আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে টয় ট্রেনের (toy train) কু ঝিক ঝিক...মাথায় তুষার শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার (kanchenjunga)মুকুট। গা বেয়ে ধাপে ধাপে চা-পাতার আবরণ। অলঙ্কারের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কমলালেবু। দার্জিলিং মানেই সম্মোহন। দার্জিলিং (Darjeeling) মানে রূপেও ভুলে যাওয়া, ভালবাসাতেও। এ রাজ্যের উত্তর অংশে অবস্থিত দার্জিলিং জেলা। মনোরম শৈলশহরের গর্ব করার মতো সম্পদের শেষ নেই। পাহাড়ি আমেজ, বিশ্ববিখ্যাত চা (tea garden), তিস্তা (tista)লাস্য, বাংলার বহু মণীষীর বাড়ি দার্জিলিং। পরতে পরতে ব্রিটিশ স্থাপত্য বহন করে চলা এই শহরের একাধিক ভবনকে দেখলে মনে পড়তেই পারে পুরনো লন্ডনের কথা। তিব্বতি ভাষা ‘Dorje’ শব্দের মানে দেবরাজ ইন্দ্রর অস্ত্র বজ্র। আর ‘Ling’ কথার অর্থ, ল্যান্ড বা স্থান। তার থেকেই দার্জিলিং নামের উৎপত্তি।


দার্জিলিং


দার্জিলিং এই জেলার সদর শহর। কার্শিয়ং ও শিলিগুড়ি হল এই জেলার অপর প্রধান শহর। এই জেলার অপর গুরুত্বপূর্ণ শহর মিরিক একটি বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র। আছে সুন্দরী ডুয়ার্স। দার্জিলিং জেলার মধ্যেই ডুয়ার্সের আবহাওয়া আর সুউচ্চ পাহাড়ি ঠান্ডা, দুইয়ের আমেজই পাওয়া যায় পুরদস্তুর। তাই দার্জিলিঙের আবহাওয়ার ( Darjeeling Weather ) উপর সারা বাংলার তো বটেই নজর থাকে সারা দেশের পাহাড় প্রেমীদেরই। 


টাইগার হিল, ঘুম, সান্দাকফু, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক এবং পিস প্যাগোডা হল দার্জিলিং-এর কিছু জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। দার্জিলিং এর ঘুমে অবস্থিত ঘুম রেলওয়ে স্টেশনটি বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলওয়ে স্টেশন। ঘুমে গোর্খা সৈন্যদের একটি স্মৃতিসৌধও রয়েছে। দার্জিলিং-এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চা বাগান। সেগুলোও দেখে আসতে পারেন। 


দার্জিলিং ভ্রমণের সেরা সময় :মার্চ থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর।
দার্জিলিংয়ে শীত উপভোগ করার সময় : ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি।
দার্জিলিং ভ্রমণ বর্ষার জন্য ঝুঁকির হয় : জুন থেকে সেপ্টেম্বর। 


টাইগার হিল
পাহাড়ের উপর থেকে অপূর্ব সূর্যোদয় দেখতে গেলে ভোর বেলা উঠে যেতে হয় টাইগান হিলে। শহর থেকে ২৫৯০ মিটার দূরে ও ১৩ কিমি উচ্চতায় অবস্থিত। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টও এখান থেকে দেখা যায়। তবে তার জন্য কুয়াশা মুক্ত দিন চাই। 


বাতাসিয়া লুপ
দার্জিলিং থেকে ৫ কিমি দূরে রেলওয়ে লুপ, একটি বিস্ময়কর দর্শনীয় স্থান। লুপ অর্থাৎ বৃত্তাকার একটি পার্ক, যাকে ঘিরে রয়েছে টয় ট্রেনের লাইন। 1947 সাল থেকে বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত দার্জিলিংয়ের সাহসী সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত এই যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ। বাতাসিয়া লুপে টিকিট কেটে ঢুকতে হয় । প্রাকৃতিক শোভা দর্শনই এখানকার মূল আকর্ষণ। 


সেনচল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য 
দার্জিলিংয়ের মূল শহর থেকে প্রায়  ১০ - ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই অভয়ারণ্য। এটি ভারতের প্রাচীনতম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যগুলির মধ্যে একটি । এটি প্রায় ৩৮৩৮ বর্গকিমি জুড়ে রয়েছে।   এখানে গেলে দেখা মিলবে হরিণ, বন্য শুকর, হিমালয়ের কালো ভাল্লুক, ভারতীয় চিতাবাঘ, জঙ্গল বিড়াল, রিসাস বানর, আসাম মাকাক, হিমালয়ের উড়ন্ত কাঠবিড়ালির। অভয়ারণ্যটিতে বহু পাখি। দুটি হ্রদ দার্জিলিং শহরে পানীয় জল সরবরাহ করে।


দার্জিলিং হিমালয়ান রেল বা টয় ট্রেন
১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত এই রেলপথের দৈর্ঘ্য ৮৬ কিলোমিটার (৫৩ মাইল)। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যেতে এই ট্রেন ব্যবহার করেন অনেকে । তবে সময় বেশি লাগে। দার্জিলিং ও পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্টেশন ঘুমের মধ্যেও চলাচল করে ট্রেন। এই ট্রিপটিও আকর্ষণীয়। পথেই পড়বে বাতাসিয়া লুপ। ৮৭৮ সালে স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলের মাধ্যমে কলকাতা ও শিলিগুড়ি যুক্ত হয়। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত শিলিগুড়ি থেকে একটি কার্ট রোডের (অধুনা হিল কার্ট রোড) মাধ্যমে দার্জিলিং যুক্ত হয়। টয় ট্রেনের টিকিট বুক করা যায় অনলাইনেও। 


ঘুম
ঘূম পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের একটি ছোট পাহাড়ি এলাকা। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ঘুম রেলওয়ে স্টেশন ভারতের সর্বোচ্চ রেলওয়ে স্টেশন। এটি 7,407 ft উচ্চতায় অবস্থিত। জায়গাটি ঘুম মনাস্ট্রি এবং বাতাসিয়া লুপের বাড়ি, দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের একটি বাঁকে রয়েছে। 


চিড়িয়াখানা 
১৯৫৮ সালের ১৪ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ গভর্নমেন্টের শিক্ষা বিভাগ হিমালয়ান প্রাণীজগত অধ্যয়ন ও সংরক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে দার্জিলিংয়ের বার্চ হিল পাড়ায় একটি চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করে। এর প্রথম ডিরেক্টর ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দিলীপ কুমার দে। এখন সেই চিড়িয়াখানায় ভলুক, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ ও মেষ, পাণ্ডা সহ নানা প্রাণি রয়েছে। 


হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট 
এইচএমআই বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্বতারোহণ ইনস্টিটিউট। প্রয়াত তেনজিং নরগে শেরপা ও স্যার এডমুন্ড হিলারির স্মরণে তৈরি এই ইনস্টিটিউট।  ইনস্টিটিউটের একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষকে পর্বতারোহণ এবং গ্রুপ অ্যাডভেঞ্চার ক্রিয়াকলাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। 


দার্জিলিং মল
দার্জিলিংয়ের প্রাণকেন্দ্র। চার রাস্তার মিলন ক্ষেত্র। বিনোদনের কেন্দ্র। কেনাকাটার স্বর্গরাজ্য । দার্জিলিংয়ের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির মধ্যে এটি একটি। এখানে পর্যটকরা ঘোড়ায় চড়ে ঘোরেন। চৌরাস্তা দার্জিলিং পাহাড়শ্রেণীতে অবস্থিত এবং এটি এখন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু । এখানে স্থানীয় প্রশাসনিক বৈচিত্রময় অনুষ্ঠানগুলিও হয়। 




মহাকাল মন্দির
মহাকাল মন্দির মল রোডের খুব কাছেই অবস্থিত।  ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে দুর্জয় লিং জিং নামে একজন লামার উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল। এই মন্দিরটি প্রধানত ভগবান শিবের মন্দির । তবে এখানে মহাদেবের সাথে মা কালী, হনুমান, গণেশ ও ভগবান বুদ্ধও পূজিত হন।


পিস প্যাগোডা 
এটি সারা পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ প্যাগোডাদের মধ্যে অন্যতম।  সকল জাতি ও ধর্মের লোকদের একত্রিত করার মূল মন্ত্রেই নির্মিত এই প্যাগোডা। এটি নিচিডাতসু ফুজি (১৮৮৫-১৯৮৫)র নেতৃত্বে নির্মিত। জাপানের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং নিপ্পনজান-মাইহিজির দ্বারা নির্মিত। সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেমন জাতকের জীবনের নানা পর্যায় সম্পর্কি জানতে পারবেন, তেমনই পাহাড়ের কোলে শ্বেতশুভ্র এই প্যাগোডা থেকে দেখা যায় নয়নাভিরাম কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। 


জাপানি টেম্পল
এটি নিপ্পনজান মায়োহজি বৌদ্ধ মন্দির নামেও পরিচি।  এই মন্দিরটি 1972 সালে নির্মিত। দার্জিলিং শহরের কেন্দ্র থেকে 10 মিনিট দূরে পিস প্যাগোডার খুব কাছে এই জায়গা।  জালাপাহাড়ে পাহাড়ে অবস্থিত। স্থাপত্যশৈলীতে এটি  ক্লাসিক জাপানি শৈলীকে মনে করাবে।  এখানে ধ্যান করে মনে শান্তি মিলবে। 


রয় ভিলা 
রয় ভিলা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের লেবানং কার্ট রোডে অবস্থিত। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর সিস্টার নিবেদিতা মারা যান এই বাড়িতে।  এখন রামকৃষ্ণ মিশনের তত্ত্বাবধানে আছে রায় ভিলা।  প্রায় 115 বছর পুরনো এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িতে থাকতেন বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। যখন সিস্টার নিবেদিতার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছিল, তখন তিনি এবং লেডি অবলা বোস সিস্টার নিবেদিতাকে এই বাড়িতে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান। 




এছাড়াও দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আছে রক গার্ডেন, গঙ্গা মাইয়া পার্ক, নাইটিঙ্গল গার্ডেন, দার্জিলিংয়ের বাজার, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রায়ের বাড়ি। দার্জিলিং থেকে গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসা যেতে পারে তিনচুলে তাকদা, লামাহাটা, মম্পু, মানসন, লেপচাজগত, মিরিক যেতে পারেন। একদিকে আকাশচুম্বি শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। অন্যদিকে, পাইন গাছের নিস্তব্ধতা আর চোখ জুড়নো অর্কিড, রডোডেনড্রনের আকর্ষণ। প্রকৃতি যেন তার সবটা উজার করে দিয়েছে পাহাড়ের রানিকে। কুয়াশা ঘেরা আর মেঘে ঢাকা পাহাড়ের বুক চিড়ে ছুটে চলা টয় ট্রেনে সওয়ারি পর্যটকরা বুঁদ হয়ে যান প্রকৃতির শোভায়। খাদের ধারের রেলিংয়ের নস্টালজিয়া। আর কেভেন্টার্স, গ্লেনারিসের হাতছানি। ঘুরে আসুন শীতের শহর দার্জিলিং থেকে।