কলমে ডঃ উৎপল অধিকারী 




‘আলো আমার, আলো ওগো / আলো ভুবন ভরা’। আলোয় উদ্ভাসিত জগৎ হল প্রাণের সৃষ্টির প্রসূতি গৃহ। আঁধার বিনাশী সূর্য হল জগতের নাথ। আলো নিয়ে কত না কথা, গল্প, কত বিশেষণ, কত গান ও সাহিত্য!


কিন্তু, আলো যখন দূষণ ছড়ায় তখন ভালো লাগে তো ! হ্যাঁ, দূষণের অভিধানে সংযোজন আলোক দূষণ বা লাইট পলিউশন। এই দূষণে দূষিত হচ্ছে প্রায় সমগ্র বিশ্ব। ল্যাম্পের আলো থেকে শুরু করে, তীব্র হ্যালোজেনের আলো অথবা রঙিন নিয়ন আলোতে খান খান হয়ে যাচ্ছে রাত্রির মায়াবী অন্ধকার।


গল্পের শুরুটা হয়েছিল অনেক আগেই, যখন বন্য মানুষ প্রথম আগুন জ্বালাতে শেখে। তখন থেকেই শুরু হয় আলো দূষণ। কারণ সেই আগুন ও তার থেকে উদ্ভাসিত আলোয় বন্যপ্রাণীরা সেই স্থান ত্যাগ করে চলে যেত অন্যত্র। ফলে আদিম মানুষ রক্ষা পেত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্য মানুষ সভ্য হয়েছে এবং নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে থেকেও তাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে আত্মপ্রচার ও ব্যবসায়িক স্বার্থ। গ্রাম থেকে শহর,  ছোট-বড় জনপদ, হোটেল-রেস্তোরাঁ ইত্যাদি স্থানে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত জ্বলছে কৃত্রিম আলো। বিচিত্র তার রঙের বাহার। বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো ছবিতে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর বেশ কিছু অংশে জোনাকির আলোর ন্যায় আলোতে রাত্রির আকাশ পরিপূর্ণ। আলোক দূষণ চরম আকার ধারণ করছে উন্নত দেশগুলিতে। ইতালির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ রাতের প্রকৃত আলো পায় না, তার কারণ হলো কৃত্রিম আলোর প্রকটতা। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ সায়েন্স এন্ড রিসার্চ’এ আলোক-দূষণের উপর একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়। সেখানকার প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জানা গেছে, বিশ্ব মোট যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে তার উনিশ শতাংশ শক্তি ক্ষয় করে রাত্রের আলো জ্বালানোর জন্য। এই আলো তৈরিতে যে শক্তি লাগে তা প্রধানত ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে তৈরি হয়। যা পরোক্ষভাবে পৃথিবীতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধির জন্য দায়ী এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণও বটে।


পিছিয়ে নেই আমাদের ভারতবর্ষও। বিভিন্ন সমীক্ষা ও পরীক্ষায় জানা যাচ্ছে ২০১২-২০১৬ সালে ভারতে প্রকৃত আলোক অঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ও ২০১৭ সালের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক রিপোর্ট বলছে পৃথিবীর সাপেক্ষে ভারতে রাত্রি নষ্ট হচ্ছে প্রায় তিনগুণ অধিক হারে


লাইট পলিউশনকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় ; যথা-লাইট ক্লাটার, লাইটট্রেস্পাস, ওভার ইলুমিনেশন ও গ্লেয়ার দূষণ  ইত্যাদি। 


লাইটক্লাটার দূষণে বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ রঙিন আলো মানুষকে বিভ্রান্ত করে। কার্যত ভোগ বিলাসের শহর আমেরিকার লাসভেগাসে সাধারণত এই দূষণ দেখা যায়। নেশাতুর চোখে গভীর রাতে যখন মানুষ ঘরে ফেরে তখন এই দূষণ তাদের পথ ভোলায়। 


লাইটট্রেস্পাস দূষণে পাশের কোন উজ্জ্বল আলো অন্যের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠে। যেমন রাস্তায় অথবা বাইরের কোন আলো যখন অন্যের বাড়ির কাচের জানালা ভেদ করে ঢুকে যায় ঘরে, তখন তাকে লাইটট্রেস্পাস বলে।


ওভার ইলুমিনেশন দূষণে  অতি উজ্জ্বল আলো যথা হ্যালোজেন আলোয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল আলোক দূষণের কবলে পড়ে।


গ্লেয়ার দূষণে  আলোক যখন তীক্ষ্ণভাবে একদিকে যায়, যেমন লেজার লাইট তখন সেই দিকে এই দূষণ হয়। 


তবে জেনে রাখা ভাল, রাত্রের আকাশ নিকষ কালো নয়, মহাজাগতিক অজানা ও নরম আলোয় তা পরিপূর্ণ থাকে। বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছেন পূর্ণিমার সময় রাত্রের আকাশ অমাবস্যার থেকে প্রায় ৪০ গুণ বেশি আলোকিত থাকে। এছাড়াও ঘন জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে আকাশের উজ্জ্বলতা সাধারণত জনবসতিশূন্য অঞ্চলের থেকে প্রায় ১০০ গুণ বেশি আলোকিত থাকে। 


কীভাবে মাপা হয় এই আলোক দূষণ?


সাধারণত পৃথিবীর উপর থেকে পাঠানো কৃত্রিম স্যাটেলাইটের ছবি বিশ্লেষণ করে এবং অন্যান্য গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে দূষণের পরিমাপ ও তীব্রতা মাপা হয়। 


জীবদেহে কুপ্রভাব


মানুষ সহ অন্যান্য উন্নত প্রাণীদেহে রয়েছে বায়োলজিক্যাল ক্লক, যার সাহায্যে প্রাণীরা দিন ও রাত্রির তফাৎ বুঝতে পারে, দিনে কর্মচঞ্চলতা শেষে রাতে ঘুমের দেশে চলে যায়। কিন্তু আলোক-দূষণের ফলে তা নষ্ট হতে বসেছে। বিঘ্নিত হচ্ছে মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীর ঘুম। এই  অনিদ্রার কুপ্রভাব স্বরূপ তাদের স্বাভাবিক আহার ও প্রজনন ক্ষমতা বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে অবলুপ্ত হতে পারে বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতি। সূর্য অস্তমিত হলে অন্ধকারে মানব শরীরে রক্তে বৃদ্ধি পায় মেলাটোনিন নামক একপ্রকার হরমোন, যা তাদের নিদ্রার জন্য দায়ী। নিদ্রাকালীন মানুষের রক্তে নির্গত হয় বিটা এনডরফিন যা স্বাভাবিক পেনকিলার হিসাবে কাজ করে। সঠিক মাত্রায় ঘুম শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখে। কিন্তু আলোক দূষণ মানুষের অনিদ্রা বৃদ্ধি করছে। ফলে অনিদ্রাজনিত মানসিক চাপ, হার্ট ডিজিজ ও ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিউইয়র্ক অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের এক আলোচনা চক্রে উঠে আসে, আলোক দূষণ পরোক্ষভাবে জন্ম দিচ্ছে ক্যান্সারের মতো রোগের । 




নিশাচর প্রাণী তথা বাদুড়, বিভিন্ন পাখি ও পরিযায়ী পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হয় আলোক-দূষণের ফলে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ সায়েন্স এন্ড রিসার্চ জার্নালের এক কেস স্টাডিতে দেখা গেছে, আলোক দূষণ সমুদ্রে কচ্ছপের ওপরও কুপ্রভাব ফেলে। সামুদ্রিক কচ্ছপগুলি অতি উজ্জ্বল বা আলোকিত সমুদ্র সৈকতে বাসা বাঁধে না। তারা এই উজ্জ্বল সমুদ্র সৈকত গুলির পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার সমুদ্র সৈকতে বাসা বাঁধে। এইসব আলোক উজ্জ্বল স্থানগুলিতে  হ্যাচিং মর্টালিটিও যথেষ্ট বেশি। আমেরিকার ফ্লোরিডা সমুদ্র সৈকতে কচ্ছপের বাসা বাঁধার সফলতার হার মাত্র ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই কম। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এর কারণ হল আলোক দূষণ। ডিম পাড়ার পর সদ্যোজাত সমুদ্রের দিকে যাওয়ার পরিবর্তে যেদিকে খুশি চলে যাচ্ছে। যার কারণ হতে পারে এই  দূষণ।


মাছের জীবন চক্রের ওপরও আলোক দূষণ প্রভাব বিস্তার করে। এফএও রিপোর্ট অনুসারে আমেরিকার ভিক্টোরিয়া হ্রদে মাছ ধরার জন্য যে ফ্লোটিং লাইট ব্যবহৃত হয়, সেগুলিতে অনেক মাছ আকৃষ্ট হয়ে জালে ধরা পড়ে। এগুলো থেকে বাদ যায় না ছোট বড় কোনো মাছই।


ডুবন্ত আলো বা সাবমার্জড লাইট বিভিন্ন স্যালমন মাছের সুইমিং ডেপথকে বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ তারা আরো অনেক গভীরে চলে যায়। আটলান্টিক স্যালমন মাছের সেক্সচুয়াল অ্যাক্টিভিটি বা যৌন কার্যকলাপও এর ফলে কমে যায় ও তাদের বংশবিস্তার হার অনেকখানি সীমিত হয়ে গেছে।


আলোক দূষণ উদ্ভিদের ওপর ও প্রভাব বিস্তার করে অতিরিক্ত আলো উদ্ভিদের বিপাকক্রিয়া বিঘ্নিত করে। এতে বিভিন্ন দীর্ঘ দিবা-উদ্ভিদের ফুল ফোটা বিঘ্নিত হয়। বিভিন্ন স্বাভাবিক বা কৃত্রিম জলাশয়গুলির পাড়ে সৌন্দর্যায়নের ফলে যে উজ্জ্বল আলো লাগানো হয়- তার ফলে সেখানকার আণুবীক্ষণ জুপ্লাংটন ও ফাইটোপ্লাংটনের স্বাভাবিক জীবন চক্র নষ্ট হয়।





আলোক দূষণ নিয়ন্ত্রণ 


আলোক দূষণ নিয়ন্ত্রণে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই অ্যাসোসিয়েশন’। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। উন্নত দেশ আমেরিকায় রচিত হয়েছে ‘অ্যান্টি লাইট পলিউশন ল’,। এই আইনসমূহ অবাঞ্চিত আলো ব্যবহারের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, প্রয়োজনে শাস্তিরও ব্যবস্থা রেখেছে। এছাড়াও ‘দি ন্যাশানাল পার্ক সার্ভিস ন্যাচারাল সাউন্ড এন্ড নাইট স্কাইজ ডিভিশন’ বিভিন্ন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ, ন্যাশনাল পার্ক ও অভয়ারণ্যের আকাশ পরিদর্শন করে। ২০১৩ সালের এক হিসাব অনুসারে হংকং শহরের আকাশ ছিল সব থেকে বেশি আলোকিত এবং ২০১৬ সালে ছিল সিঙ্গাপুরের আকাশ। দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু চিরাচরিত শক্তির ব্যবহার কমানো ও রাতের আধার কিছুটা ফেরত পাবার আশায় কিছু বছর আগে প্যারিসে সন্ধ্যায় শহরের প্রায় সব বাতি নিভিয়ে রেখেছিল কিছু সময়ের জন্য। প্যারিসের এই মহতী উদ্দেশ্যের অংশীদার হয়েছিল ভারতবর্ষও। তার আংশিক প্রভাব পড়েছিল প্রিয় শহর কলকাতাতেও। কলকাতায় বিভিন্ন পার্ক এবং রবীন্দ্রসরোবরে রাত্রি ৯ টার পর আলো বন্ধ করার নির্দেশ আছে কলকাতা কর্পোরেশনের। এইভাবে আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে কমবে আলোক দূষণ, বাঁচবে মানুষ সহ সকল প্রাণীকূল।


লেখক পূর্ব বর্ধমানের আঝাপুর হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত লেখকের নিজস্ব।