কলকাতা: প্রথম দর্শনেই ছেলেটাকে ভাল লেগে গিয়েছিল দীনেশ লাডের (Dinesh Lad)। বোলিং অ্য়াকশন বেশ ভাল। লো স্কোরিং ম্যাচে ২ ওভার বল করেছিল। একটি মেডেন-সহ এক উইকেট।


দীনেশের উদ্যোগেই সেই খুদে ভর্তি হয় স্বামী বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। সেখানেও প্রতিবন্ধকতা। মাইনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। ফের মুশকিল আসান কোচ। দীনেশই নতুন ছাত্রের ফি মকুব করান কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে। এরপর আরও নাটকীয়তা। একদিন যাঁর অফস্পিন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন দীনেশ, তাঁকেই গড়ে তুললেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান। বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের জন্য যাঁর নামকরণই হয়ে যাবে 'হিটম্যান'। গোটা ক্রিকেটবিশ্ব যাকে চিনবে রোহিত শর্মা (Rohit Sharma) নামে।


বিদেশের মাটিতে টেস্টে প্রথম সেঞ্চুরি করেছেন রোহিত। শনিবার ছাত্রের সেই ইনিংস যেন গুরুর কাছে শিক্ষক দিবসের আগাম উপহার। রবিবার মুম্বই থেকে মোবাইল ফোনে এবিপি লাইভকে দীনেশ লাড বললেন, 'রোহিতের জন্য আমি গর্বিত। কোচ হিসাবে আর কী চাওয়ার থাকতে পারে।'


টেস্টে নিজের অষ্টম সেঞ্চুরি পেয়েছেন রোহিত। ওভালে তাঁর ইনিংসের জন্যই ভাল জায়গায় রয়েছে ভারত। দীনেশ বলছেন, 'প্রত্যেক ম্যাচেই ভাল খেলছে। টেকনিকের দিক থেকেও কোনও খুঁত নেই। লর্ডসে সেঞ্চুরির খুব কাছাকাছি গিয়েছিল। তবে ওভালে শেষ পর্যন্ত তিন অঙ্ক স্পর্শ করল। যেটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে তা হল ওর শট নির্বাচন। সব বলে মারার চেষ্টা করেনি। বল বেছে খেলেছে। মারার বল পেলে মেরেছে। মঈন আলিকে যেভাবে ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি সম্পূর্ণ করল, তাতে ওর আত্মবিশ্বাস প্রতিফলিত হচ্ছিল। ক্লিনহিট মেরেছিল। ও জানত কোথায় মারছে। সোজা ব্যাটে খেলেছে। যে কটা বাউন্ডারি ও ওভার বাউন্ডারি মেরেছে, সব সোজা ব্যাটে। কোচ হিসাবে আমি ভীষণ খুশি।'


দীনেশের প্রশিক্ষণেই বাইশ গজে রোহিতের উত্থান। ছাত্র হিসাবে কেমন ছিলেন রোহিত? 'খুব বাধ্য ছাত্র ছিল। সকালে যখন বলতাম, প্র্যাক্টিসে চলে আসত। ও জানত ওকে কী করতে হবে,' বলছিলেন দীনেশ। যোগ করলেন, 'প্রত্যেক দিন ২-৩ ঘণ্টা করে ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করত। স্কুল থেকে শিক্ষিকাকে বলে প্র্যাক্টিসে চলে আসত। ছোট থেকেই বলত, আমি ক্রিকেটার হব। সেই সংকল্পই ওকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।'


রোহিতকে প্রথম দর্শনে কেমন লেগেছিল? দীনেশ বলছেন, 'বেশ মনে আছে, অনূর্ধ্ব ১২ দলের ট্রায়াল ছিল। ১০ ওভারের ম্যাচ ছিল। রোহিতের ব্যাটিং দেখিনি। তবে ওই ম্যাচে ও ২ ওভার বল করেছিল। অফস্পিন বল করত। একটা উইকেট পেয়েছিল। একটা মেডেন নিয়েছিল। সামনে বসে ওর খেলা দেখেছিলাম। ওর বোলিং অ্যাকশন ভাল লেগেছিল।'


অফস্পিনার থেকে রোহিতের বোলারদের ত্রাস হয়ে ওঠার কাহিনি হার মানাতে পারে যে কোনও সিনেমার চিত্রনাট্যকে। পরতে পরতে এত নাটকীয়তা। স্বামী বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ক্রিকেট কোচ দীনেশ। বলছিলেন, '১৯৯৫ সালে স্কুল চালু হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে রোহিতকে প্রথম দেখি ওই ট্রায়ালে। তখন আমি স্কুল দলের জন্য ক্রিকেটার খুঁজছি। ট্রায়ালে ওকে দেখেই ওর বাবা-মাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলি। ওর বাবা-মা অনেকটা দূরে থাকতেন। রোহিত মুম্বইয়ে ওর কাকার বাড়িতে থাকত। স্কুলের ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে ১৫ মিনিট দূরত্বে ওর কাকার বাড়ি। ওর কাকাকে বলেছিলাম, ছেলেটাকে ভাল লাগছে, আপনারা চাইলে আমাদের স্কুলে নিয়ে আসতে পারেন।'


কিন্তু তার পরেও বিপত্তি। দীনেশ বলছেন, 'ওর কাকার সঙ্গে কথা হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ৩১ মে। ২ জুন রোহিতকে নিয়ে স্কুলে এসেছিলেন ওর বাবা। ফর্ম ফিল আপ করে উনি যখন জানতে পারেন স্কুলের ফি মাসে ২৭৫ টাকা, তখন বলেন ভর্তি করবেন না। কারণ এত টাকা মাইনে দেওয়া ওঁদের সামর্থ্যের বাইরে ছিল। আমি তখনই স্কুলের ডিরেক্টরের কাছে যাই। তাঁকে জানাই যে, একটা সমস্যা হয়েছে। ছেলেটা ফর্ম ফিল আপ করলেও মাইনে দিতে পারবে না বলে ভর্তি হতে চাইছে না। ডিরেক্টরের কাছে নিখরচায় ভর্তি করার অনুরোধ করি। ডিরেক্টর জানতে চান, কী এমন দেখলেন যে, এত জোরাজুরি করছেন। ওঁকে জানাই যে, ছেলেটার বড় ক্রিকেটার হওয়ার সবরকম গুণ রয়েছে। ডিরেক্টর রাজি হয়ে যান। ফি মকুব হয়ে যায় রোহিতের। ওকে স্কলারশিপ দেওয়া হয়। তা না হলে হয়তো রোহিত শর্মার ক্রিকেটার হওয়াই হতো না।'


রোহিতের বয়স তখন ১৩ বছর। সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন। দীনেশ বলছেন, 'হ্যারিস শিল্ডের প্র্যাক্টিস অক্টোবর মাসে হয়। আর জাইলস শিল্ডের প্র্যাক্টিস হয় ফেব্রুয়ারিতে। হ্যারিস শিল্ডে ওকে নিতে পারিনি। তারপর যখন জাইলস শিল্ডের প্র্যাক্টিস শুরু হল, তখন রোহিত আসতে শুরু করে। সে বছর বোলার হিসাবে ওকে খেলিয়েছিলাম। অফস্পিন করত। ওর ভাল পারফরম্যান্স হওয়ায় পরের বছর অনূর্ধ্ব ১৬ ও অনূর্ধ্ব ১৪, দুই দলেই ওকে রাখি।'


তারপরই নাটকের ক্লাইম্যাক্স। স্পিনার থেকে রোহিতের ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠার কাহিনি। 'একদিন স্কুলে ঢোকার সময় বাইরে থেকে লক্ষ্য় করলাম একটা ছেলে নকিং করছে। ভেতরে গিয়ে দেখলাম, আরে, এ তো রোহিত! দেখলাম স্ট্রেট ব্যাটে খেলছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাটিং করতে পারো? বলল, হ্যাঁ। পরের ম্যাচে ওকে চার নম্বরে ব্যাট করতে পাঠাই। ওর ব্যাটিং দেখে ভাল লাগে। জাইলস শিল্ডে ওপেন করতে পাঠাই। আর ওপেনিংয়ে সুযোগ পেয়েই ১৪০ রান করে। তারপরই শুরু হয় ওর নতুন ইনিংস। ওপেনার হিসাবে খেলতে শুরু করে,' এক নিঃশ্বাসে বলে চললেন দীনেশ।


রোহিতের ছোটবেলার কোচ বলছেন, 'প্রথম থেকেই আগ্রাসী ব্যাটিং করে। ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। মাঝে মধ্যেই কথা হয়। তবে টেকনিক্যালি ওকে কিছু বলি না আর। এত ভাল ব্যাট করছে যে, ওকে টেকনিক নিয়ে কিছু বলাটা বৃথা। ইংল্যান্ড সিরিজের আগে শুধু ওকে বলেছিলাম, উইকেটে বেশিক্ষণ থাকার চেষ্টা কোরো। যতক্ষণ ক্রিজে থাকবে, বড় রান উঠবে। এর বেশি কিছু বলার নেই ওকে। তাতেই ম্যাজিক হয়েছে।'


শিক্ষক দিবসে রোহিতের ক্রিকেট-গুরুর কণ্ঠস্বরে তৃপ্তি।


মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন কোচ, শিক্ষক দিবসে উদ্বিগ্ন তিরন্দাজ দীপিকা কুমারী