শুভেন্দু ভট্টাচার্য, কোচবিহার: খেলতে খেলতে রক্তপাত। এক বন্ধুর শিরচ্ছেদ হয় অন্যের হাতে। কোচবিহারের (Cooch Behar) রাজবংশের পুজোর (Durga Puja 2022) সঙ্গে জড়িয়ে এমনই ভয়া ধরানো কাহিনি। ওই কাটা মুণ্ড মায়ের চরণে নিবেদন করা হয়। নরবলির চলও ছিল দীর্ঘকাল। কালের প্রলেপে, আইনের প্রচলনে, তা যদিও বন্ধ হয়েছে। তবে কোচবিহারে ‘বড় দেবী’র আরাধনায় আজও লাগে মানবশরীরে তাজা রক্ত (Human Sacrifice)।


কোচবিহারের এই পুজোর বয়স ৫০০ বছর


এই ‘বড় দেবী’র পুজোর পৃষ্ঠপোষক ছিল কোচবিহারের রাজবংশ। শোনা যায়, আনুমানিক ১৫১০ সালে, বালক বয়সি বিশ্ব সিংহ এবং তাঁর ভাই শীষ্য সিংহ খেলার ছলে দেবীর আরাধনা শুরু করেন। ময়নার ডালকেই দেবীরূপ দিয়ে পুজো করেন তাঁরা। তবে পুজো আড়ম্বরে পরিণত হয়ে মহারাজা নরনারায়ণের আমলে।


কথিত আছে,  স্বপ্নে দেবীকে যে রূপে দেখেছিলেন রাজা নরনারায়ণ, সেই রূপেই আজও পূজিত হন দেবী। সবমিলিয়ে এই পুজোর বয়স প্রায় ৫০০ বছর। অন্য় প্রতিমার থেকে এই প্রতিমা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে দেবী রক্তবর্ণা, ভয়ের উদ্রেক হয়।  ছেলে-মেয়ে নিয়ে মর্ত্যে আগমন ঘটে না তাঁর, বরং সঙ্গে থাকেন দুই সখী জয়া এবং বিজয়া। দেবীর বাহন বাঘ এবং সিংহ।


শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমী থেকেই এই পুজোর সূচনা হয়। ডাঙ্গর আই মন্দিরে ময়না কাঠ পুজো করা হয় প্রথমে। সেই কাঠ ‘বড় দেবী’র মন্দিরে এনে, কাঠামোর করে, তার উপর সুরু হয় প্রতিমা তৈরির কাজ।


আরও পড়ুন: Durga Puja 2022 : যন্তর-মন্তরের রহস্য থেকে নায়কের শিহরণ জাগানো দৃশ্য, বাগনানের পুজোয় এবার থিম সত্যজিৎ


এই পুজো নিয়ে নানা গল্পকথা চালু রয়েছে। কথিত আছে, মহারাজা বিশ্ব সিংহ খেলার ছলে এক সাথীকে কুশ দিয়ে আঘাত করেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই বালকের মাথা আলাদা হয়ে যায় ধড় থেকে। সেই মাথা দেবীকে নিবেদন করেন বিশ্ব সিংহ।  এই পুজোয় নরবলির চল ছিল। এখনও পুজোয় মানুষের রক্তের প্রয়োজন পড়ে।


‘বড় দেবী’র পুজোয় অষ্টমীর সন্ধি ক্ষণে গোপনে আরাধনা চলে। সেখানে মানুষের রক্ত দিয়ে পুজোর উপাচার রয়েছে। বংশপরম্পরায় হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে আসছে এক পরিবার।


এক সময় কোচবিহারের রাজবংশই এই ‘বড় দেবী’র পুজোর পৃষ্ঠপোষক ছিল। এখন রাজার রাজত্ব নেই। বর্তমানে পুজোর আয়োজন করে রাজ্য পর্যটন দফতরের অধীনস্থ কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট। কোচবিহার মদনমোহন মন্দিরের রাজপুরোহিত হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, বহু যুগ ধরে প্রথা মেনে পুজো চলে আসছে। পুজোতে পশুবলি হয়। অষ্টমীতে মহিষ, দশমীতে শূকর বলির প্রথা চালু রয়েছে এখনও।


দলে দলে প্রতিমাদর্শনে ভিড় করেন মানুষ


‘বড় দেবী’র এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কোচবিহারের মানুষের আবেগ। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটে। সংলগ্ন জেলা, এমনকি অসমের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই দেবী-দর্শনে হাজির হন দলে দলে মানুষ। দশমীর সকালে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর যমুনা দীঘিতে নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিমা। খণ্ডিত করে বিসর্জন দেওয়া হয়।