কলকাতা: প্রাথমিক দুর্নীতির দু'টি মামলা সরানো হয়েছে তাঁর এজলাস থেকে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামলার নিরিখে এমনই নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তার পর থেকেই নেট দুনিয়ায় এবিপি আনন্দকে বয়কটের ডাক উঠেছে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Justice Abhijit Ganguly) যেহেতু এবিপি আনন্দকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, সেখানে নাম নিয়েছিলেন অভিষেকের, তার জন্যই তাঁকে সুপ্রিম কোর্টের রোষে পড়তে হয়েছে বলে ওঠে দাবি। এমনকি গোটা ঘটনাক্রমের জন্য দায়ী করা হয় এবিপি আনন্দকে। সাক্ষাৎকার নিয়ে আসলে বিচারপতিকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন কেউ কেউ। কিন্তু নেটদুনিয়ায় ওঠা এই অভিযোগ নিয়ে প্রতিক্রিয়া চাইলে পত্রপাঠ শুধু তা খারিজই করলেন না, বরং বিরক্তিও প্রকাশ করলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সাফ জানিয়ে দিলেন, ফাঁদে ফেলার গল্প সম্পূর্ণ 'উদ্ভট, আজগুবি এবং মিথ্যা' (Justice Abhijit Ganguly Interview)।
তাঁকে ফাঁদে ফেলতে এবিপি আনন্দের তরফে ওই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে বলে প্রচার চলছে নেট দুনিয়ায়। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া চাইলে, সম্পূর্ণ ভাবে খারিজ করে দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এবিপি আনন্দ সাক্ষাৎকার তাঁর বক্তব্য, “আমি শুনেছি একটা প্রচার হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ ভুল। এবিপি আনন্দকে সাক্ষাৎকার তো আমি নিজের ইচ্ছেতে দিয়েছিলাম। এবিপি আনন্দ বা অন্য কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তো নয়। এই প্রচার যে কতটা উদ্ভট, তা একটু ভেবে দেখলে সহজেই বোঝা যায়। আমি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম গত সেপ্টেম্বরে। তাহলে এবিপি আনন্দের তখনই জানা ছিল যে সাত মাস পর এই ধরনের একটি আদেশ হবে! এসব প্রচার একেবারেই আজগুবি। সংবাদমাধ্যমকে আমি বিশেষ গুরুত্ব এবং মর্যাদা দিয়ে থাকি। কারণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা অতি জরুরি কাজ। তাই আমি এই ধরনের আজগুবি এবং মিথ্যে প্রচারের বিরোধিতা করছি।“
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বয়কটের ডাক এ যাবৎ অগ্রাহ্যই করে এসেছে এবিপি আনন্দ। মাননীয় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ও এ বার তা নিয়ে চূড়ান্ত বিরক্তি প্রকাশ করলেন। এই ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কেই যে অপমান করা হচ্ছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ হিমবাহ সমান নিয়োগে দুর্নীতিকে অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি বঙ্গ সমাজের সামনে এনেছেন, যাতে যোগ্যরা চাকরি পান এবং শাস্তি পান চোরেরা। তাই তিনি ফাঁদে পড়বেন বা কেউ চক্রান্ত করে তাঁকে ফাঁদে ফেলবেন, এটা বলে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কেই শুধু নয়, বৃহত্তর ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এত মানুষের সম্মিলিত লড়াইকেই খাটো করা হচ্ছে। অত্যন্ত সচেতন ভাবে, স্বেচ্ছায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এবং আজও নিজের সেই সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে করেন।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে এবিপি আনন্দকে সাক্ষাৎকার দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর যে মন্তব্যকে ঘিরে আইনি লড়াই চলল, কুন্তল ঘোষের মুখে তা শোনা যায় এ বছর এপ্রিল মাসে। তাই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় পরিষ্কার জানিয়েছেন যে, সাত মাস পর একজন অভিযুক্ত কী নাম নেবেন এবং সেই প্রেক্ষিতে বিচারপতি হিসেবে তিনি কী নির্দেশ দেবেন, তা সাত মাস আগে ঈশ্বর ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই সাক্ষাৎকার দেখানোর রাস্তা কিন্তু মোটেই মসৃণ ছিল না এবিপি আনন্দের জন্য। কারণ ওই সাক্ষাৎকারের একঝলক দেখেই কেউ কেউ কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চ অর্থাৎ সর্বোচ্চ বেঞ্চে চলে গিয়েছিলেন, যাতে যেন তেন প্রকারে সাক্ষাৎকারের সম্প্রচার বন্ধ করা যায়। রাত ৮টায় সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচারিত হওয়ার আগে কলকাতা হাইকোর্টের সেই সর্বোচ্চ বেঞ্চ সন্ধে ৬টা বেজে ৫০ মিনিটে জানিয়ে দেয় যে সাক্ষাৎকার প্রদর্শনে কোনও বাধা নেই। তার পরই সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচারিত হয়।
এবিপি আনন্দকে সাক্ষাৎকার দেওয়া নিয়ে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়, তা-ই তুলে ধরা হল দর্শকদের সামনে। কিন্তু লড়াই কি শুধু এই টুকুই ছিল! দুর্গাপুজোর কয়েকটি দিন যখন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা, সেই সময় কলকাতা হাইকোর্টেও ছুটি ছিল। তার পরেও, ওই সময়ই কলকাতার একটি থানা থেকে নোটিস ধরানো হয় এবিপি আনন্দকে। তাতে বলা হয় যে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্য়ায়ের ওই সাক্ষাৎকার দেখালে রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ হতে পারে। তাই কলকাতার ওই থানার ওসি সাক্ষাৎকার কোনও রকম কাটছাঁট ছাড়াই দেখতে চান। তিনি থানায় বসে সেটি দেখবেন বলে জানানো হয়। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট খুললে, তবেই যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ মেলে। এমন হাজারো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবিপি আনন্দকে।
তাই সাক্ষাৎকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্য়ায়কে ছোট না করাই উচিত। তাঁকে ফাঁদে ফেলা হয়নি। বরং নিয়োগ দুর্নীতির যে ফাঁদে বেশ কয়েক বছর ধরে পড়েছিলেন, সুচিন্তিত ভাবে হয়ত ওই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই বাংলার মানুষকে সেই ফাঁদ কাটিয়ে বেরোতে সাহায্য় করেছেন তিনি। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের দু’কামরার ফ্ল্যাটে ঢুকলে দেওয়ালে বাঁধানো ফ্রেমে ঋত্বিক ঘটকের একটি ছবি এবং উক্তি চোখে পড়ে, যাতে লেখা রয়েছে ‘ভাবো, ভাবো। ভাবা প্র্যাক্টিস করো’। তাঁর সাক্ষাৎকার ঘিরে উদ্ভুত বিতর্কের ক্ষেত্রেও এই উক্তি প্রযোজ্য।