ক্রিকেটবৃত্তেই পরিচিত ছিলেন না নটরাজন। তারপর সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর থেকেই একের পর এক সুযোগের দরজা খুলতে থাকে নটরাজনের। যে সুযোগে টানা নিজেকে তিনি প্রমাণও করে চলেছেন।

নিজে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে উঠে এসছেন বলে এলাকার প্রতিভাবান ক্রিকেট তুর্কিদের সাহায্য করতে ইতিমধ্যেই অ্যাকাডেমিও খুলেছেন নটরাজন। ভারতের জার্সি গায়ে চাপানোর মতোই গর্ব করে যা নিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে অ্যাকাডেমির ৫০-৬০জন ছেলে চেন্নাইয়ের স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেট খেলছে।