কলকাতা: স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম আপাত মন্দা (‘টেকনিক্যাল রিসেশন’) দেখা দিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংকের নাউকাস্ট নামের একটি সমীক্ষা রিপোর্টে এই কথা বলা হয়েছে। চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে এপ্রিল থেকে জুন, এই সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবর্ষের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে দেশের জিডিপি ৮.৬ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে জানানো হয়েছে দেশের এই আপাত বা সাময়িক মন্দা নিয়ে একটি সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হবে ২৭ নভেম্বর। পরপর দুটি কোয়ার্টারে জিডিপি সংকুচিত হলে অর্থনীতি মন্দার কবলে বলে ধরা হয়। আর যদি সেই মন্দা সাময়িক হয় অর্থাৎ তার রেশ কাটিয়ে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে তবে তাকে টেকনিক্যাল রিসিশন বা আপাতমন্দা বলা হয়। চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় কোয়ার্টার থেকে অর্থনীতি বৃদ্ধির মুখ দেখতে পারে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষা রিপোর্টে একে আপাতমন্দা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।


কেন্দ্রীয়  অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের দাবি, বিভিন্ন সূচক দেখে এটা স্পষ্ট যে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় কোয়ার্টারের পরিসংখ্যান সামনে এলে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।অর্থমন্ত্রীর দাবি, সরকারের সুসংহত সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ফলেই এই বৃদ্ধি হয়েছে।একইসঙ্গে অর্থনীতির পুণরুজ্জীবনের লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী দীপাবলির মুখে নয়া আর্থিক প্যাকেজও ঘোষণা করেছেন।
কেন্দ্র মে মাসে ‘আত্মনির্ভর ভারত অভিযান’ ১.০, অক্টোবরে ২.০ ঘোষণা করেছিল। এরপর গত বৃহস্পতিবার আত্মনির্ভর ভারত অভিযান ৩.০ ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী।

এই ঘোষণা অনুযায়ী, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করলে সরকার ভর্তুকি দেবে। এই ক্ষেত্রে সরকার কর্মী এবং সংস্থা উভয়েরই পিএফ খাতের ১২ শতাংশ টাকা ২ বছর পর্যন্ত সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে। তবে মোট কর্মীসংখ্যা ১০০০ জন পর্যন্ত হলে তবেই এই সুবিধা মিলবে। এক্ষেত্রে আরও কিছু শর্ত থাকছে।
এমার্জেন্সি ক্রেডিট লাইন গ্যারান্টি স্কিম ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অতিক্ষুদ্র শিল্প সংস্থাগুলি এর সুবিধা পাবে। ইতিমধ্যেই ২.০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এই প্রকল্পে।
আবাসন শিল্পের জন্য বেশ কিছু ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। যার মধ্যে রয়েছে, আবাসন বিক্রেতা ও ক্রেতাদের জন্য আয়কর ছাড়। মধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখেই, সার্কেল রেট এবং এগ্রিমেন্ট ভ্যালুর মধ্যে পার্থক্য ১০শতাংশ থেকে থেকে বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। ২ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়ির ক্ষেত্রে এই পার্থক্য বাড়ানো হয়েছে।
এছাড়াও আরও কয়েকটি ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অর্থনীতির হাল ফেরাতে এই প্যাকেজ পর্যাপ্ত নয় বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ।
সেন্টার ফর স্টাডিস ইন সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক শৈবাল কর বলেছেন, আত্মনির্ভর ভারত অভিযান তৃতীয় পর্বের ঘোষণায় সংগঠিত ক্ষেত্রের কোম্পানির কর্মীদের শর্তসাপেক্ষে প্রভিডেন্ড ফান্ডের জন্য একটা সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এটা খানিকটা কপিবুক পদ্ধতি। এতে কোম্পানির খরচ কিছুটা কমবে। আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট, সামাজিক সুরক্ষা খাতে কোম্পানি কর্মীদের যে অর্থ দেয়, তা দু' বছর বহন করবে সরকার। কিন্তু মনে রাখতে হবে পরিসংখ্যাণে যে তথ্য সামনে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে অতিমারীতে প্রায় ১২ কোটি চাকরি গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রফিডেন্ট ফান্ডের ক্ষেত্রে এই আর্থিক সহায়তা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে কতটা কাজ দেবে, সে সম্পর্কে কোম্পানিগুলিই নিশ্চিত নয়। এর সুদূর প্রসারী কোনও প্রভাব হয়ত থাকবে, এটা অনস্বীকার্য। কিন্তু এই মুহুর্তে যেটা প্রয়োজন ছিল, তা হল সাধারণ মানুষের কাছে সরাসরি কিছু আর্থিক প্যাকেজ পৌঁছে দেওয়া, যাতে তাঁরা সরাসরি বাজারে অংশগ্রহণ করতে পারেন। কারণ, সরকারের ঘোষিত সুরক্ষা প্রকল্প ভবিষ্যতের বিষয়। এই মুহুর্তে যদি চাকরি না থাকে বা চাকরির সুযোগ তৈরি না হয়, তাহলে এই প্যাকেজ পর্যাপ্ত কিনা, সেই প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে।
অধ্যাপক কর আরও বলেছেন, কপিবুক বলতে গেলে প্রথাগতভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে অন্য অনেক পদ্ধতি অনুসরণ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার। এ ধরনের পদ্ধতির মধ্যে কর্মসংস্থান তৈরির জন্য সরাসরি কোম্পানিগুলিকে ইনসেনটিভ বা বেনিফিট দানের মতো পদক্ষেপ বাদ চলে গিয়েছে। এমনটা করলে কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারত। কারণ, এটা অনস্বীকার্য যে, বেকারত্ব ও চাকরি হারানোই এই মুহুর্তের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
অধ্যাপক কর প্যাকেজে কোম্পানিগুলিকে ঋণ বা লগ্নির ক্ষেত্রে সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এগুলি কার্যকরী হতে গেলে বাজার থাকতে হবে। বাজারে চাহিদা না থাকলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ঋণের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য বাজারে চাহিদা থাকতে হবে। তা না থাকলে এক্ষেত্রে তেমন কোনও সুফল মিলবে না। সবমিলিয়ে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ঋণের মাধ্যমে ঘুরপথে আর্থিক সহায়তার ফলে ঘুরপথে বাজারে যে প্রভাব পড়বে, তার অনুপাত তুলনামূলকভাবে অনেক কম হবে। যদি তা হয়ও সেটা মানুষের হাতে সরাসরি নগদ পৌঁছে দেওয়ার থেকে অনেক গুণ কম হবে।
তিনি বলেছেন, মানুষের হাতে অর্থ এলে তাঁরা এই মুহুর্তে বাজারে খরচ করবেন। ফলে চাহিদা বাড়বে। উৎপাদনের চাকা গড়াবে। ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই হবে, কিন্তু এই মুহুর্তে যাঁর চাকরি নেই, তিনি সামাজিক সুরক্ষার থেকে অনেক বেশি ভাববেন সংসার চালানোর কথা। এমনও তথ্য সামনে আসছে যে, অনেকেই প্রভিডেন্ট পান্ড থেকে টাকা তুলে খরচ চালাচ্ছেন। কারণ, তাঁর অন্য কোনও পুঁজি নেই। ব্যাঙ্কে সুদের হারও কমে গিয়েছে। তাই তার থেকে টাকা তুলে সংসার চালানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সরাসরি নগদ পৌঁছে দেওয়া গেলে তা অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ত হতে পারত। এক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে এই সমস্যার সমাধান হবে না। তাছাড়া যদি কোনও প্রভাবও পড়ে, তা হবে অত্যন্ত ধীর গতির।

অধ্যাপক কর আরও বলেছেন, বিভিন্ন বহির্দেশীয় রেটিং এজেন্সি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যদি ডিসেম্বরেইপুনরুজ্জীবনের পূর্বাভাস দেয়, তাহলে নভেম্বরে এই প্যাকেজ ঘোষণার অর্থ কী, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
তিনি বলেছেন, বাজারে চাহিদা বাড়াতে নগদ হস্তান্তর কার্যকরী হতে পারত। এটাই প্রাথমিক রাস্তা। চাকরি প্রভিডেন্ট মারফৎ তৈরি হয় না। আর ভারতে প্রথাগত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান মাত্র ৭ শতাংশ। এর বাইরে রয়েছে বিশাল অংশের মানুষ। এখন খুচরো মূল্যবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। ফলে বাস্তবিত ক্ষেত্রে আয় কমছে। এই পরিস্থিতিতে স্বল্পমেয়াদে যে ত্রাণ প্রকল্প দেওয়া দরকার ছিল, তা অধরাই থেকে গেল।
অর্থনীতিদবিদ অভিরূপ সরকার বলেছেন, মন্দার মধ্যে ঢুকে গেছি। এটা সত্যি কথা। আইএমএফ গত অক্টোবরে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে সারা বছরের জন্য আর্থিক বৃদ্ধির হার নেগেটিভ ১০ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। কিন্তু ভারতে এই মন্দা এত বেশি হারে হল কেন, তা বোঝা যাচ্ছে না।অন্যান্য দেশেও কর্মসংস্থান, উৎপাদন কমবে, কিন্তু ভারতে মারাত্মকভাবে কমছে। বড় দেশগুলির মধ্যে এক্ষেত্রে ভারতের মতো একমাত্র স্পেন ,ইতালিতে কমবে বলে পূর্বাভাস।
তিনি বলেছেন, এর থেকে বেরোতে গেলে বড় প্যাকেজ সরকার, কোনও সন্দেহ নেই। এই প্যাকেজের দুটি দিক রয়েছে। এরমধ্যে একটি হল অর্থনৈতিক পুণরুজ্জীবন (রিভাইভাল), দ্বিতীয় হল সার্ভাইভাল। অর্থাৎ, অর্থনীতি বেহাল হয়ে পড়লে ফলে গরিবরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই তাঁদের সাহায্যের জন্য এই পদক্ষেপ। সার্ভাইভাল-এর ক্ষেত্রে একশো দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী গরিব যোজনার মতো প্রকল্প রয়েছে. কিন্তু এই প্রকল্পগুলিতে আরও বেশি টাকা দিলে ভালো হত। কারণ, এই সার্ভাইভাল তো আছেই, সেইসঙ্গে গরিবরা নোট বাতিলের সময় থেকেই সমস্যার মধ্যে রয়েছেন. হাতে টাকা পেলে খরচা করতে পারতেন। তাতে অর্থনীতি একটু চাঙ্গা হতে পারত।
অভিরূপ সরকার বলেছেন, তার বদলে রিভাইভাল প্যাকেজের আওতায় প্রভিডেন্ড ফান্ডে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এখন পিএফ দেওয়াটা একটা সংস্থার পক্ষে বিরাট কষ্টকর বলে মনে করাটা ঠিক নয়। এরজন্য লোক নিয়োগ হচ্ছে না,এমন ভাবাটা ঠিক নয়। সমস্যা আরও গভীর। সেই সমস্যার সমাধান পিএফে ভর্তুকি দিয়ে হবে না। কিংবা রিয়েল এস্টেটে সরকারি দাম ও প্রকৃত দামে ফারাকের ওপর কর দিতে হয়। সেটা কমানো হয়েছে। এগুলো খুবই ছোট পদক্ষেপ। এতে কোনও কাজ হবে না। পদক্ষেপ করতে হলে, পরিকাঠামো খাতে বড় আকারে লগ্নি করতে হবে। এমনটা এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর মুখে শোনা গিয়েছিল। এখন তা আর শোনা যাচ্ছে না।
তিনি বলেছেন, পরিকাঠামোয় লগ্নি করলে দুটো সুবিধা। প্রথমত, সরাসরি কর্মসংস্থান হবে। দ্বিতীয়ত- বেসরসকারি লগ্নিকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন। কারণ, উৎপাদনশীলতা বাড়বে। এই মন্দার থেকে বেরোতে একটি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। পরিকাঠামোয় একটা বড় ধরনের ব্যয় দরকার ছিল। এটাই সঠিক দিকনির্দেশিকা হতে পারত। সেটা এখন অবধি দেখতে পারছি না।