নয়াদিল্লি: কোন অফিসে কাজ করেন? কী কাজ করেন? কোন পদে রয়েছেন? আত্মীয়-পরিজন থেকে বন্ধুবান্ধব কিংবা স্বল্প পরিচিত, চাকরি সংক্রান্ত এ সব তথ্য এদের জানাতে দ্বিধা বোধ করেন না চাকুরিজীবীরা। কিন্তু বেতনের ক্ষেত্রে ছবিটা একেবারে উল্টো। কতটাকা বেতন পান সেটা একমাত্র পরিবারের কোনও সদস্যের কাছেই খোলসা করেন অধিকাংশ ভারতীয় চাকরিজীবী। প্রোফেশনাল নেটওয়ার্ক লিঙ্কডিন (LinkedIn)-এর একটি রিপোর্টে উঠে এল এমনই তথ্য। সেখানে বলা হচ্ছে, শতাংশের বিচারে ৬১ শতাংশ চাকরিজীবী তাঁদের বেতন সংক্রান্ত তথ্য শুধুমাত্র পরিবারের কোনও সদস্য়কেই একমাত্র জানাতে ইচ্ছুক।  


কেন এই অনিচ্ছা?
কাজের জায়গায় বেতন নিয়ে আলোচনাকে সেভাবে উৎসাহ দেওয়া হয় না। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রে বেতন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে উদ্বেগে ভোগেন ভারতীয় পেশাদাররা। ফলে বেতন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ভারতে হয় না।


সমীক্ষায় কী বেরিয়েছে:
পেশাদার ব্যক্তিদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে লিঙ্কডিন। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রোফেশনাল নেটওয়ার্ক। তারা একটি সমীক্ষা করে। নাম পেশাদার ব্যক্তিদের আত্মবিশ্বাস সূচক  (Workforce Confidence Index), সেখানেই কী কী মিলেছে তা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে লিঙ্কডিন। ভারতের ৪,৬৮৪ জন পেশাদারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে এই সমীক্ষা তৈরি হয়েছে। ৪ জুন থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সমীক্ষা চলেছে। সেখানে দেখা গিয়েছে, ভারতে কর্মক্ষেত্রে বেতন সংক্রান্ত আলোচনা ট্যাবু বা নিষিদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রতি দশ জন পেশাদারের মধ্যে মাত্র ১ জন বলেছেন তাঁরা নিজেদের সংস্থার বা অন্য সংস্থার কোনও কর্মীর সঙ্গে বেতন নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।


বেতন নিয়ে আলোচনা:
রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, সামগ্রিকভাবে ভারতের পেশাদারদের আত্মবিশ্বাস সামান্য হলেও ধাক্কা খেয়েছে। জুলাইয়ের তুলনায় সেপ্টেম্বরে সূচকের সামগ্রিক নম্বর বা composite score হ্রাস পেয়েছে। জুলাইয়ে যা ছিল +৫৫, সেটাই সেপ্টেম্বরে হয়েছে +৫২-তে। বিশ্বব্যাপী ডামাডোলের সময় কাজের জায়গা, আর্থিক পরিস্থিতি এবং কেরিয়ার নিয়ে অস্থিরতার কারণে এমনটা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সামগ্রিক ভাবে আত্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে নিম্নগামিতা লক্ষ্য করা গেলেও ভারতীয় পেশাদাররা যেকোনও সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আশাবাদী। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বলেছেন ভবিষ্যতে তাঁরা সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। ৭৪ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে আরও উন্নতি করতে পারবেন। ৭১ শতাংশ বলেছেন তাঁরা নিজেদের পেশাদারি অভিজ্ঞতা এবং পড়াশোনার ক্ষেত্রে পরবর্তী ধাপে যেতে পারবেন। ৬৮ শতাংশ আশা করছেন তাঁদের আয় বৃদ্ধি পাবে।


জেন জেড (Gen Z)-এর পেশাদাররা তাঁদের বেতন নিয়ে পরিবার, সদস্য, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে ভারতের ৬১ শতাংশ পেশাদার ব্যক্তি তাঁদের বেতন সংক্রান্ত তথ্য একমাত্র পরিবারের সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করছে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ২৫ শতাংশ ব্যক্তি সেই তথ্য তাদের ঘনিষ্ঠ কোনও বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেন। সার্বিক গড়ের সঙ্গে বিচার করলে দেখা গিয়েছে, কমবয়সী পেশাদারেরা বেতন সংক্রান্ত তথ্য় নিয়ে আলোচনা করতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ।


জেন জেড প্রজন্মের পেশাদারদের মধ্যে ৭২ শতাংশ এবং মিলেনিয়ালস প্রজন্মের পেশাদারদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ জানিয়েছেন তাঁরা তাঁদের বেতন-তথ্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে ইচ্ছুক। অন্যদিকে জেন জেড প্রজন্মের ৪৩ শতাংশ এবং মিলেনিয়ালস প্রজন্মের ৩০ শতাংশ পেশাদার তাঁদের বেতন নিয়ে ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গেও আলোচনা করেন। কর্মক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে কতটা সাবলীল ভারতের পেশাদাররা? সেই তথ্যও উঠে এসেছে সমীক্ষায়। জেন জেড প্রজন্মের ২৩ শতাংশ তাঁদের সহকর্মীদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। মিলেনিয়ালসদের মধ্যে ১৬ শতাংশ এবং জেন এক্সদের মধ্যে ১০ শতাংশ বিশ্বস্ত সহকর্মীদের সঙ্গে বেতন নিয়ে আলোচনা করেন।     


সংস্থার তরফে বক্তব্য:
লিঙ্কডিন নিউজের ইন্ডিয়া ম্যানেজিং এডিটর নিরাজিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, 'কর্মক্ষেত্রে বেতন নিয়ে আলোচনা করতে স্বচ্ছন্দ নন। তবে লিঙ্কডিন ওয়ার্কফোর্স কনফিডেন্স ইনডেক্সের তথ্য় দেখিয়েছে যে এত বদল আসছে। বেতন নিয়ে আলোচনার বিষয় এলেই পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এখনও ভারতীয়দের ভরসার বৃত্তের মধ্যে রয়েছে। তবে নতুন প্রজন্মে ক্ষেত্রে ছবিটা একটু এখনও আলাদা। কারণ এই প্রজন্ম সহকর্মী এবং নিজের স্তরের অন্য সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে বেতন নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক। জেন জেড প্রজন্মের ক্ষেত্রে এই হার অনেক বেশি। এই প্রজন্ম এই নিয়ে আলোচনা করতে এবং কর্মক্ষেত্রে বিষয়টি উত্থাপন করতে ইচ্ছুক।' তবে মিলেনিয়ালসরা এই বিষয়ে আলোচনা একেবারেই করতে চান না।


কেন এমন ছবি:
বেতন নিয়ে আলোচনা কেন নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়? তার কারণও উঠে এসেছে এই সমীক্ষায়। রিপোর্ট বলছে ভারতের ৪৫ শতাংশ পেশাদার জানিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে বেতন নিয়ে আলোচনা করতে উৎসাহ দেওয়া হয় না। মিলেনিয়ালস প্রজন্ম এবং জেন এক্স প্রজন্মও এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। তুলনায় একটু কম হলেও জেন এক্স প্রজন্মের পেশাদারদেরও মত একই। 


সমীক্ষায় ৩৬ শতাংশ পেশাদার জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের বেতন নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করতে উদ্বেগে ভোগেন। প্রজন্মের ভিত্তিতে ভাগ করলে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি মিলেনিয়ালস প্রজন্মের মধ্যে। যদিও সমীক্ষার অংশগ্রহণকারীদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ব্যক্তি মনে করছেন বেতন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হলে বেতনে সাম্য বজায় রাখা সুবিধাজনক হবে।      


রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের প্রতি ৫ জন পেশাদারের মধ্যে অন্তত ২ জন মনে করেন তাঁরা কাজের তুলনায় ঠিকঠাক বেতন পান। প্রায় সমসংখ্যক পেশাদার মনে করেন আগামী ৬ মাসের মধ্যে তাঁরা নিজেদের বেতন বাড়াতে চাইবেন।


কীভাবে সমীক্ষা:
ভারতীয় পেশাদারদের আত্মবিশ্বাস পরখ করতেই এক পক্ষকাল ধরে এই সমীক্ষা হয়েছে। পেশাদারেরা কী বলছেন, চাকরি নিয়ে, বেতন নিয়ে, কেরিয়ার নিয়ে কী ভাবছেন তা -১০০ থেকে +১০০ স্কেলের মধ্যে ফেলা হয়েছে। একদিকে পেশাদারেরা তাঁদের চাকরির স্থায়িত্ব এবং সুযোগ নিয়ে কী ভাবছেন, অন্যদিকে শিল্পপতিরা তাঁদের ব্যবসায় কীভাবে বিনিয়োগ করবেন তা নিয়ে বুঝতেই এই সমীক্ষা।


আরও পড়ুন:  পুরনো গাড়ি কেনার সময় অবশ্যই দেখুন এই বিষয়গুলি, অন্যথায় ঠকবেন