কালিম্পং ( Kalimpong ) , ছোট্ট মেঘে ঘেরা শহর। শহরটি দার্জিলিং ( Darjeeling ) থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পূর্বে ১২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। একসময় ভারত ও তিব্বতের মধ্যে ট্রান্স-হিমালয়ান বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল কালিম্পং । দার্জিলিং জেলার এক্কেবারে প্রতিবেশী জেলা হলেও কালিম্পংয়ের স্বাতন্ত্র্য যে কাউকে মুগ্ধ করে। ইতিহাসের পাতা ছুঁয়ে ... একসময় কালিম্পং ছিল সিকিমের ( Sikkim ) অন্তর্গত। সে বহুকাল আগের কথা। সিকিম -শাসনে এই অঞ্চল ডালিংকোট নামে পরিচিত ছিল ১৭০৬ সালে ভুটান ( Bhutan ) রাজা একটি যুদ্ধে জয়লাভ করে । তারপর এই অঞ্চলটি সিকিম রাজার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন। তখন থেকেই কালিম্পং নামকরণ। তারপর থেকে দীর্ঘদিন ভূটানের রাজার শাসনে ছিল এই পাহাড়ি ছোট্ট এলাকা । ১৮৬৫ সালে যখন ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে, সেই সময় ব্রিটিশরা এক যুদ্ধে ভূটান রাজার সেনাদের হারিয়ে কালিম্পং দখল করে। ভূটান কালিম্পংকে হারায় । সেই থেকে কালিম্পং ভারত ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। দার্জিলিং-এর সঙ্গেই পিঠোপিঠি পাহাড়ি শহর। সে সময় আবহাওয়ার জন্যই ছিল ব্রিটিশদের বড় প্রিয়। দেশ ছেড়ে আসা সাহেবরা অনেকেই আস্তানা তৈরি করেন কালিম্পং-এ। ক্যাথোলিক মিশনারিজরাও থাকতে শুরু করেন। এভাবেই একেবারে ভিন্নধারার সংস্কৃতি ঢুকে পড়ে চড়াই-উতরাইয়ে।
ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসন। কলকাতা রাজধানী শহর । পশ্চিমবঙ্গে ( West Bengal ) পাহাড়ি অঞ্চল দার্জিলিংয়ে ব্রিটিশরা মনের মত করে সাজাচ্ছে তাদের গ্রীষ্মকালীন বিলাসভূমি। দার্জিলিংয়ে একের পর এক চা বাগান নিয়োগ হচ্ছে অনেক শ্রমিক । কাজের সন্ধানে সে সময় অনেকেই দার্জিলিংয়ে আসছেন। কেউ কেউ আবার কালিম্পঙেও যেতে শুরু করলেন চা বাগানে কাজ করার জন্য। কালিম্পং শহরটা যেমন চা বাগানের দিয়ে ঘেরা তেমনি ঘেরা নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ( Education ) দিয়ে। ব্রিটিশ শাসকরা কালিম্পং তাদের দেশের ধাঁচে অনেক স্কুল নির্মাণ করেছে। আজও পাহাড়ি কালিম্পঙে গেলে যে স্কুলগুলি দেখা যায়, সেখানে ব্রিটিশর ছাপ পাওয়া যায়। ইংরেজরা তাদের দেশের সংস্কৃতি, ভাবধারা, জীবনযাত্রা এখানে ধরে রাখতে চেয়েছে। তাই সেখানে বহু সাহেবি বাংলো। সেই আমলের কাঠ বা পাথরের বাড়িগুলি দেখলেই বোঝা যায় দেশ ছেড়ে চলে আসা ব্রিটিশরা তাদের নস্টালজিয়া ধরে রাখতে চেয়েছিল এখানে। যেমন, কালিম্পংয়ের মর্গ্যান হাউস।
অর্থনৈতিক ইতিহাসতিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যম ছিল কালিম্পং । এই শহর ছিল ভারত-তিব্বত বাণিজ্যদ্বার। চিনের তিব্বত আগ্রাসন ও ভারত-চিন যুদ্ধের আগে পর্যন্ত তো বটেই। উল ও খাদ্যশস্য আমদানি-রফতানিতে কালিম্পং ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। পরবর্তীতেও কালিম্পং একদিকে যেমন তার সৌন্দর্য দিয়ে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে টেনেছে, তেমনই নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে ফুল ও ক্যাকটাসের নার্সারি দিয়ে। কৃষিকাজ এখনও এই জেলার বহু মানুষের রুজিরুটি। এছাড়া ফল চাষ ও তার থেকে বিভিন্ন রকম খাবার তৈরিতে এই জেলার মানুষের মুন্সিয়ানা রয়েছে। এছাড়া এ জেলার বহু মানুষ যুক্ত শিক্ষা ক্ষেত্রে। বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্কুলগুলিতে অনেকে শিক্ষক বা অশিক্ষক পদে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত। জেলা পরিচিতিদার্জিলিং হিমালয়ের পূর্ব অংশে ১৩০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কালিম্পং দার্জিলিং জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর সম্প্রতি কালিম্পং স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। জেলাটি পশ্চিমবঙ্গের ২১ তম জেলা। দার্জিলিং জেলা থেকে বিভক্ত হয়ে কালিম্পং আলাদা জেলা হিসেবে মর্যাদা পায় ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি । এই জেলায় ২৩ টি ওয়ার্ড। তিনটি সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লক নিয়ে তৈরি কালিম্পং পৌরসভা । কালিম্পং I, কালিম্পং II এবং গোরুবাথান । ৪২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে জেলায়। হিমালয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, ডুয়ার্সের আদিম প্রকৃতি, ঘন জঙ্গল, মনোমুগ্ধকর উপত্যকা বেষ্টিত জেলা এটি।
সংস্কৃতিসময়ের সঙ্গে সঙ্গে কালিম্পংয়ে মিলেছে নানা সংস্কৃতি । পাহাড়ি শহরটি হয়ে উঠেছে নেপাল, সিকিম, তিব্বত এবং ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসা মানুষের সাংস্কৃতিক মোহনা। এত ভিন্ন ধরনের মানুষের বাসের ফলে কালিম্পংয়ের সংস্কৃতি অনেকটাই মিশ্র প্রকৃতির । তাই বৈচিত্র্যময় কালিম্পং এ খাওয়া-দাওয়াও। আবহাওয়াকালিম্পং এমন একটি উচ্চতায় অবস্থিত যেখানে শীত এবং গ্রীষ্ম দুই কালেই অত্যন্ত মনোরম আবহাওয়া । শীতের কামড় যেমন দার্জিলিংয়ের মত কড়া নয় তেমনই গ্রীষ্ম একেবারেই প্রখর নয়। একথা অস্বীকার করা যায় না যে কালিম্পং শহুরে নির্মাণের জন্য অনেকটাই বদলে গিয়েছে। একের পর এক বহুতল, হোটেল, বাজার, ঘিনজি বসতি পাহাড়ে সৌন্দর্যকে কিছুটা হলেও ম্লান করেছে। পর্যটনকালিম্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এর ভৌগোলিক অবস্থান ,রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনা করলাম কিন্তু সবার আগে আমাদের আলোচনা করতে হবে কালিম্পংয়ের ট্যুরিজম নিয়ে। কারণ পশ্চিমবঙ্গবাসী তথা ভারতের কাছে কালিম্পং সবার আগে একটি পর্যটন কেন্দ্র । যদিও শিক্ষা সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কালিম্পংয়ের স্বতন্ত্র পরিচিতি আছে । হিমালয় পূর্ব কোলে অতি সুন্দর একটি রাজ্য কালিম্পং । কালিম্পং ছাড়াও পাশাপাশি আরও অনেকগুলি জায়গা দেখার রয়েছে যেমন লাভা, লোলেগাঁও, পেডং ,ঋষপ ইত্যাদি । এছাড়া পাশের জেলা দার্জিলিং, গ্যাংটক , কার্শিয়াং, মিরিক এগুলোতো অবশ্যই দেখা যেতে পারে। কালিম্পং গেলে কী কী দেখবেন গৌরীপুর হাউসরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের বাড়ি নয়। তবে এ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন । থেকেছেন। লিখেছেন একাধিক কবিতা। নিজে হাসে বসিয়েছেন গাছ। এই বাড়িতে বসেই কবি ৭৮তম জন্মদিনে আবৃত্তি করেছিলেন 'জন্মদিন' কবিতা। বাড়ির মালিকানা ঠাকুরবাড়ির কারও নয়। তাই এই বাড়ি অরক্ষিত । এখানে ফলকে লেখা, ‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে ‘‘জন্মদিন” কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন।’থার্পা চোলিং মঠথার্পা চোলিং মঠ। শান্তিতে মন জুড়াতে চাইলে এখানে অবশ্যই যাবেন। মরগান হাউসএই বাড়ি ঘিরে নানারকম রহস্য। ভৌতিক গপ্পো। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মর্গান ১৯৩০ এর দশকে মর্গান হাউস নামে পরিচিত বাড়িটি নির্মাণ করেন। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগম এটি পরিচালনার দায়িত্বেজং ডগ পালরি ফো ব্রাং মনাস্ট্রিদুরপিন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত জং ডগ পালরি ফো ব্রাং মনাস্ট্রিটি ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । দুরপিন হিল থেকে চোখ ধাঁধানো স্থাপত্য এবং নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখুন।
নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কউত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম দেখার মতো জঙ্গল নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক। এখানে নানা পশুর দেখা মিলবে। জেলেপলা ভিউপয়েন্টভারতীয় সেনাবাহিনী জেলেপ্লা ভিউপয়েন্ট রক্ষণাবেক্ষণ করে। কালিম্পং-এর অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।ডেলো পাহাড়শহরের সর্বোচ্চ পয়েন্ট এবং কালিম্পং-এর একটি সুপরিচিত পর্যটন গন্তব্য হল ডেলো পাহাড়। পাহাড়টি শহরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত।লেপচা জাদুঘরলেপচা জাদুঘর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। কালিম্পং-এর অন্যতম আইকনিক দর্শনীয় স্থান, মূল শহর থেকে প্রায় 2 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।লাভা এবং লোলেগাঁওলাভা, গাছে ঘেরা একটি মনোরম পাহাড়ী শহর। কালিম্পং থেকে দেড় ঘন্টার পথ।পেডংপেডং, একটি শান্ত পর্যটন গন্তব্য, ওল্ড সিল্ক রোড বরাবর কালিম্পং থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। সেখানে দেখবেন, পেডং মনাস্ট্রি, ড্যামসুং ফোর্ট, সাইলেন্স ভ্যালি, ক্রস হিল, রিক্কিসুম, রামিতে ভিউপয়েন্ট এবং টিনচুলি ভিউপয়েন্ট হল শহরের সবচেয়ে বেশি দর্শনীয় পর্যটন আকর্ষণ। এছাড়াও কালিম্পংয়ে গেলে অর্কিড গার্ডেন, সায়েন্স সিটি, রবি স্মৃতি বিজরিত গৌরিপুরের বাড়ি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভানুভবন দেখতে ভুলবেন না। চাষাবাদ ও উদ্ভিদ পরিচিতি কালিম্পং জেলার কথা বলতে গেলে অবশ্যই এর কৃষি কাজের বিষয়টি আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। কালিম্পং জেলায় বহু মশলার চাষ হয় । সেই সঙ্গে বেশ কিছু গুল্ম চাষ হয়ে থাকে । পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দারচিনি, হলুদ ইত্যাদি চাষের সিংহভাগই হয়ে থাকে দার্জিলিং, কালিম্পং এই জেলাগুলিতে। এছাড়া নানা রকম ফুলের স্বর্গরাজ্য কালিম্পং । নভেম্বর থেকে মার্চ এই সময়ের মধ্যে পাহাড়ে গেলে নানা রকম ফুল দেখতে পাবেন পর্যটকরা । এছাড়া নানা ছোট গাছ, গুল্ম, নানা ধরনের ঘাস জাতীয় গাছ এবং ঔষধি বৃক্ষের স্বর্গরাজ্য এই জেলা । কালিংপংয়ের অর্থনীতি যেমন পর্যটনের উপরেও নির্ভরশীল তেমনই অনেকেই নির্ভর করেন কৃষিকাজ এবং ফুল চাষের উপর। এখানে বহু ফুলের নার্সারি দেখা যেতে পারে। এছাড়া এমন কিছু গাছ এই জেলায় রয়েছে যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কালিম্পংয়ে গেলে কী কী কিনবেন যারা যারা কালিম্পং এ গিয়ে কেনাকাটা করার কথা ভাবেন তারা যেমন শীতবস্ত্র কিনতেই পারেন তেমনই আছে আরো অনেক কিছু যা একান্ত ভাবে কালিম্পংয়েই তৈরি হয়। যেমন এখানকার সুস্বাদু চিজ এবং ললিপপ। জানা যায়, একসময় সুইজারল্যান্ড থেকে ক্যাথলিকরা এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন এবং তৈরি করেন চিজ ফ্যাক্টরি ও বেকারি। তা এখন আর নেই বটে কিন্তু সেই পদ্ধতিটা এই অঞ্চলের বাসিন্দারা রপ্ত করে নিয়েছেন । এছাড়াও নানারকম হাতে তৈরি কাগজ বা সৌখিন হ্যান্ডমেড পেপার তৈরি হয় এই জেলায় । এখানে গেলে এক ধরনের সবজি পাওয়া যাবে যাকে বলা হয় ডালি খোরসানি । এটি আসলে এক ধরনের লঙ্কা । লাল লাল গোল গোল । দেখতে অনেকটা চেরির মতো হলে কী হবে এর স্বাদ, সুগন্ধ যে কোনও রান্নাকেই অন্য মাত্রা দেয় ।এছাড়া কালিম্পং এ বেশ প্রচলিত পিং নামে এক ধরনের নুডুলস । এই নুডুলসকে অনেকে গ্লাস নুডুলস ও বলে থাকেন। কুটির শিল্প হিসেবে এই জেলায় বেশ প্রচলিত এই গ্লাস নুডুলস ।
Kalimpong Complete Information ( ISBN 81 - 875992-01-X https://kalimpong.gov.in/https://wbtourism.gov.in/https://wb.gov.in/
ছবি সূত্র : https://kalimpong.gov.in/
আরও পড়ুন: মরচে ধরা গা ছুঁয়ে আজও বয়ে যায় নদী, এককালের শিল্পশহর হাওড়া, ইতিহাস মনে রেখেছেন কেউ কি!